ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

দেশে ইয়াবার ভয়াবহ আগ্রাসন

রুবেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১৮, ২৬ এপ্রিল ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দেশে ইয়াবার ভয়াবহ আগ্রাসন

সুজাউদ্দিন রুবেল, কক্সবাজার : মরণ নেশা ইয়াবার ভয়াবহ আগ্রাসন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। সীমান্ত দিয়ে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে প্রতি মাসে ১৫০ কোটি টাকার ইয়াবা আসছে দেশে। এই ইয়াবা পৌঁছে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। 

 

আইনপ্রয়োগকারি সংস্থার তথ্য মতে গত ৩ মাসে শুধুমাত্র কক্সবাজার থেকে ২০ লক্ষ ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়েছে। টাকার অংকে এই ইয়াবার মূল্য প্রায় ৬০ কোটি টাকা।

 

আইনপ্রয়োগকারি সংস্থার তথ্য মতে সাম্প্রতিক সময়ে ইয়াবা পাচারের হার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও ইয়াবার বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে।

 

সীমান্ত এলাকার একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে ইয়াবা চোরাচালানে বাংলাদেশ থেকে প্রতিমাসে গড়ে ১৫০ কোটি টাকার বেশী অর্থ মিয়ানমারে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বিপুল পরিমাণ অর্থ অবৈধ পথে পাচার হওয়ায় প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়ন প্রতিদিনই বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশী এক টাকার বিপরীতে মিয়ানমারের মুদ্রা বিনিময় হার ১৩ কিয়েতের নিচে নেমে এসেছে। মাত্র দুই বছর আগেও এই মুদ্রা বিনিময় ব্যবধান ছিল ১৮ টাকার বেশি।

 

সূত্র জানায় সীমান্তের অন্তত ৪০টি পয়েন্টে প্রতিদিন দুই লক্ষ ইয়াবা বাংলাদেশে আসছে। টেকনাফে ‘আর-৭’ ব্রান্ডের একটি ইয়াবা ট্যাবলেটের দাম ৩০০ টাকা এবং ‘ডাব্লিউ ওয়াই’ ব্রান্ডের প্রতিটি ইয়াবা ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 

 

টেকনাফে বিজিবির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন- সীমান্তের ওপারে মংডু এলাকায় অন্তত ৩০টি কারখানায় ইয়াবা তৈরি হচ্ছে। মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সঙ্গে পতাকা বৈঠকে এই বিষয়ে বারবার অবহিত করা হলেও তারা বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছে। বিজিবি সূত্র জানায় মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষীরা ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ায় সীমান্তে মাদক চোরাচালান দমন সম্ভব হচ্ছে না।

 

ইয়াবা পাচারে জড়িতদের হালনাগাদ তালিকায় জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, ছাত্রনেতা, সাংবাদিক, কর্মচারি, পুলিশসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার ৭৬৪ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

 

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের যুগ্মসচিব ও পরিচালক (অপারেশন ও গোয়েন্দা) প্রণব কুমার নিয়োগী স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে ইয়াবা পাচারে ৭৬৪ জনের তালিকা সংযুক্ত করে ভয়ঙ্কর এই মাদক প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে ইয়াবা প্রতিরোধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, টাস্কফোর্স অভিযান জোরদার করার কথাও বলা হয়েছে।

 

ইয়াবা তালিকায় টেকনাফ সীমান্ত এলাকায় সাত প্রভাবশালীর নাম রয়েছে। এদের ইয়াবা গডফাদার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সম্প্রতি সীমান্ত এলাকায় আইনপ্রয়োগকারি সংস্থার সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে ইয়াবা পাচারকারি ছয় জন নিহত হওয়ার পর প্রভাবশালী গডফাদারদের অনেকে আত্মগোপনে চলে গেলেও গডফাদারদের ছত্রছায়ায় আরো অনেকে ইয়াবা ব্যবসা করছে।

 

সীমান্তের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে- বাংলাদেশী জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ব্যাপক হারে চোরাই পথে মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে। অন্যদিকে মিয়ানমার থেকে দেশে আসছে মরণ নেশা ইয়াবা। উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তের প্রায় ২০টি পয়েন্টে প্রতি মাসে কোটি টাকার ওষুধ পাচার হচ্ছে।

 

একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, ওষুধ পাচারে সীমান্তের বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে নামীদামি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা জড়িত। টেকনাফে প্রতিষ্ঠিত একজন ওষুধ ব্যবসায়ী জানান, যে সব কোম্পানি ওষুধ পাচারে জড়িত তারা নিজস্ব গাড়িতে ওষুধ সরাসরি সীমান্তে পৌঁছে দিচ্ছে।

 

অন্যদিকে একই গাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে ইয়াবা। নামিদামি এই কোম্পানিগুলো সীমান্ত এলাকায় চাহিদার অতিরিক্ত ওষুধ সরবরাহ করছে। এই ওষুধ পাচার হয়ে যাচেছ মিয়ানমারে। ওই ব্যাবসায়ী জানান, উখিয়া এবং টেকনাফের মতো ছোট দুটি উপজেলায় কোম্পানিগুলো যে পরিমাণ ওষুধ সরবরাহ দিচ্ছে, দেশের বড় কোনো জেলায়ও তার এক তৃতীয়াংশ ওষুধ সরবরাহ করা হয় না। টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারে ওষুধ পাচারকালে এর আগে ওষুধ কোম্পানির একাধিক কর্মচারী আটক হয়েছে।

 

এ ছাড়াও বাংলাদেশী সিমেন্ট, লোহা, অ্যালুমোনিয়াম সামগ্রী ও বিভিন্ন প্রকার খাদ্য পাচার হয়ে মিয়ানমারে যাচ্ছে। বিনিময়ে মিয়ানমার থেকে আসছে মরণ নেশা ইয়াবা।

 

সূত্র জানায় টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়েও ইয়াবা নিয়ে আসছে চোরাচালানী সিন্ডিকেট। এই ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত রয়েছে স্থানীয় শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়- বন্দরের অপারেশন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছে বেসরকারি একটি সংস্থা। এখানে ইমিগ্রেশন ও কাস্টম কাজ করলেও পুলিশ-বিজিবির কোনো কার্যক্রম নেই। ফলে আমদানীকৃত মালামালের ভিতরে ইয়াবার চালান আসছে। জেলা টাস্কফোর্সের সভায়ও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

 

বিজিবির টেকনাফ ৪২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবু জার আল জাহিদ জানিয়েছেন, পণ্য খালাস যেখানে হয় সেখানে বিজিবির কোনো লোকজন নেই। জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বন্দরের ওই বিভাগে বিজিবি মোতায়েনের একটি প্রস্তাব উঠলেও তা কার্যকর হয়নি। তিনি জানান, এরপরও বিজিবি বন্দরের বাইরে থেকে নজরদারি করছে। 

 

বেড়েছে সমুদ্রপথে ইয়াবা পাচার : সমুদ্র পথে মাদক চোরাচালান এখন আশঙ্কাজনকবাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। টেকনাফের সাবরাং, বাহারছড়া, উখিয়ার মনখালী, মহেশখালীর সোনাদিয়া, ঘটিভাঙ্গাসহ কয়েকটি পয়েন্ট, পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া ও মগনামা এবং কুতুবদিয়া উপকূল পথেও মাদকের চালান খালাস হচ্ছে। অন্যদিকে চট্টগ্রামের বাশঁখালী, আনোয়ারা, গহীরা ও পতেঙ্গাসহ আরো কয়েকটি পয়েন্টে মাদকের চালান খালাস হচ্ছে। মাছ ধরার ট্রলারের ছদ্মবেশে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ইঞ্জিন বোটে করে চোলাচালানী চক্র মাদকের চালান নিয়ে আসছে।

 

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে কক্সবাজার এবং চট্টগ্রামের ৩৬ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি সমুদ্র পথে মাদক চোলাচালান ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। মাদক চোরাচালানের মাধ্যমে এরা এখন কোটি কোটি টাকার মালিক।

 

সরেজমিনে ঘুরে এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্ত এলাকার হাজারের অধিক তরুণ তরুণী মাদক পাচারে জড়িত। এদের কেউ কেউ এখন রাতারাতি কোটিপতি। মাদক ব্যবসায় নেমে উখিয়া টেকনাফের অনেকে রাতারাতি কোটিপতি হয়েছেন। এদের অনেকে ঢাকা, চট্টগ্রামে ফ্ল্যাট কিনে ওখানে অবস্থান করে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে।

 

সূত্র জানায় টেকনাফ থেকে কক্সবাজার ও ঢাকার পথে তিন শতাধিক নারী ও শিশু ইয়াবা বহনের সঙ্গে জড়িত। উখিয়া টেকনাফের দুটি শরণার্থী ক্যাম্পেও তৎপর রয়েছে মাদক পাচারকারী চক্র। রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরাও এই কাজে নিয়োজিত হচ্ছে।

 

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লোকবল সংকট : কক্সবাজার অঞ্চলে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দুটি অফিসে লোকবলের তীব্র সংকট রয়েছ। বর্তমানে দুজন পরিদর্শক ও দুজন উপ-পরিদর্শক এবং ৯ জন মাত্র সিপাহী দিয়ে কক্সবাজার সদর, রামু ও টেকনাফে দপ্তরের কাজকর্ম চলছে।

 

কক্সবাজারে দায়িত্বরত মাদক নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের সহকারি পরিচালক হুমায়নি কবির খন্দকার বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকায় অভিযান পরিচালনার কথা চিন্তাই করতে পারি না। সমুদ্র বাদ দিয়ে স্থল ভাগে অভিযান চালানোর জন্য লোকবল এবং যানবাহন কোনটাই এই দপ্তরে নেই।’ তিনি জানান, পুলিশ এবং কোস্ট গার্ড বর্তমানে সমুদ্র পথে মাদক চোরাচালানের বিষয়টি দেখছে।

 

বিজিবি কক্সবাজারের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মো. খালেকুজ্জামান বলেছেন, মাদক পাচার রোধে উপকূলীয় এলাকায় বিজিবির টহল তৎপরতা বৃদ্ধি এবং মেরিন ড্রাইভ রোডে রেজু ব্রিজ এলাকায় একটি চেক পোস্ট বসানো হয়েছে। ইয়াবা পাচার রোধে কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের বিদ্যমান চেক পোস্টগুলোতে কঠোর নজরদারী রয়েছে। ইয়াবাসহ আটককারীদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজাও দেওয়া হচ্ছে।

 

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/কক্সবাজার/২৬ এপ্রিল ২০১৫/রুবেল/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়