ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

দুটি দুঃস্বপ্নের দহন || নাসরীন জাহান

নাসরীন জাহান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৯, ১০ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুটি দুঃস্বপ্নের দহন || নাসরীন জাহান

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

রাতের কুয়াশায় ঘনীভূত হচ্ছে শীত। আর এই কব্জায় প্রকৃতির সবকিছু মুহ্যমান। বাতাসও বেগ হারিয়ে স্থির, কেবল নিজের গুটিশুটি হাড্ডিসার শরীরটা নিয়ে আধছেঁড়া লেপের ভেতর থেকে প্রায়ই থেকে থেকে কেশে উঠছে মমতা।
জনমের শীত পড়ছেরে... বেবাকের হাড্ডি চুইসা খাইব... উড়ে উড়ে কথাগুলো কানে আসে।
শীত অথবা অসুখ ব্যথার কামড়ে আজ রাত মমতা আর ছটফট করে না, নিথর পড়ে থেকে তার কেবলই মনে হয়, আজ রাতটা যেন আর ফুরাবে না। রাতের এত কালো রং আগে আর দেখে নি, সকাল হলেই বা কী? কী অপেক্ষা করছে সকালে তার জন্য? তার জীবনে রাতই কী সকালই কী?

না, সকালে দিনের জাগরণ দেখে নিজেকে ভুলে থাকা যায়। বহু বহু রাত গেছে তার সাজসজ্জা গান আর আলোকবর্তিকার মাঝে উন্মাতাল হয়ে। তখন তো দিনটাই ছিল তার কাছে রাত। বেহুঁশ ঘুমে পড়ে থাকত দিনভর, কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে ওঠার পর মমতা তো কোনোদিন ‘দিন’ দেখে নি। দিনের জাগরণ কী, ভুলতে বসেছিল। কিন্তু চোখের সামনে এই বাদুড় ঝোলা আঁধারে সেইসব উজ্জ্বল উন্মত্ততা না ভেসে কলজের মধ্যেই পেরেক ফুঁড়ে কেন এগিয়ে আসে শৈশব? কৈশোরের দিঘির জলে ঝাঁপ, শাপলা ডাঁটার মালা?

পুঁথির বই বেচত বাবা, তাতেই যত কাহিনি, লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ... যৌবনের প্রান্তে এসব কাহিনির ঘোরেই আচ্ছন্ন হয়ে পথ চলত সে।
শৈশবের সখা মনা এখন শহরে।
যখন শাপলা জলে মমতা সাঁতার কাটত মৎস্যকুমারীর মতো, বলত চল বাড়ি যাই, নাইলে মাইর খাইতে অইব, তখন শাপলা ফুলের মালাটা, যা জলে নির্ভার বসেই সে বানিয়েছিল, তা নিয়ে ওপরে আসত, মনার গলায় পরিয়ে দিত।
পিচ্চি মনা ফনফন করে উঠত, আমি কি মাইয়া...? বলে তাচ্ছিল্যে মালা ছুড়ে বলত, আইজ বাড়ি চল, কাইল আমরা অশোক বনে যামু, সেইখানে অনেক পাখি বাচ্চা দিছে।
মনা শহরে গেল কৈশোরে, চাচার ওখানে থেকে পড়াশোনা করতে।

মমতার আরও কিছু সখী থাকাতে মনার বিচ্ছেদ তেমন স্পর্শ করে নি মমতাকে। লাইলী মজনু পড়ার পর আরও না, যে তার শাপলা ফুলকে মরদাঙ্গীর কারণে তাচ্ছিল্যে ছোড়ে সে নিঃসীম প্রেমের প্রগাঢ়তার কী বুঝবে? তারপরও বুকের ভেতর অসীম বেদনার ভার। কেউ কি আসবে না তার প্রেম অস্তিত্বকে এক ফোঁটা নাড়িয়ে দিতে?
আচমকা যেন আসমানটায় বহুবর্ণা এক রঙধনু উঠে পুরো গ্রামটার রঙই দিল পাল্টে, বাতাসের মধ্যে মধু ঘি-এর ঘ্রাণ আর আচ্ছন্নতার মধ্যে সশব্দে শিরশির করে উঠল ঝাঁক ঝাঁক কবুতর, শহর থেকে এক্কেবারে জোয়ান সুন্দর হয়ে আসা এক ছেলে যখন তাকে রক্তিম করে দিয়ে জানাল, আমি মনা, তুই... তুমি মমতা? এত সুন্দরী হয়া গেছো?

আচমকা একগুচ্ছ শীত ঢুকে যায় অসাবধানতায়, কুঁকড়ে উঠে মমতা লেপটাকে টেনে তুলে মুখ ঢাকতে চায়। ঘুঙুরের শব্দ। তবলা ধিনাক ধিনাক... প্রথম দিন ঢুকে হাঁ হয়ে গিয়েছিল, এ কোন জগতে এসে পড়ল সে! সবগুলো মেয়েই কেমন আধনেংটা বেহায়ার মতো অকারণে হি হি করে। গ্রামে মনার সঙ্গে গোপনে প্রেমের সময়টা যেমন স্বর্গীয় গেছে, তার সঙ্গে পালিয়ে এখানে আসার পরও স্বর্গের ঘোরটা যাচ্ছিল না। এটা কি পুঁথি বর্ণিত কোনো প্রাসাদ? যেখানে বাইজিরা থাকে, সে কি এখানের রানী হবে? যখন মনা লাপাত্তা... আত্মায় একটু একটু করে শিশিরের মতো ডর জমছে, দৈত্যের মতো এক মহিলা বিশাল বপু’র কালো আধবয়সী এক টেকোর সামনে তাকে ফেলে বলল, একদম ফ্রেস মাল, চাইর গুণ বেশি দাম দিতে হইব।

কী, হচ্ছে কী এসব? মাথার মধ্যে নানা আশঙ্কার উল্লম্ফন! সে হতবাক হয়ে চোখ হাতড়ায়... মনা, মনা কই?
তার শৈশব-কৈশোর-যৌবনকে পিষে রক্তাক্ত করে লোকটি সশব্দে তার মুখ চেপে যে যন্ত্রণাকর ঘেন্না দিয়েছিল, বমি বমি বোধে মনে হয়েছে মমতার, মুখে শিশ্ন ঢুকিয়ে লোকটি তার মুখে যেনবা পেশাব করেছে।
শারীরিক সম্পর্ক এমন হয়? যেনবা বিশাল ট্রাকের নিচে পড়ে মমতা মুমূর্ষু হাত বাড়িয়ে শেষবারের মতো খোঁজে তার স্বপ্নকে, মনা... বাঁচাও।
ও তোরে এইখানে বেইচ্যা গেছে, তারে ভুইল্যা যা। না... না... আত্মার আর্তনাদ হিংস্র স্রোতের মতো কেবল ধাক্কা খেয়েছে চার দেয়ালের মধ্যে।
এরপরে ক’দিন নানারকম পুরুষ। মমতা নয়, তার শবটার ওপর দিয়ে পিষে গেলে দৈত্য নারী চুল ধরে তাকে খাড়া করায়, চড়া দাম দিয়া কিনছি কাস্টমার ভাগানির লাগ্যি? আয় আমার লগে। এরপর গলায় মদ ঢুকল, ব্লু ফিল্ম দেখে দেখে ‘সম্ভ্রম’ এর নাম হয়ে যেতে থাকল ‘বে-লজ্জা’ এর মধ্যেই শুরু হলো পুরুষ টানা কায়দাকানুন শেখা... হ্যাঁ... পৃথিবীতে যে কত রকম শিক্ষার কত জায়গা আছে, গ্রামে থাকলে কী মমতা এর ছিটেফোঁটা জানত?
বাবার পুঁথির শিক্ষায় আগুন জ্বলল, জীবন চলতে মমতা কত রকম মানুষকে যে দেখল, ব্যবসায়ী, মাস্তান, চাকরিজীবী, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, দেখতে যে যত ভদ্র সে শয্যায় তত বিকৃত। আশ্চর্য, এরা এক স্ত্রী নিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে সমাজে সম্মান নিয়ে বাঁচে কোন কায়দায়? হরিণিয়া... ও আমার হরিণিয়া... কঁকিয়ে কঁকিয়ে যেন জীবনে শেষবারের মতো কাঁদতে চায় মমতা।
ভেঙে পড়তে থাকা আত্মা আর দেহ নিয়ে তার এই আকুল ডাকময় কান্না শুনতে শুনতে সবার কান পচে গেছে।

অন্ধকার জগতে ফুটফুটে মেয়েটির জন্ম হলে ফের এক নদী ভাঙনের শব্দ মমতাকে চুরচুর করতে থাকে, সে পা ধরে দৈত্য নারীটির, একে আমি আমার কাছ থেকে দূরে পাঠায়া বড়ো করমু, কাস্টমার দিনে ডাকলেও যামু, অরে পড়ামু, বেশ্যা অইতে দিমু না।
দৈত্য নারীরও মন আছে, মমতা জানল। মেয়ের পাঁচ বছর বয়সে সে ভদ্র শাড়ি পরে পরিপাটি হয়ে মেয়ের কান্নার শব্দ দাবিয়ে দূর শহরের হোস্টেলে তাকে দিয়ে এল।
বছরে দু’বার সে যেত, মেয়ের হাজার আবদার বিস্ময়কর প্রশ্নেও মেয়েকে তার কাছে আনত না।


তুমি কি ঘুমাচ্ছ?
এত রাতে তুমি? সব ঠিক আছে তো?
না না, তেমন কিছু হয় নি। আমার ঘুম আসছে না।
আমারও না, এত কাজ।
তুমি পারোও বুনো, কাঠফাটা শীত পড়েছে বাইরে, একটি কুকুরও জেগে নেই; এ সময়...।
বেশি শীত? কী জানি, কাজের ঘোরে টের পাচ্ছি না।
তোমার ঘরে তো হিটার চলছে, সরি, বিরক্ত করে থাকলে রাখলাম।
আরে না না... আমিও আসলে কালকের একটা ফিচার লেখা নিয়ে ভাবছিলাম। পত্রিকার কাজ জানই তো... তো-কী করলে তোমার ঘুম হবে?
আসলে তোমাকে একটা কথা বলতে চাইছি, দিনভর এ নিয়ে ভেবেছি জানো বুনো, এত অস্থির আছি, বলতেই পারছি না।
তুমি প্রায়ই তোমার অস্থিরতার কথা বলো, আমি সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করলে অন্য গল্প ফেঁদে বসো, এত রাতে আজ যদি আবার-

মিহি দেখে জানালা ধেয়ে আসছে নীল আলো, তার বুকের মর্মরে লবণাক্ত জল নোঙ্গর ফেলে আছড়ায়, যত দিন যাচ্ছে তত অনুভব করছে সে ক্রমশ বুনোর আত্মার সঙ্গে নিজেকে প্রোথিত করছে। আর এতেই ছিল তার রাজ্যের ভয়। তারই এক ভার্সিটির বান্ধবী রিয়ার সোর্সে বুনোর সঙ্গে তার পরিচয়। রিয়ার প্ররোচন-তাড়নায় ইন্টারমিডিয়েট দিয়ে যখন উন্মাতাল দিনগুলো চলছিল কখনো কোনো অভিজাত হোটেলে কখনো খুবই ব্যক্তিগত সোর্সে কোনো বর্ণাঢ্য বাংলোতে যন্ত্রণার অলীক সিঁড়ি দিয়ে কোত্থেকে কোথায় গড়াচ্ছে অনুভব করতেই চাইত না সে। বুনো তাকে ক্রমশ জীবনের অন্য এক মোড়ের দিকে নিতে থাকে। রিয়াও এই কাজ করেই নিজ পড়াশোনা চালায়, বাড়িতে টাকা পাঠায়। এখানে রিয়ার সূত্রেই শিখতে হয়েছে অন্য কায়দা। কারও শয্যায় তুমি যত উষ্ণতার নাটকই করো না কেন বাইরের পৃথিবীতে চলতে হবে নিজেকে সরল রহস্যঘেরা হেঁয়ালী নারী হিসেবে। কারণ এ কাজ করতে করতে যে ছেলানপনা এসে যায় সত্তায়, তার আঁচটুকু যেন কেউ না পায়।

কীভাবে চলো তুমি?
বুনোর এই প্রশ্নে মিহি বলেছিল, এখানকার কিছু বাচ্চা আসে আমার কাছে পড়তে।
কেন অনার্স এম.এ’টা করছ না?
ইন্টারমিডিয়েটের আগে আগে আমার আজব এক রোগ হলো, আমি অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতাম। দেখতাম আমি মা’র গর্ভ থেকেই মৃত জন্ম নিয়েছি, কখনো দেখতাম আমার মা ডাইনি বুড়ির মতো আমার চারপাশে চক্কর খাচ্ছে আর আমাকে গিলে খাওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছে। আমি এদিকে পালাচ্ছি ওদিকে পালাচ্ছি।
তোমার বাবা-মা একই রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে বলেছ, তবে কেন মা স্বপ্নে এই চেহারায় আসত! স্বপ্নে বাবা আসত না কেন?
সেটাই তো রোগ। স্বপ্নে মা উল্টো চেহারা নিয়ে আসত, বাবা কেন আসত না এর অর্থ বুঝতাম না। খুব ছোটবেলার ঘটনা। বাবা-মা’র মৃত্যুর পর নানু হোস্টেলে পাঠিয়ে দিল। তার খরচেই পড়তাম। একসময় নানুর মৃত্যু হলো।
তোমার দাদা-দাদির পরিবার আত্মীয়রা?
বাবা-মা’র জীবন বাস্তবতায় বিস্তর ব্যবধান থাকায় এই জীবনে কাউকে দেখা হয় নি আমার? উহ্!
মাথা ধরে যায় তুমি এত প্রশ্ন করো? কেউ নেই পৃথিবীতে আমার। তোমার তো স্বচ্ছল পরিবার, জার্নালিজম পাস করেছ, এত প্রপার্টি ক্যারিয়ারের পেছনে লেগে থাকার জাগতিক ভুতুরে তাগিদ নেই। তোমার কুয়াশা কেটে গিলে খায় হিটারের জিভ... হাঃ হাঃ।

টাকা নিয়ে খোঁচা দিও না ভাল্লাগে না। আমার বাবার প্রপার্টি থাকাটা আমার কোনো অপরাধ হতে পারে না নিশ্চয়ই। তুমিই বলো আমি কখনো আমার অর্থের উষ্ণতা তোমাকে দেখিয়েছি?
আহা, সব অত সিরিয়াসলি নাও কেন? যাহোক আমার পরীক্ষার সময় স্বপ্নগুলো এত ভয়ঙ্করভাবে আসতে লাগল মনে হতো যেন বা সত্যিই আমি কোনো অন্ধকার চক্করে পড়েছি। যথারীতি রেজাল্ট খারাপ হলো, তখন রিয়া পাশে না থাকলে আমি হয়তো মরেই যেতাম।
রিয়ার সঙ্গে তোমার পরিচয় কীভাবে এতটুকু জানতে পারি?
আমরা একই স্কুলে পড়তাম, আজ ও ভার্সিটিতে আর আমি ওর জাস্ট বন্ধু, জাস্ট রুম পার্টনার, পড়তে বসলে অক্ষরগুলি দৈত্যের মতো আমাকে গিলতে আসে বলে আর এগুতে পারছি না।
এরপর নিরন্তর বুনোর সঙ্গে কথোপকথনে তাকে অন্তত গ্রাজুয়েট করতে বুনো যত উঠেপড়ে লাগে, তার সৌন্দর্য সরলতার প্রশংসায় মুখর হয়, ততবার তার মনে হয়েছে তার জীবনের এই অন্ধকার অধ্যায়ের কথা বুনোকে বলে দেয়। কিন্তু যতবারই পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ‘তোমার সঙ্গে আমার সিরিয়াস কিছু বলার আছে’ বলে ও শুরু করতে চায়, ততবারই বুনোকে হারানোর ভয় মনে চেপে বসে। এ কারণে ভীত মিহি কখনো বলেছে, রাতে স্বপ্নে দেখেছি আমি মরে ভূত হয়ে তোমার পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আবার কখনও বলেছে, এক জ্যোতিষী বলেছে, আমি আমার প্রেমিকের হাতে মারা যাব। আমার প্রেমিক কে বলতে পারো বুনো? এইসব কথোপকথনের ধূম্রজালে বুনোর মনকে জায়গা থেকে জায়গায় উড়িয়ে নিয়েছে সে।

আজ রাতটার নিকষ শীত আর সন্ধ্যায় বলা বুনোর কথার গুঞ্জরণ তার নিখিল ঘূর্ণিময় করে তোলে। তোমাকে ভালোবাসি মিহি, আমি জানি তুমিও আমাকে, তোমার চোখে তা আমি দেখেছি, তারপরও তোমার মুখে শুনতে চাই, বলবে?
আচমকা প্রেম শিহরিত মিহি কেঁপে উঠেছিল ভয়ে। দেহটাকে এক-এক রাত এক-একজনের নিচে বিছিয়ে যত না ছেনালিপনা নাটকে, যত না শরীর ঘেন্নার, তার চাইতে হাজার গুণ জন্মের প্রতি ঘৃণার ধিক্কারে যেভাবেই দিয়েছে তাতে সে তো ‘বেশ্যা’ সম্বোধন থেকে মুক্তি পাবে না। সে তো ত-ই। এক কল্লোল গভীর স্রোত উষ্ণতায় লেপের নিচে তার দেহ যত জলদি উষ্ণ হয় তার চাইতে দ্বিগুণ ভয়ে বরফ হয়ে আসে।
নাহ্! তার জীবনের অবিশ্রান্ত আঁধার থেকে তার মুক্তি নেই।
কী? ধরে ফেলেছি না? বুনোর কণ্ঠে চমকে উঠে মিহি। কিছু গল্প ফাঁদতে চেয়েছিলে, কিছু স্বপ্ন, অথবা এত যেহেতু ইতস্তত করছ, আমার প্রেম প্রস্তাব নিঃশব্দে গ্রহণ করেছ ঠিকই কিন্তু প্রস্তুতি থাক সত্ত্বেও এক্ষুনি জানানোর ব্যাপারে দ্বিধা, তাই-ই না? রিলাক্স মিহি, আমি কোনো তাড়া দিয়েছি? তুমি ঘুমাও লক্ষ্মী, আমি ফিচারটা শেষ করি।

যেন হাঁপ ছেড়ে ঘুটঘুটে রাতে বাঁচার আসমান পায় মিহি। পাশের বেডে মৃদু নাক ডাকছে রিয়া, যত দিন যাচ্ছে তত দুজন সাবধান হচ্ছে, রোজ দেহ কাজে যাওয়ার তো প্রশ্নই নেই, বিশ্বস্ত সূত্রে হিসেব-নিকেশ করে যায়। এতে উপার্জন কম, তাতে কী, রিয়ার ভয় ভার্সিটিতে যেন এর আঁচ না ছড়ায়। মিহির ভয় বুনোকে নিয়ে, তার সাংবাদিক জগত নিয়ে। মিহি অতল আঁধার থেকে নিজেকে টেনে তুলে কণ্ঠে তরঙ্গ ঢেলে প্রশ্ন করে বুনোকে, তা তোমার ফিচারটা এবার কী বিষয়ে?
দারুণ! বুনো উচ্ছ্বসিত হয়, তুমি আমার ফিচার সম্পর্কে জানাতে চাইলে। পত্রিকায় পড়ে যে প্রতিক্রিয়া দাও তার মজা আলাদা, কিন্তু যখন লিখি, তখন তুমি কী নিয়ে লিখছি জানতেই চাও না বলে এদ্দিন আমার একটা গোপন কষ্ট ছিল আজ...।

বুক থেকে যেন হিমালয় ঝরে পড়ে। ঝরঝরে কানে সে উদগ্রীব হয়ে থাকে বুনোর কণ্ঠ শোনার জন্য। বুনো একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে এ কী পড়ছে? গ্রামের কিশোরী মমতা, মনা নামের একজনকে শাপলার মালা পরিয়েছিল। এরপর এক-এক করে সেই মমতার প্রবল প্রেমে প্রতারণা, পৈশাচিকতার তলায় রোজ ধর্ষিত হওয়া... একসময় তার কন্যা হলো।
এইচএসসি পাস করে সেই কন্যা যখন খোঁজ লাগিয়ে শহরে এসে মাকে এই পেশায় দেখল, রাগে ঘেন্নায় মা’র মুখে থুথু দিয়ে সে তার সঙ্গে জেদ করে মা’কে আরও রক্তাক্ত কষ্টে ডুবিয়ে নিজেকে ভাসিয়ে দিল দেহ ব্যবসায়। যে পেশায় মেয়ে বড় হতে পারে ভয়ে মা চোখে আঁধার দেখত, আজ মা এই একটি জায়গায় জীবনের সবচাইতে বড় চোট খেয়ে রীতিমতো ধসে পড়েছে।

বাকরুদ্ধ মিহির স্তব্ধ চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল টপটপ করে- মা, এই অবস্থার শিকার হয়ে? আর সে কি না?
কী ভেবেছিল মিহি? মা শখ করে এই পথে? না না কিছুই তলিয়ে ভাবে নি সে। মা’র কাজটা তাকে দিশাহীন শূন্যতায় ঠেলেছিল জাস্ট।
এসব তো হরহামেশা ঘটে, বুনো বলে, তুমি এত চুপ মেরে গেলে যে? যাহোক, আমি ফিচারটা এর পরের টুইস্ট-এর জন্যই লিখেছি। মেয়েটা একটু জানতে চাইল না কেন মা এই পথে? তার অতীত খোঁজ না নিয়ে তার কন্যাও নিজেকে শত শত পুরুষের তলায় বিছিয়ে দিল? সে অন্য কোনো পথ পেল না? জিপিএ ফাইভ পাওয়া একটা শিক্ষিত মেয়ে একটুও বুঝল না কত সন্তর্পণে তার মা একটা অন্ধকার পৃথিবী থেকে দূরে রেখে তাকে মানুষ করার চেষ্টা করে গেছে। অশিক্ষিতের মতো মা’র সাথে জেদ করে মা’কে জব্দ করতে তারও এই একই কুৎসিত পথ বেছে নেওয়া? ছিঃ! এসবই আমি ওদের মাসির কাছ থেকে শুনেছি। রিপোর্টার না, একজন মানুষ হিসেবে আমি বলি, জানো মিহি, মমতা এখন কঠিন এইডস রোগে ভুগছে, পড়ে থাকে এক কোণায়, তার মুমূর্ষু কণ্ঠে কেবল একটাই ডাক, হরিণের মতো চোখ ছিল বলে যার নাম রেখেছিল হরিণিয়া...। জানো মমতার প্রতি আমার যত মায়া তার কন্যার প্রতি আমার তেমনই ঘেন্না- বুনোর কণ্ঠ উত্তপ্ত শোনায়।

মিহির প্রস্তর ভেঙে পড়ে। কঠিন শীত আঁধারের প্রান্তর ধরে ছুটতে ছুটতে একসময় সে মা’র ওমে গিয়ে কাতরায়, মা’র মৃদু নড়তে থাকা হাত চেপে সশব্দে ঘুমন্ত চরাঞ্চাল জাগিয়ে চিৎকার করে- আমিই হরিণিয়া, একদা এক দেবীর কন্যা ছিলাম, এখন শুধুই বেশ্যা, বেশ্যা।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ জুলাই ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়