ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

দুদকের স্বাধীনতা খর্ব করেই মানি লন্ডারিং অধ্যাদেশ

এম এ রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:১৬, ১৩ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুদকের স্বাধীনতা খর্ব করেই মানি লন্ডারিং অধ্যাদেশ

এম এ রহমান : অবশেষে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) স্বাধীনতা খর্ব করে সংশোধিত মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর অধ্যাদেশ জারি করা হলো।

 

লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয় বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক স্বাক্ষরিত গেজেটে এ বিষয় নিশ্চিত করা হয়েছে। যেখানে সংশোধিত মানি লন্ডারিং আইনের খসড়া প্রস্তাবের অনেকটাই বাস্তবায়িত হয়েছে। আর এ আইন পাশের মধ্য দিয়ে দুদক আইনগতভাবে পরাধীন কমিশনে পরিণত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এ আইনের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ২(ঠ) বিলুপ্ত করে সংশোধনী আইনে ঠ-এর (অ)(আ) উপ-ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে।

 

২(ঠ) তে বলা হয়েছে, তদন্তকারী সংস্থা বলতে দুদক আইন ২০০৪ এর অধীনে গঠিত একমাত্র দুদকেই বোঝাবে। তবে কমিশনের নিকট হতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত অন্য কোনো তদন্তকারী সংস্থার কর্মকর্তাও ইহার অর্ন্তভুক্ত হবে। কিন্তু ওই ধারা বিলুপ্ত করে উপধারা (অ) যুক্ত করা হয়েছে, যেখানে তদন্তকারী সংস্থা হিসেবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও উপধারা (আ) অনুসারে সরকারের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত এক বা একাধিক তদন্তকারী সংস্থার কথা বলা হয়েছে।

 

সংশোধিত আইনের কোথাও দুদকের কথা বলা হয়নি। অর্থাৎ দুদক মানি লন্ডারিং বিষয়ে কাজ করতে হলে বিএফআইইউ থেকে অনুমতি সাপেক্ষে কাজ করতে হবে। বিষয়টি একদিকে যেমন দুদকের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ, অন্যদিকে হাস্যকরও বটে।

 

দুদক একটি স্বাধীন কমিশন হওয়া সত্ত্বেও সংশোধিত নতুন আইনে প্রতিষ্ঠানটিকে একটি সরকারি তদন্ত সংস্থা কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ তদন্ত করতে হবে, যা দুদকের বিদ্যমান আইনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও স্বাধীনতার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ।

 

অধ্যাদেশ সূত্রে আরো জানা যায়, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর সংশোধিত আইনের ধারা ৯ বিলুপ্ত করে ধারা ৯ এর অধীনে চারটি উপধারা সংযুক্ত করা হয়েছে। যেখানে (১) উপধারায় দুদক আইনে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কথাটি বাদ দিয়ে তদন্তকারী সংস্থা হিসেবে ২(ঠ) অনুসারে পুলিশ ও বিএফআইইউ কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত এক বা একাধিক তদন্তকারী সংস্থার কথা বলা হয়েছে।

 

একই সঙ্গে ধারা ৯ তে নতুন করে উপধারা (৪) সংযুক্ত করা হয়েছে। যেখানে তদন্তকারী সংস্থা এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধ অনুসন্ধান বা তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টি বিএফআইইউকে অবহিত করার কথা বলা হয়েছে।

 

অর্থাৎ অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্পত্তির অনুসন্ধান দুদক আইন ব্যবহার করে দুদক ছাড়াও অন্যান্য সংস্থা করতে পারবে। এ ধরনের সংশোধনীতে দুদকের স্বাধীনতা তো থাকছেই না, বরং দুদককেই বিএফআইইউয়ের অধীন করে দিয়েছে, যা দুদকের বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

 

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ২০১২ এর ১২ ধারার (১) ও (২) উপধারায় বলা হয়েছে, দুদকের অনুমতি ব্যতিরেকে কোনো আদালত এ আইনের অধীন কোনো অপরাধে বিচারার্থ আমলে গ্রহণ করবেন না। কিন্তু এখানেও একই প্রক্রিয়ায় সংশোধিত আইনে দুদকের ‘পূর্বে’ সরকার শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ এ আইনের অধীনে বিচারের জন্য দুদক অথবা সরকারের অনুমতি নিতে হবে। এখানেও কমিশনকে পাশ কাটানোর পাশাপাশি কমিশনের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

 

অথচ দুদক আইন ২০০৪ এর ৩(২) ধারাসহ একাধিক ধারায় দুদককে একটি স্বাধীন সংস্থা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ওই আইনের এর ২০(১) ধারায় বলা হয়েছে, এ আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধ কেবল কমিশন কর্তৃক তদন্তযোগ্য। এ আইনের ২৪ ধারায় কমিশনারগণ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন।

 

কিন্তু মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর সংশোধনী প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত হওয়ার মধ্য দিয়ে কমিশনের ক্ষমতা খর্ব হওয়ার পাশাপাশি দুদকের স্বাধীনতা নস্যাৎ হলো। এর ফলে দুদক আইনগতভাবেই পুরোপুরি নখদন্তহীন বাঘে পরিণত হলো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

এ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমি সংশোধিত আইনের গেজেট এখনো হাতে পাইনি। তবে আপনার কাছ থেকে যেটুকু শুনলাম রীতিমত আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে।’

 

তিনি রাইজিংবিডির কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘সরকার সব কিছু করলেই তো হয়। আমাদের দরকার কী? স্বাধীন কমিশনের পাশাপাশি সরকার বিষয়টি বোধগোম্য নয়। দুদক আইনে কমিশন একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। আমরা এত দিন ওই আইন অনুসারেই কাজ করছি। এখন নতুন সংশোধিত আইন অনুযায়ী দুদকের স্বধীনতা বলে কিছু থাকবে না।’

 

এই সংশোধনের বিষয়ে আদালতে যাবেন কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা তো সরকারের বিরুদ্ধে যেতে পারি না। তবে নিশ্চয়ই অন্য কেউ জনস্বার্থে আদালতে যাবেন। সেখানে আমাদের নৈতিক সমর্থন থাকবে।’

 

এর আগে চলতি বছরের ১৭ আগস্ট মানি লন্ডারিং আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়। এরপরই সংসদকে পাশ কাটিয়ে অধ্যাদেশ জারি করতে মন্ত্রিপরিষদ থেকে ৫ অক্টোবর অনুমোদন নেওয়া হয়। সংবিধানের ৯৩ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হলো।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ অক্টোবর ২০১৫/এম এ রহমান/শফিক/সাইফুল

 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়