ধর্ষণে ভারতীয় স্টাইল : নারীর অসহায়ত্ব
কামরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম
প্রতীকী ছবি
এস এস কামরুজ্জামান : বাংলাদেশে যৌন নির্যাতন শুধু যে এখনিই হয়, তা নয়। আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে। কিন্তু ঘরে কিংবা বাইরে যৌন হয়রানির শিকার বেশিরভাগ নারী নিরবে সহ্য করে যান। মুখ খোলেন না সামাজিক বিড়ম্বনা ও লোক লজ্জার কারণে। দেশে নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে, সঙ্গে তাদের প্রতি সমর্মিতার সংখ্যাও।
কিন্তু কমেনি নারীর প্রতি সহিংস আচরণ, যৌন নির্যাতনের মতো ঘৃণিত সব কাজ। আমরা মুখে নীতিবাক্য ও নারীদের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বললেও মননে আমাদের এর কোনো পরিবর্তন নেই। আর এ কারণেই হয়তো আমরা ভারতের স্টাইলে রাজধানীতে চলন্ত গাড়িতে দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনা দেখতে হলো।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- আমরা কি প্রতিবেশী বন্ধুপ্রতীম দেশ ভারতের কাছ থেকে অনুকরণ করছি, না দেশটির একের পর ভয়ংকর ধর্ষণের ঘটনা আমাদেরও ওপর প্রভাব ফেলছে?
ঘটনাটি ১৬ ডিসেম্বর ২০১২। ভারতের রাজধানী দিল্লিতে সিনেমা দেখে ছেলে বন্ধুর সঙ্গে বাসে করে বাসায় ফিরছিলেন। ছেলে বন্ধুকে বেঁধে চলন্ত বাসে গণধর্ষণ করে মারাত্মক জখম অবস্থায় রাস্তায় ফেলে রাখে বাসচলক বেশে থাকা দুর্বৃত্তরা। পরে সিঙ্গাপুরে মারা যান তিনি।
ঘটনাটি ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিন্দার ঝড় ওঠে। এই ঘটনার পর দেশটির নারী নির্যাতন আইন পরিবর্তন করা হয়। ধর্ষকেরা সর্বোচ্চ সাজাও পান। কিন্তু এরপরও দেশটিতে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এমনকি এরপরও রাজধানীতে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
গত বছর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে প্রতিদিন গড়ে ৯২ নারী ধর্ষণের শিকার হন। এ তথ্য জানায় ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)।
দিল্লি ধর্ষণের মতো বৃহস্পতিবার রাতে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটল রাজধানী ঢাকায়। অফিস থেকে ফেরার পথে গারো সম্প্রদায়ের এক তরুণীকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে চলন্ত গাড়িতে দলবেঁধে ধর্ষণ করে পাঁচ দুর্বৃত্ত।
চলন্ত বাসে নারী ধর্ষণের ঘটনা আমাদের দেশে এটাই প্রথম নয়। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মানিকগঞ্জে এক তরুণীকে চলন্ত বাসেই ধর্ষণ করে চালক ও হেলপার। তাদের গ্রেফতার করলেও এ মামলায় বিচারের আলো দেখেনি ভুক্তভোগী।
এমতাবস্থায় দেশজুড়ে বাড়ছে নারী নির্যাতনের ঘটনা। দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। নারী নির্যাতনের ঘটনায় জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল হেল্পলাইনে সারা দেশ থেকে মোট ৪৫২৬ জন সাহায্য-পরামর্শ চেয়েছেন। এর মধ্যে গত এপ্রিলে সর্বোচ্চ অভিযোগ এসেছে ১২২৮টি। বেশির ভাগ অভিযোগ যৌতুক এবং যৌন হয়রানিকেন্দ্রিক অভিযোগ।
আর এই অভিযোগের সূত্র ধরে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার থেকে গত চার মাসে চিকিৎসা সহযোগিতা পেয়েছেন ১১৪ জন, কাউন্সেলিং সহযোগিতা পেয়েছেন ১০০ জন, পুলিশি সহযোগিতা নিয়েছেন ২২১ জন, আইনগত ৭০৮ জন, নির্যাতন ও যৌন হয়রানি মোকাবিলার জন্য তথ্য-পরামর্শ নিয়েছেন মোট ৩ হাজার ৩৮৩ জন।(সূত্র মানব জমিন অনলাইন ২৩ মে, ২০১৫)।
নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ বাংলাদেশে ২০০০ সালে নারী নির্যাতন দমন আইন পাস করা হয়। সেই আইনের কিছুটা ফাঁকফোকর থাকায় ২০০৩ সালে সংশোধনী আনা হয়। এছাড়া পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরক্ষা ও সুরক্ষা) আইন-২০১৩ পাস করা হয়। কিন্তু এরপরও কমছে না যৌন ও নারী নির্যাতনের ঘটনা। শহুরে ও গ্রামীণ সব শ্রেণির নারীরা কোনো কোনোভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
অনেক পুরুষ ধর্ষণের জন্য দায়ী করেন মেয়েদের। তাদের খোঁড়া যুক্তি, মেয়েদের পোশাকের কারণে পুরুষরা উত্তেজিত হয়। তবে তাদের ওই যুক্তির ঘোরবিরোধী আমি। অনেক বোরখা পরা পর্দাশীল নারীও পুরুষের রোষানলের শিকার হওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আবার ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার পরও অনেকে ধর্ষিত হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ধর্ষণকেই কেবল যৌন নির্যাতন নয়, টাচিং, ফন্ডলিং, যৌনাঙ্গ দেখানো, যৌনাঙ্গ স্পর্শ করা- এগুলোও যৌন নির্যাতন। লোকলজ্জার ভয়ে কেউই এগুলো নিয়ে কথা বলে না ভুক্তভোগীরা। মুখ বুঁজে সয়ে গেলে এর কোনো সমাধান নেই, প্রতিবাদে সোচ্চার হলেই কেবল এর প্রতিকার সম্ভব।
সবশেষ বলা যায়, কোনো দেশের মাধ্যমে আমরা তাদের সংস্কৃতি ধারণ করিনি। এটা আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম উদাহরণ। নারীর প্রতি প্রকৃত সহানুভূতি আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যৌন হররানি, ধর্ষণ রোধে কার্যকরী হবে। সর্বপরি নারী প্রতি সহিংসতা রোধে আইনের প্রয়োগ খুবই জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক ও মিডিয়া গবেষক।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ মে ২০১৫/কামরুজ্জামান/রাসেল পারভেজ
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন