ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

নজরুল-রবীন্দ্রনাথের প্রেমপত্র

কাজী আশরাফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০২, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নজরুল-রবীন্দ্রনাথের প্রেমপত্র

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

কাজী আশরাফ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সময় পেলেই চিঠি লিখতে বসতেন। তাঁর মতো এতো চিঠি আর কোনো কবি-সাহিত্যিক লেখেননি এটা প্রায় বলে দেয়া যায়। যদিও সে তুলনায় স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে তিনি খুব কমই চিঠি লিখেছেন। তার মধ্যে প্রেমপত্র একেবারে নেই বললেই চলে। সব চিঠিই কাজের কথায় ভরপুর। এর মধ্যেও সেখানে যে মাঝেমধ্যে প্রেম ফুটে ওঠেনি তা নয়। যেমন এই চিঠিটি। মৃণালিনী দেবীকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন : 

 

ভাই ছুটি

আজ আমার যাওয়া হয় নি সে খবর তুমি বেলার চিঠিতে পেয়েছ। বাড়িতে রয়ে গেলুম- ডাকের সময় ডাক এর খান তিনেক চিঠি এলো। অথচ তোমার চিঠি পাওয়া গেল না। যদিও আশা করিনি তবু মনে করেছিলুম যদি হিসাবের ভুল করে দৈবাৎ চিঠি লিখে থাক। দূরে থাকার একটা প্রধান সুখ হচ্ছে চিঠি- দেখাশোনার সুখের চেয়েও তার একটু বিশেষত্ব আছে। জিনিসটি অল্প বলে তার দামও বেশি- দুটো চারটে কথাকে সম্পূর্ণ হাতে পাওয়া যায়, তাকে ধরে রাখা যায়, তার মধ্যে যতটুকু যা আছে সেটা নিঃশেষ করে পাওয়া যেতে পারে। দেখাশোনার অনেক কথাবার্তা ভেসে চলে যায়, যত খুশি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় বলেই তার প্রত্যেক কথা নিয়ে নাড়াচাড়া করা যায় না। বাস্তবিক মানুষে মানুষে দেখাশোনার পরিচয় থেকে চিঠির পরিচয় একটু স্বতন্ত্র- তার মধ্যে এক রকমের নিবিড়তা গভীরতা এক প্রকার বিশেষ আনন্দ আছে। তোমার কি তাই মনে হয় না?

রবি

১৭ ডিসেম্বর ১৯০০

 

কবিগুরু আরেকটি চিঠিতে মৃণালিনী দেবীকে লিখছেন :

 

ভাই ছুটি

তোমার সন্ধ্যা বেলাকার মনের ভাবে আমার কি কোনো অধিকার নেই? আমি কি কেবল দিনের বেলাকার? সূর্য্য অস্ত গেলেই তোমার মনের থেকে আমার দৃষ্টিও অস্ত যাবে? তোমার যা মনে এসেছিল আমাকে কেন লিখে পাঠালে না? তোমার শেষের দু চার দিনের চিঠিতে আমার যেন কেমন একটা খটকা রয়ে গেছে। সেটা কি ঠিক এনালাইজ করে বলতে পারিনে কিন্তু একটা কিসের আচ্ছাদন আছে। যাক গে! হৃদয়ের সূক্ষ্মতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করাটা লাভজনক কাজ নয়। মোটামুটি সাদাসিধে ভাবে সব গ্রহণ করাই ভাল।

 

রবি

 

কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনে হঠাৎ করেই এসেছিলেন নার্গিস। কবির সঙ্গে তার বিয়ে নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক, কবি যে তার প্রেমে পড়েছিলেন এতে ভুল নেই। তার প্রমাণ এই চিঠি। নার্গিসকে কাজী নজরুল ইসলাম এই চিঠি লিখেছিলেন এবং এটিই ছিল কবির লেখা নার্গিসকে প্রথম ও শেষ চিঠি।

 

১ জুলাই ১৯৩৭

কল্যাণীয়াসু!

তোমার পত্র পেয়েছি সেদিন নববর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে। মেঘ-মেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল। পনের বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি বারিধারার প্লাবন নেমেছিল, তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পারো। আষাঢ়ের নব মেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার। ... যাক, তোমার অনুযোগের অভিযোগের উত্তর দিই।... তোমার ওপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা’ পোষণ করি না- এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কী গভীর ক্ষত, কী অসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি-তা দিয়ে তোমায় কোনো দিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না। আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যাণস্বরূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালোবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম, সের রূপ আজও স্বর্গের পারিজাত- মন্দারের মতো চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে। অন্তরের আগুন বাইরের সে ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি। তুমি ভুলে যেও না, আমি কবি, আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। ...আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কী জানো বা শুনেছ, জানি না) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোনো অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবিও নেই।

 

আমি কখনো কোনো ‘দূত’ প্রেরণ করিনি তোমার কাছে। আমাদের মাঝে যে অসীম ব্যবধানের সৃষ্টি হয়েছে, তার ‘সেতু’ কোনো লোক তো নয়ই- স্বয়ং বিধাতাও হতে পারেন কি না সন্দেহ।... তোমার ওপর আমার কোনো অশ্রদ্ধাও নেই, কোনো অভিযোগও নেই-আবার বলছি। আমি যদিও গ্রামোফোনের ট্রেডমার্ক ‘কুকুরের’ সেবা করছি, তবুও কোনো কুকুর লেলিয়ে দিই নাই।...যাক, তুমি রূপবতী, বিত্তশালিনী, গুণবতী, কাজেই তোমার উমেদার অনেক জুটবে- তুমি যদি স্বেচ্ছায় স্বয়ম্বরা হও, আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই। আমি কোন অধিকারে তোমার বারণ করব বা আদেশ দিব? নিষ্ঠুর সমস্ত অধিকার থেকে আমায় মুক্তি দিয়েছেন।

তোমার আজিকার রূপ কী, জানি না। আমি জানি তোমার সেই কিশোরী মূর্তিকে, যাকে দেবীমূর্তির মতো আমার হৃদয়বেদিতে অনন্ত প্রেম অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদি গ্রহণ করলে না। পাষাণ-দেবীর মতোই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদি-পীট।...আজকার তুমি আমার কাছে মিথ্যা, ব্যর্থ; তাই তাকে পেতে চাইনে।

 

দেখা? নাই-ই হলো এ ধূলির ধরায়! প্রেমের ফুল এই ধূলিতলে হয়ে যায় ম্লান, দগ্ধ, হতশ্রী। তুমি যদি সত্যিই আমায় ভালোবাস, আমাকে চাও, ওখানে থেকেই আমাকে পাবে। লায়লি মজনুকে পায়নি, শিরীন ফরহাদকে পায়নি, তবু তাদের মতো করে কেউ কারো প্রিয়মতকে পায়নি। আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরনো কথা হলেও পরম সত্য। আত্মা অবিনশ্বর, আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারে না। প্রেমের সোনার কাঠির স্পর্শ যদি পেয়ে থাকো, তাহলে তোমার মতো ভাগ্যবতী কে আছে? তারই মায়া স্পর্শে তোমার নকল কিছু আলোয় আলোময় হয়ে উঠবে। দুঃখ নিয়ে একঘর থেকে অন্য ঘরে গেলেই সেই দুঃখের অবসান হয় না। মানুষ ইচ্ছা করলে সাধনা দিয়ে, তপস্যা দিয়ে ভুলকে ফুলরূপে ফুটিয়ে তুলতে পারে। যদি কোনো ভুল করে থাকো জীবনে, তাহলে এই জীবনেই তার সংশোধন করে যেতে হবে, তবেই পাবে আনন্দ, তবেই হবে সর্বদুঃখের অবসান, নিজেকে উন্নত করতে চেষ্টা করো, স্বয়ং বিধাতা তোমার সহায় হবেন। আমি সংসার করছি, তবু চলে গেছি এই সংসারের বাধাকে অতিক্রম করে ঊর্ধ্বলোকে- যেখানে গেলে পৃথিবীর সকল অপূর্ণতা সকল অপরাধ ক্ষমাসুন্দর চোখে পরম মনোহর মূর্তিতে দেখা দেয়।

 

হঠাৎ মনে পড়ে গেল পনের বছর আগেকার কথা। তোমার জ্বর হয়েছিল, বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র সুন্দর ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল; তোমার সেই তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজও অনুভব করতে পারি। তুমি কি চেয়ে দেখেছিলে? আমার চোখে ছিল জল, হাতে সেবা করবার আকুল স্পৃহা, অন্তরে শ্রীবিধাতার চরণে তোমার আরোগ্য লাভের জন্য করুণ মিনতি। মনে হয় যেন কালকার কথা। মহাকাল যে স্মৃতি মুছে ফেলতে পারলেন না। কী উদগ্র অতৃপ্তি, কী দুর্দমনীয় প্রেমের জোয়ারই সেদিন এসেছিল, সারা দিন রাত আমার চোখে ঘুম ছিল না।

 

যাক আজ চলেছি জীবনে অস্তমান দিনের শেষ রশ্মি ধরে ভাটার স্রোতে। তোমার ক্ষমতা নেই সে পথ থেকে ফেরানোর। আর তার চেষ্টা করো না। তোমাকে লেখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক, যেখানেই থাকি, বিশ্বাস করো, আমার অক্ষয় আশীর্বাদ কবচ তোমার ঘিরে থাকবে। তুমি সুখী হও, শান্তি পাও এই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস করো আমি তত মন্দ নই-এই আমার শেষ কৈফিয়ৎ।

 

ইতি

নিত্য শুভার্থী

নজরুল ইসলাম

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়