ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

অস্থিরতায় চালের বাজার

রিশিত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৩, ১৮ অক্টোবর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অস্থিরতায় চালের বাজার

রিশিত খান : দেশে চালের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। হঠাৎ করে নয়, প্রায় মাসখানেক যাবত চালের বাজারে এই অস্থিরতা চলছে। সব ধরনের চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

তবে উদ্বেগের ব্যাপার হলো বাজারে  মোটা চালের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। নিম্ন আয়ের মানুষের প্রধান খাবার ভাত। আর দাম কম হওয়ার কারণে তারা মূলত মোটা চালই কিনে থাকেন।  কিন্তু মোটা চালের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে এখন প্রায় চিকন চালের কাছাকাছি চলে গেছে। যে কোনো মোটা চাল এখন কেজিতে  ৪০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।

 

এ চিত্র শুধু রাজধানীতেই নয়, সারা দেশেই এই মূল্যবৃদ্ধির ঝক্কিতে নিম্ন আয়ের মানুষরা। খুচরা ও পাইকারি উভয় বাজারেই বাড়ছে চালের দাম।

 

চালের দাম বাড়ায় এখন হাঁসফাঁস অবস্থা নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বল্প আয়ের ভোক্তাদের। গত কয়েক মাসে অন্য চালের তুলনায় মোটা চালের দাম আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে অসুবিধায় পড়েছেন নি¤œ আয়ের মানুষজন।

 

সম্প্রতি রাজধানীর কয়েকটি পাইকারি ও খুচরাবাজার ঘুরে দেখা যায়, গুটি স্বর্ণা, পাড়ি, বিআর আঠাশ, হাচকি নাজিরসহ মোটা চালের ৫০ কেজির বস্তা কিনতে ভোক্তাদের ২০০০  থেকে ২২০০ টাকা পর্যন্ত গুণতে হচ্ছে। মাস দুয়েক আগেও যা ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকায় পাওয়া যেত। বাজারে রোজার ঈদের পর থেকে মোটা চালের দাম কেজিতে ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকা করে বেড়েছে।

 

এ পরিস্থিতিতে বাজারে মোটা চাল ও চিকন চালের দামের ব্যবধান বর্তমানে খুবই সামান্য। চিকন চালের মধ্যে মিনিকেট চালের ৫০ কেজির বস্তা পাইকারি ২২০০ থেকে ২৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নাজিরশাইল (ভাল) ২৩০০ টাকা এবং জিরা নাজির ৫০ কেজির বস্তা ২২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

 

এদিকে টিসিবির হিসাবে সারা দেশের বাজারে সব মানের চালের দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে পাঁচ থেকে ছয় টাকা। ৫০ কেজির বস্তায় বেড়েছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। চাল নিয়ে মিলারদের চালবাজির কারণে বেড়েছে চালের দাম।

 

সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী এ বছর ছয় লাখ ২০ হাজার টন চাল সরবরাহ করার কথা থাকলেও বারবার সময় বাড়িয়ে এ পর্যন্ত তারা সরকারকে চাল সরবরাহ করেছেন মাত্র চার লাখ ৮০ হাজার টন। এখনও সরবরাহের বাকি এক লাখ ৪০ হাজার টন। এদিকে তারা বাজারে সরবরাহ না করা চালের সঙ্কট দেখিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করছে।

 

অন্যদিকে চালের দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের দাবি, সরকারের কিছু নীতির সুযোগ গ্রহণ করে চাতাল ও মিল মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে লাভ কম হওয়ায় তাদের ব্যবসাতেও ক্ষতি হচ্ছে। অচিরেই চালের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা বন্ধ করতে সরকারের প্রতি পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান তারা।

 

বাংলাদেশে এখন প্রায় সারা বছরই চাল উৎপাদন হয়ে থাকে। কিন্তু এই কার্তিক মাসে চালের সঙ্কট দেখা দেয়। এক সময় কার্তিকের মঙ্গার কথা শোনা যেত। চাল উৎপাদন বাড়ায় এখন আর মঙ্গার কথা শোনা যায় না। তবে এবার যে পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে তাতে মঙ্গা না হলেও সাধারণ মানুষের অনেক কষ্ট হবে।

 

এদিকে ধান চালের উৎপাদন, সরবরাহ, বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা পরিচালিত অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, নোয়াখালীর চৌমুহনী, ধান চালের অন্যতম উৎপাদন স্থল দিনাজপুরে এই অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে চমকপ্রদ সব তথ্য। তথ্যে জানা যায়, সিন্ডিকেড করে একটি চক্র চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।  এসব চক্রের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা অপরিহার্য।

 

তথ্য অনুযায়ী দেশে চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি ধান, গম ও চাল উৎপাদিত হয়েছে। সে হিসেবে বর্তমানে দেশের কোথাও ধান, চালের মূল্যবৃদ্ধির কথা নয়। বাস্তবে চালের কেজিতে গত এক মাসে বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। প্রতি বস্তায় চালের দাম বেড়েছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। সরকারি সংস্থা টিসিবিও সে কথাই বলছে।

 

অবশ্য এ নিয়ে এখন পর্যন্ত সরকারের অবস্থান পরিষ্কার এবং কঠোর। গরিবরা যেন কম দামে চাল পায় সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে  ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি’ হাতে নেওয়া হয়েছে। কর্মসূচির আওতায় ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণ করা হবে। এই চাল বিতরণে অনিয়ম রোধ করতে সরকারের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন চাল বিতরণে অনিয়ম সহ্য করা হবে না। এখন সরকারের প্রথম এবং প্রধান কাজ হবে ১০ টাকায় ঠিক মতো চাল বিতরণ হচ্ছে কি না তা তদারকি করা।

 

আর বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, চালের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এ বিষয়ে বলেছেন, কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহের যে প্রক্রিয়া সরকার শুরু করেছে, তা নিয়মিত চলবে।

 

এ ছাড়া ভারত থেকে চাল আমদানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপিত আছে, তাও বহাল থাকবে। ভারত থেকে চাল আমদানির শুল্ক হার কমানো হবে না। কারণ চালের কোনো সঙ্কট নেই। যারা বাজারে চাল সঙ্কট থাকার গুজব ছড়িয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ১০ টাকার চাল বিতরণ কর্মসূচিকে কোনোভাবেই বিতর্কিত ও দলীয়করণ করা যাবে না। এই কর্মসূচিতে অনিয়মের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

আজ মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে খাদ্যমন্ত্রী এ কথা বলেন।

 

সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, ১০ টাকার চাল বিতরণ কর্মসূচিতে অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে সরকার কড়া নজরদারি রেখেছে। অনিয়মের সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

 

একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, চলতি বছর ২৪ হাজার টন চাল বাড়তি উৎপাদন হয়েছে। বর্তমানে সরকারি গুদামে মজুদ আছে সাড়ে সাত লাখ টন চাল। পাইপলাইনে আছে আরো দেড় লাখ টন। সব মিলিয়ে প্রায় নয় লাখ টন। এরপরও বাজারে চালের দাম প্রতিনিয়তই বাড়ছে।

 

সরকার একথা চিন্তা করেই এ সময় গরিব মানুষের জন্য ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়ার একটা যুগান্তকারী উদ্যোগ নিয়েছে।

 

বর্তমান সরকারের ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি’র আওতায় ৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে ১০ টাকা কেজি দরে হতদরিদ্র মানুষের মাঝে চাল বিতরণ। সারা দেশের ৫০ লাখ হতদরিদ্র মানুষের মাঝে ১০ টাকা কেজি দরে চাল পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যেই ওই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রামের চিলমারিতে গিয়ে এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। সরকারের খাদ্যবান্ধব তথা খাদ্য নিরাপত্তা পরিকল্পনার এটা একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। সরকারের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।

 

কিন্তু সরকারের ওই উদ্যোগ মাঠে মারা যেতে বসেছে অসাধু ডিলার আর রাজনৈতিক অসাধুকর্মীদের জন্য। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, এই চাল বিতরণ নিয়ে প্রায় সারা দেশেই অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। বিস্ময়কর হলেও সত্য, দেশের বিভিন্ন এলাকায় চাল বিতরণের জন্য যে তালিকা করা হয়েছে তাতে উঠে এসেছে শিশু ও মৃত ব্যক্তির নাম। কেবল তাই নয়, গরিব মানুষের পরিবর্তে চাল পাচ্ছে স্বচ্ছল ব্যক্তিরা। আবার কোনো কোনো জায়গায় হতদরিদ্রদের তালিকা করাই শেষ হয়নি, চাল বিতরণ তো দূরের কথা।

 

পত্রিকার খবর বেরিয়েছে, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা মোহাম্মদপুর ইউনিয়নে হতদরিদ্রের তালিকায় আওয়ামী লীগ নেতার নামও আছে। শুধু ওই নেতাই নন, তার পরিবারের সবার নামেই হতদরিদ্রের কার্ড ইস্যু করা হয়েছে।

 

হতদরিদ্রের কার্ড আছে রানীশংকৈল উপজেলায় আওয়ামী লীগের এক নেতার নামেও। এ নিয়ে এলাকায় আলোচনার ঝড় উঠেছে।

 

এই অনিয়ম-বিশৃঙ্খলার সঙ্গে ডিলার ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জড়িত। কোনো কোনো জায়গায় ডিলারকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।

 

বাজারে চিকন চালের দাম অতটা বাড়েনি যেভাবে বেড়েছে মোটা চালের দাম। কিন্তু ১০ টাকা কেজি চাল সুষ্ঠু বিতরণ নিশ্চিত করা হলে সঙ্কট অনেকটা কেটে যাবে।

 

দেশের হতদরিদ্রদের জন্য ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণের যে অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে তা কোনোভাইে গ্রহণযোগ্য নয়। এর ফলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। যে করেই হোক এই অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি প্রকৃত অর্থে যারা গরিব তারা যেন স্বল্পমূল্যে চাল প্রাপ্তির মাধ্যমে উপকৃত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই। সরকারের কার্যকর উদ্যোগই পারে এর সমাধান দিতে। সরকারের উচিত, দ্রুত অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ অক্টোবর ২০১৬/রিশিত/রুহুল

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়