ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

যেভাবে এল আধুনিক কম্পিউটার

মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৩, ১৩ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যেভাবে এল আধুনিক কম্পিউটার

প্রতীকী ছবি

মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম : উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণের সহজ দুইটি মাধ্যমে অ্যাবাকাস এবং ব্যক্তিগত কম্পিউটার (পার্সোনাল কম্পিউটার বা সংক্ষেপে পিসি)। উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণের কাজে ব্যবহৃত এই যন্ত্রদ্বয়ের মধ্যে অনেকটা সামঞ্জস্য থাকলেও ইতিহাসের পাতায় এই দুটো যন্ত্রের মধ্যে সময়ের পার্থক্য রয়েছে কয়েক হাজার বছরের।

 

এই নিবন্ধের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে যন্ত্র দুটোর মধ্যবর্তী সুদীর্ঘ পথপরিক্রমার কিছু মাইলফলক প্রত্যক্ষ করা। আজ জেনে নিন নিবন্ধটির শেষ অংশ।

 

 

দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রজন্মের আগমন
ক্ষুদ্রাকৃতি, দ্রুততা, ব্যাপক কম্পিউটিং সক্ষমতা ইত্যাকার বৈশিষ্ট্য নিয়ে কম্পিউটারের দ্বিতীয় প্রজন্ম শুরু হয় ১৯৫৯ সালে। উচ্চস্তরের প্রোগ্রামিং ভাষা ব্যবহারের ফলে যান্ত্রিক ভাষায় অ্যাপ্লিকেশন লেখার অভ্যাস পরিত্যক্ত হলো। অপেক্ষাকৃত কম স্থায়িত্বের ভ্যাকিউয়াম টিউবের পরিবর্তে নিবিড় সলিড-স্ট্যাট উপাদান যেমন ট্রানজিস্টরের ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে জন বারডিন, উইলিয়াম শকলে এবং ওয়ালটার ব্রাটেইন কর্তৃক বেল ল্যাবরেটরিজে ট্রানজিস্টরের উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল।

 

সমান্তরালভাবে ট্রানজিস্টর সমন্বয়ের ধারণা তৈরি এবং সার্কিটের মধ্যে অন্যান্য উপাদান সিলিকনের ক্ষুদ্র চিপে স্থাপন করা সম্ভবপর হওয়ায় দ্বিতীয়-প্রজন্মের সিস্টেমের উন্নয়নে এক নতুন শিল্পের উদ্ভব ঘটে। ১৯৫৫ সালে উইলিয়াম শকলি কর্তৃক তার নিজ শহর ক্যালিফোর্নিয়ার পলো অলটোতে এই শিল্পে শকলি সেমিকন্ডাক্টর প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। শকলির প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্মচারী অল্পসময়ের মধ্যে ফেয়ারচাইল্ড সেমিকন্ডাক্টর গঠন করতে চলে যায়। রবার্ট নয়েস নামক ফেয়ারচাইল্ডের দুজন প্রতিষ্ঠাতার একজন প্রথম সমন্বিত বর্তনীর (আইসি) উন্নয়ন করেন। ফেয়ারচাইল্ডের কর্মীরা এরপর অপর কয়েকটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। যেমন, নয়েস ছিলেন ইন্টেল কর্পোরেশনের প্রতিষ্ঠাতা। সেই থেকে প্যালো অলটোতে শকলির প্রতিষ্ঠানের সন্নিকটে সান্তা ক্লারা ভেলিতে এইসব কোম্পানি গড়ে উঠেছিল। পরবর্তী সময়ে এই এলাকা সিলিকন ভ্যালি নামে পরিচিতি লাভ করে।

 

তৃতীয় প্রজন্ম : দ্বিতীয়-প্রজন্মের সিস্টেমগুলো বরং বিশেষায়িত ছিল। তারা সিস্টেমগুলো তৈরি করেছিলেন হয় বৈজ্ঞানিক অ্যাপ্লিকেশন নয়তো অবৈজ্ঞানিক অ্যাপ্লিকেশন প্রক্রিয়াজাত করার জন্য কখনো উভয় পরিবেশে ভালোভাবে কাজ করার জন্য তৈরি হয়নি। সেই অবস্থার পরিবর্তন হয় ১৯৬৪ সালে যখন আইবিএম তৃতীয়-প্রজন্মের কম্পিউটার হার্ডওয়্যার সিস্টেম/৩৬০ পরিবারের মেইনফ্রেম কম্পিউটারের ঘোষণা দেয়। এই পরিবারের প্রতিটি প্রসেসরে বিল্ট-ইন নির্দেশাবলির বৃহৎ সেট ছিল যা নির্বাহ হতে পারতো। সেইসব নির্দেশাবলির মধ্যে এমন কিছু নির্দেশনা ছিল যা বৈজ্ঞানিক অ্যাপ্লিকেশন প্রক্রিয়াজাতকরণে বিশেষভাবে উপযোগী যেখানে অন্যগুলো ছিল রেকর্ড-কিপিং অ্যাপ্লিকেশনসমূহের জন্য অধিক উপযুক্ত। অতএব ৩৬০ প্রণালি দক্ষতার সঙ্গে উভয় পরিবেশেই ব্যবহৃত হতে পারতো। প্রসেসরের আরও উন্নত পরিবার ১৯৬৪ সাল থেকে প্রবর্তিত হতে থাকে। সম্মিলিতভাবে এইসব প্রসেসর চতুর্থ-প্রজন্ম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে এই শিল্প পরবর্তী বছরগুলোতে প্রজন্ম নির্ধারণে একমত হতে ব্যর্থ হয়।

 

১৯৬৫ থেকে ১৯৭৪
মিনিকম্পিউটারের উন্নয়ন : ১৯৬০ সালের প্রথমদিকের কম্পিউটার ছিল মেইনফ্রেইম। এসব কম্পিউটারের সকল প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা ছিল একটি কেন্দ্রীয় অবস্থানে যা একটি সংস্থার জন্য প্রয়োজন। এই পদ্ধতি কিছু প্রতিষ্ঠানের চাহিদা পূরণ করেছিল। কিন্তু অনেকের এই ধরনের বড় আকারের সিস্টেম যোগাড় করার সামর্থ্য ছিল না কিংবা তাদের এমন বিশেষায়িত অ্যাপ্লিকেশন ছিল যা এই ধরনের বৃহৎ এবং কেন্দ্রীভূত যন্ত্র কার্যকরভাবে প্রক্রিয়াজাত করতে পারতো না।
এই বৃহৎ, দ্রুত এবং কেন্দ্রীভূত পদ্ধতির দ্বারা সৃষ্ট শূন্যতা পূরণ করার জন্য স্বল্প-মূল্যের মিনি কম্পিউটারের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্টভাবে দেখা দেয়। বেশকিছু সংস্কারক এই প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন এবং মিনিমাল যন্ত্র উৎপাদনের জন্য ১৯৬০ সালে নতুন কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে বৃহৎ মিনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ইক্যুইপমেন্ট কর্পোরেশন সংক্ষেপে ডেক ১৯৬৫ সালে প্রথম মিনিকম্পিউটারের প্রসেসর তৈরি করে। অন্যান্য মিনি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যেমন হিউলেট-প্যাকার্ড এবং ড্যাটা জেনারেল খুব দ্রুত ডেক-এর নেতৃত্ব অনুসরণ করে।

 

টাইমশেয়ারিং পদ্ধতির প্রবর্তন : ১৯৬০ সালের প্রথমদিকে কেন্দ্রীভূত কম্পিউটিং পরিবেশে ব্যবহারকারীরা তাদের উপাত্ত এবং প্রোগ্রাম প্রস্তুত করার পর তা প্রক্রিয়াজাত করার জন্য কম্পিউটার কেন্দ্রে প্রেরণ করে থাকে। কম্পিউটার কেন্দ্র ব্যবহারকারীদের এসব কাজ সংগ্রহ করতো। তারপর ব্যাচ করে নির্দিষ্ট বিরতিতে কম্পিউটারে দেওয়া হতো। ব্যাচ প্রসেসিং-এর এই অনিবার্য বিলম্ব অনেক ব্যবহারকারীর নিকট ছিল হতাশাব্যঞ্জক। এই বিলম্ব প্রোগ্রামিং অ্যাসাইনমেন্টের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের নিকট খুবই বিরক্তিকর, কারণ কতিপয় প্রোগ্রামের ক্রটি শনাক্ত ও সংশোধনে তাদের দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হতো।

 

এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য জন কেমেনি এবং থমাস কার্টৎজ নামক ডার্টমাউথ কলেজের দুজন অধ্যাপক এমআইটিতে উন্নয়নকৃত পূর্বের টাইমশেয়ারিং ধারণার ওপর ভিত্তি করে কিছু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। টাইমশেয়ারিং পরিভাষাটি স্বাধীন, অপেক্ষাকৃত কম-গতি, অনলাইন এবং যুগপৎভাবে ব্যবহারযোগ্য স্টেশনে অংকের প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়। এখানে প্রতিটি স্টেশন ব্যবহারকারীকে কেন্দ্রীয় প্রসেসরে সরাসরি প্রবেশের সুযোগ দেয়। কেমেনি এবং কার্টৎজ এমন বিশেষ ধরনের প্রোগ্রামের উন্নয়ন করেন যে, যা প্রসেসরকে এক শিক্ষার্থী স্টেশন থেকে অপর শিক্ষার্থী স্টেশনে পরিবর্তনের সুযোগ দেয় এবং কার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত ‘টাইম স্লাইস’ বরাদ্দের মাধ্যমে প্রতিটি কাজের জন্য একটি করে খণ্ড করার সুযোগ দিত। এর উদ্দেশ্য ছিল প্রতিটি শিক্ষার্থী ব্যবহারকারীকে একটি ঘোরের মধ্যে রাখা যে এই সময় অন্য কেউ কম্পিউটারটি ব্যবহার করছে না।

 

পরস্পর ক্রিয়াশীল কম্পিউটিং পরিবেশকে আরও উন্নত করার জন্যে অধ্যাপকদ্বয় একটি প্রোগ্রামিং ভাষার উন্নয়ন করেন যার মাধ্যমে শিক্ষর সকল ক্ষেত্রে স্নাতকের ছাত্রছাত্রীরা জ্ঞানার্জনের সহজ উপায় খুঁজে পাবে। এই উদ্দেশ্য সকল স্নাতক শিক্ষার্থীদের টাইমশেয়ারিং স্টেশন ব্যবহারে প্রতিনিয়ত উৎসাহিত করছিল। বিগিনারস অল-পারপাস সিম্বলিক ইনস্ট্রাকশন কোড সংক্ষেপে ‘বেসিক’ নামক এই ভাষাটি উভয়দিক দিয়ে ছিল ডার্টমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অভূতপূর্ব বিশাল সাফল্য। জেনারেল ইলেক্ট্রিক কম্পিউটার ব্যবহার করে ডার্টমাউথ জিই-র প্রকৌশলীদের সহায়তায় সেই যন্ত্রে বেসিক টাইমশেয়ারিং পদ্ধতি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। ডার্টমাউথ সিস্টেমের সফলতার দেখাদেখি জেনারেল ইলেক্ট্রিক এবং অপরাপর কোম্পানিগুলো তাদের সকল গ্রাহকদের টাইমশেয়ারিং সুবিধা এবং বেসিক ভাষার ব্যবহারের প্রস্তাব দেন।

 

স্বতন্ত্র সফটওয়্যার শিল্পের সৃষ্টি : ১৯৬৫ সালের দিকে কম্পিউটার নির্মাতাগণ তাদের প্রস্তুতকৃত হার্ডওয়্যার বিক্রি করতো অথবা ইজারা দিতো তবে হার্ডওয়্যারের সঙ্গে গ্রাহকদের নিকট সরবরাহকৃত সফটওয়্যারের জন্য কোনো মাশুল নেওয়া হতো না। ব্যবহারকারীর দৃষ্টিকোণ থেকে এই সফটওয়্যার প্রাপ্তি ছিল সম্পূর্ণভাবে বিনা মূল্যে। কিছু সংখ্যক স্বতন্ত্র সফটওয়্যার বিক্রেতা সর্বত্র এমনকিছু প্রোগ্রাম সরবরাহ করছিল যা কম্পিউটার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরবরাহকৃত সফটওয়্যারের চেয়ে অধিক বিশেষায়িত এবং অধিক কার্যকর। কিন্তু ১৯৬৯ সালে আইবিএম এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যখন তাদের নির্মিত হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার পণ্যের আলাদা করে মূল্য আরোপ শুরু করে তখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। এই ধরনের পৃথক সফটওয়্যার ব্যবহারকারীদের দেওয়া হয় এবং তারা উৎকৃষ্ট মানের সফটওয়্যার বেছে নিতে অনুপ্রাণিত হয় এবং এই পদ্ধতি অন্যান্য অনেক নতুন সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দিয়েছিল।

 

মাইক্রোপ্রসেসরের আবির্ভাব : ১৯৬৫ সালের পর থেকে সিলিকন চিপে ইলেক্ট্রনিক উপাদানের গড় সংখ্যা প্রতি বছর দ্বিগুণ হতে থাকে। আর এই অগ্রগতি এক নাটকীয় উন্নয়নের নেতৃত্ব দেয়। মাইক্রোপ্রসেসর সৃজনের ফলে একক চিপে বহু উপাদান স্থাপন করা সম্ভব হয়। একটি মাইক্রোপ্রসেসরে গাণিতিক-যুক্তি এবং নিয়ন্ত্রণ কর্মের জন্য প্রয়োজনীয় সকল বর্তনী বিদ্যমান থাকে। মাইক্রোপ্রসেসর, কিছু অতিরিক্ত প্রাথমিক স্টোরেজ চিপ এবং অন্যান্য সহায়ক সার্কিট নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রসেসর ইউনিট হতে পারে।

 

মাইক্রোপ্রসেসরের উৎপত্তির সময়কাল ধরা যেতে পারে ১৯৬০ সালের শেষদিকে। এই সময়ে ভিক্টর প্যুর নামক ডাটাপয়েন্ট কর্পোরেশনের ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার বিশেষ-উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য কম্পিউটার তৈরির পরিকল্পনা ও উন্নয়নে কাজ করছিলেন। একটি কাস্টম-ডিজাইনড যন্ত্রের প্রয়োজন সব সময়েই বিদ্যমান ছিল। প্যুর এবং অপরাপর প্রকৌশলীগণ এই প্রচেষ্টা গোড়া থেকেই শুরু করেছিলেন। এই চেষ্টা প্যুরের সময়ের বড় ধরনের অপচয়। এর পরিবর্তে তিনি যুক্তি দেখান যে, যদি কম্পিউটারের মূল গাণিতিক-যুক্তি এবং নিয়ন্ত্রণ উপাদানগুলো একটি একক সিলিকন চিপে স্থাপন করা যায় তাহলে সেই চিপ ব্যাপকভাবে কাজ করতে পারবে এবং পরে বিশেষ ধরনের কার্য-সম্পাদন করার জন্য আলাদা পন্থায় প্রোগ্রাম করা যাবে।

 

১৯৬৯ সালে প্যুর এবং ডাটাপয়েন্টের আর এক নবীন প্রকৌশলী হ্যারি পাইল মাইক্রোপ্রসেসরের একটি মডেলের উন্নয়ন করেন। ডাটাপয়েন্ট যেহেতু ইলেক্ট্রনিক উপাদান তৈরি করে না সেহেতু প্যুর তার ‘চিপ প্রসেসর’ মডেলটি দুটি ইলেক্ট্রনিক উপাদান প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান টেক্সাস এবং ইন্টেল কর্পোরেশনের নিকট নিয়ে যান। প্যুর আশা করেছিলেন তারা ডাটাপয়েন্টের জন্য এই চিপ তৈরিতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেবে। সেই সাক্ষাৎ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি তবে ইলেক্ট্রনিক উপাদান নির্মাতারা মাইক্রোপ্রসেসর চিপের ধারণা ব্যবহার করার স্বাধীনতা অর্জন করেছিল এবং তারা তার সদ্ব্যবহার করে।

 

১৯৬৯ সালের শেষের দিকে মারসিয়ান ‘টেড’ হফ নামে ইন্টেলের এক প্রকৌশলী মাইক্রোপ্রসেসর চিপের জন্য নকশার ধারণাগুলো এক জাপানি ক্যালকুলেটর কোম্পানির প্রতিনিধির নিকট উপস্থাপন করেন। তখন বিশেষায়িত চিপ থেকে তৈরি ক্যালকুলেটরগুলো কেবল একটি একক কর্ম-সম্পাদন করতে পারতো। কিন্তু হফের নতুন চিপ ক্যালকুলেটরে একাধিক কর্ম-সম্পাদনের জন্য প্রোগ্রাম করা যেতো। সেই জাপানি গ্রাহক হফের নকশার ধারণাগুলো গ্রহণ করেন এবং চিপের প্রকৃত লেআউটের ওপর কাজ শুরু করে দেন। প্রথম মাইক্রোপ্রসেসর ইন্টেল ৪০০৪ কেবল গুটিকয়েক নির্দেশনা নির্বাহ করতে পারতো আর একই সময়ে কেবল যৎসামান্য উপাত্ত পরিচালনা করা যেতো। কিন্তু ১৯৭১ সালের ঘন বর্ষায় ইন্টেল সৃষ্টি করে এক শক্তিশালী চিপ ৮০০৮ আর টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টও একটি মাইক্রোপ্রসেসর সরবরাহ করে। ১৯৭৪ সালে ইন্টেলের  তৃতীয় মাইক্রোপ্রসেসর ৮০৮০ তৈরির মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত কম্পিউটার (পিসি) উন্নয়নের ভিত রচিত হয়।

 

ব্যক্তিগত কম্পিউটারের উন্নয়ন
পিসির প্রবর্তক যারা : মাইক্রোপ্রসেসর-ভিত্তিক পিসির বিজ্ঞাপন প্রথম নজরে আসে ১৯৭৪ সালের মার্চে অ্যামেরিকান রেডিও রিলে লিগ (এআরআরএল) কর্তৃক প্রকাশিত কিউএসটি ম্যাগাজিনে। বিজ্ঞাপিত পণ্যটি ছিল সেলবি-৮এইচ (Scelbi-8H)। এটি বিক্রি হয়েছিল ২০০-এর মতো। এর পরই আসে অলটেয়ার ৮৮০০। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য নিউ মেক্সিকোর বৃহৎ শহর অ্যালবাকেরকি-ভিত্তিক কোম্পানি এমআইটিএস, ইনক. (Micro Instrumentation and Telemetry Systems, Inc.) কর্তৃক ইন্টেল চিপ দিয়ে অলটেয়ার ৮৮০০ তৈরি করা হয়েছিল (১৯৭১ সালে ক্যালকুলেটর এবং ১৯৭৫ সালে পার্সোনাল কম্পিউটার)। বিক্রির জন্য অলটেয়ারের মূল দরপ্রস্তাব ছিল কিট-আকারে ৪০০ ডলারের নিচে। ১৯৭৫ সালে পপুলার ইলেক্ট্রনিক্স ম্যাগাজিনের জানুয়ারি সংখ্যায় প্রধান শিরোনাম করে এই যন্ত্র সম্পর্কে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় যা পিসি’র জগতে বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি করে। একই সময়ে বিল গেটস এবং পল অ্যালেন নামে দু’জন নবীন প্রকৌশলী বেসিক-এর মাধ্যমে প্রোগ্রাম লেখা সম্পন্ন করেন যা ইন্টেলের মাইক্রোপ্রসেসরের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা যান্ত্রিক ভাষায় অনুবাদ করতে সক্ষম। গেটস-অ্যালেনের বেসিক প্রোগ্রাম বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্যে মাইক্রোসফট কর্পোরেশন সৃষ্টি হয়েছিল। আর ১৯৭৫ সালের শেষদিকে এমআইটিএস-কে মাইক্রোসফট লাইসেন্স প্রদান করে। মাইক্রোসফট বর্তমানে ব্যক্তিগত কম্পিউটারের জন্য সফটওয়্যার সরবরাহকারী বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান।

 

আজকের দিনে ব্যক্তিগত কম্পিউটার শিল্পে অনেক প্রতিযোগীর রয়েছে উত্তমরূপে-সজ্জিত উন্নয়ন পরীক্ষাগারসহ লক্ষ কোটি ডলারের বাণিজ্যিক কারখানা। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ব্যক্তিগত কম্পিউটারের প্রবর্তকগণ বেশিরভাগই ছিলেন স্ব-শিক্ষিত এবং শৌখিন যারা উদীয়মান প্রযুক্তির প্রতি ছিলেন মুগ্ধ। তারা প্রটোটাইপ সিস্টেম নির্মাণ করেছিলেন, যন্ত্রাংশ কেনার অর্ডার থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতেন এবং গ্যারেজে বসে যন্ত্রাংশ সংযোজন করতেন। সেইসব অগ্রণী কোম্পানির মধ্যে অল্প কয়েকটি প্রাথমিক পর্যায়ে বেঁচে যায়।

 

প্রারম্ভিক সফলতা : যে কোম্পানি গ্যারেজে বেড়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়-ফোকলোরে জায়গা করে নিয়েছে সেই কোম্পানির নাম অ্যাপল কম্পিউটার। ১৯৭৬ সালের বসন্তে স্টিভ ওয়াজনিয়াক নামে হিউলেট-প্যাকার্ডের এক নবীন টেকনিশিয়ান এমওএস টেকনোলজি থেকে একটি মাইক্রোপ্রসেসর কিনে এনে সেটা দিয়ে কম্পিউটার তৈরি শুরু করেন। অ্যাপল ওয়ান নামের এই কম্পিউটার সিলিকন ভ্যালির হোমব্রু কম্পিউটার ক্লাবে প্রদর্শন করা হয়। ওয়াজনিয়াক তার ডিজাইনটি নিয়ে হিউলেট-প্যাকার্ডের কাছে গেলে তারা এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে তাকে ফিরিয়ে দেয়। এমন সময় তার বন্ধু স্টিভ জবস অ্যাপল বাজারজাতকরণের জন্য একটি কোম্পানি গঠনের পরামর্শ দেন। তখন ২০০-এর মতো অ্যাপল ওয়ান তৈরি করা হয়েছিল। তবে গ্রীষ্মের শেষে ওয়াজনিয়াক অ্যাপল টু ডিজাইনের কাজ করছিলেন। মাইক মারকুলা নামক ইন্টেলের প্রকৌশলী এবং মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ-এর আর্থিক এবং ব্যবস্থাপনাগত সহায়তায় ‘অ্যাপল’ কম্পিউটার শিল্পে প্রধান প্রতিযোগী হয়ে ওঠে।

 

১৯৭৭ সালের শেষদিকে টেন্ডি কর্পোরেশনের রেডিও শেইক ডিভিশন-এর টিআরএস-৮০ মডেল সংবলিত অ্যাপল টু ছিল প্রভাবশালী যন্ত্র। আর অলটেয়ার কম্পিউটারে ব্যবহৃত ইলেক্ট্রিক্যাল ইন্টারকানেকশন ধারণা অনুসরণ করার জন্য ডজনখানেক অন্য ব্র্যান্ড ডিজাইন করা হয়। এইসব সিস্টেমে ব্যবহারের জন্য ১৯৭০-এর দশকের শেষদিকে চাহিদানুযায়ী অধিকাংশ অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রাম লেখা হয়েছিল।

 

উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ১৯৭৮ সালের বর্ষায় ভিজিক্যালক নামক এক গুরুত্বপূর্ণ সফটওয়্যারের সূচনা হয়। এই প্রোগ্রাম কলাম এবং সারিতে বিন্যাসিত উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তৈরি হয়েছিল। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের তদানীন্তন এক শিক্ষার্থী ডান ব্রিকলিন-এর কাছ থেকে এই প্রোগ্রামের ধারণা এসেছিল। ব্রিকলিন আর্থিক-পরিকল্পনা সংক্রান্ত সমস্যা বিশ্লেষণ করার জন্য কাগজের শিটে কলাম এবং সারি ব্যবহার করতেন। কিন্তু এতে প্রতিবার অবিরাম পুর্ণগণনায় প্রয়োজন হয়েছে আলাদা আর্থিক ভাবনার। ব্রিকলিন কারণ দেখিয়েছেন যে, যদি কাগজের শিটকে একটি ‘ইলেক্ট্রনিক ব্ল্যাকবোর্ডে’ এবং ‘ইলেক্ট্রনিক চকে’ প্রতিস্থাপন করা যায় তাহলে কম্পিউটার সকল অংকের কাজগুলো করে ফেলতে পারবে। ব্রিকলিন তার ইলেক্ট্রনিক স্প্রেডশিটের ধারণাকে বাজারজাত পণ্যে রূপান্তরকরণে সাহায্যের জন্য তার এক প্রোগ্রামার বন্ধু বব ফ্রাঙ্কস্টোনকে জানালেন। ফ্রাঙ্কস্টোন এতে কতিপয় বৈশিষ্ট্য সংযোজন করে অ্যাপল টু-এর জন্য প্রথম প্রোগ্রাম প্রস্তুত করেন। ভিজিক্যালক এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, এককভাবে ভিজিক্যালক-এর জন্য হাজারখানেক অ্যাপল বিক্রি হয়েছিল। এই সফলতা অপরাপর অনেক সফটওয়্যার প্রণেতাদের স্প্রেডশিট এবং অন্যান্য অ্যাপ্লিকেশন প্যাকেজ বাজারজাতকরণে উৎসাহিত করেছিল।

 

সাম্প্রতিক বছরগুলো: ১৯৭০-এর দশকের শেষ নাগাদ নেতৃস্থানীয় যন্ত্রগুলো সর্বত্র যেমন, গৃহ, স্কুল এবং কর্মস্থলে ব্যবহৃত হতে থাকে। কিন্তু ১৯৮০র দশকের প্রারম্ভে বাসাবাড়িতে ব্যবহারের জন্য কতিপয় কোম্পানি যেমন অ্যাটারি এবং কমোডোর কম দামের সিস্টেম উৎপাদন করতে থাকে। আর অধিক শক্তিশালী ডেস্কটপ মডেলের সম্পূর্ণ নতুন প্রজন্ম স্কুল এবং কর্মস্থলে ব্যবহারের জন্য চালু হয়েছিল। আইবিএম তাদের কম্পিউটারের আইবিএম-পিসি পরিবার নিয়ে বাজারে প্রবেশ করে বিপুলভাবে সফলতা লাভ করে তবে সে সময়ে নতুন নতুন গজে উঠা অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানকে প্রতিনিয়ত নতুন হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যারের প্রস্তাব নিয়ে আসতে দেখা যায়।

 

নতুন প্রোগ্রাম পণ্যের প্রবর্তন হয়েছিল ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে যা ছিল একটি একক প্যাকেজে কতিপয় অ্যাপ্লিকেশনের জন্য সফটওয়্যারের সমন্বয়। সেইসব সমন্বিত সফটওয়্যার প্যাকেজগুলো এমন ছিল যা একাধিক অ্যাপ্লিকেশনের চলতি অবস্থা পৃথক উইনডোতে অথবা পর্দার অংশবিশেষে প্রদর্শন করতে পারতো, এমনকি ১৯৭০-এর দশকের প্রোগ্রামগুলোও দেখাতে পারতো। সেই সময়ে, প্যালো অলটোর গবেষণা কেন্দ্রে জেরক্সের গবেষকরা প্রথম সমন্বিত উইনডোভিত্তিক সফটওয়্যারের উন্নয়ন করেন। কিন্তু ১৯৮১ সালে জেরক্সের ৮০১০ স্টার ইনফরমেশন সিস্টেমে (ওয়ার্কস্টেশন) নিয়ে আসা পর্যন্ত এই ধারণাকে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে দেখা যায়নি। পর্দার মধ্যে উপাত্ত এবং প্রোগ্রাম ক্ষুদ্র ছবি আকারে উপস্থাপিত হতো যাকে বলা হয় আইকন। উদাহরণস্বরূপ, ডিলিট নির্দেশ টাইপ করলে উপাত্ত ট্র্যাশের ছবিতে অবস্থান নিতে পারতো। অ্যাপ্লিকেশসমূহের মধ্যে উপাত্ত একাধিক উইনডোর মধ্যদিয়ে অতিক্রম করতে পারতো যা পর্দায় উন্মোচিত হতে পারে।

 

স্টারের মূল্য ছিল ১৫,০০০ ডলারের উপরে, অধিকাংশ মানুষ এর সক্ষমতা সম্পর্কে অসচেতন ছিলেন। তবে স্টারের সুফল অ্যাপল কম্পিউটারে অতর্কিতে যায়নি। জেরক্সে কাজ করা অ্যাপলের প্রকৌশলীরা প্রভাবিত হয়ে স্বল্প-মূল্যের একটি ব্যক্তিগত কম্পিউটার তৈরি করেন যাতে স্টারের অনেক বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। লিসা নামের হার্ডওয়্যার/সফটওয়্যার সিস্টেমটি ১৯৮৩ সালে প্রকাশ করা হয় তবে এটি মাত্র কয়েক বছরের জন্য উৎপাদন করা হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে অনুরূপ অনেক হার্ডওয়্যার/সফটওয়্যার বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্বল্প-মূল্যের অ্যাপল ম্যাকিন্টোশ চলে আসে। অবশ্যই অ্যাপল একা ছিল না, ডজনখানেক সফটওয়্যার সরবরাহকারী ১৯৮৪ সালে সমন্বিত প্যাকেজ ঘোষণা করে যা তৈরি করা হয়েছিল জনপ্রিয় ব্যক্তিগত কম্পিউটারের জন্য। তাছাড়া ব্যবহারকারীরা তাদের ব্যক্তিগত কম্পিউটারের সঙ্গে যোগাযোগ করার সময় পছন্দনীয় সেই গ্রাফিক্স পরিবেশ সমর্থন করে এমন সিস্টেম তৈরির জন্য কম্পিউটার হার্ডওয়্যার নির্মাতারা হামাগুড়ি দিতে থাকে।

 

একটি নতুন যুগের দ্বারপ্রান্ত
এখন আমরা একটি পূর্ণ আবর্তে অবতীর্ণ। আমরা কম্পিউটিং-এর ইতিহাস প্রত্যক্ষ করেছি এবং এও দেখেছি গত কয়েক দশকে কত দ্রুতগতিতে কম্পিউটিং-এ পরিবর্তন এসেছে। প্রাযুক্তিক অগ্রসরতার হার এখানে যা উল্লেখ করা হয়েছে তা আদৌ কম ছিল না। তবে কম্পিউটিং-এর ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুত অগ্রগতির সময় সম্ভবত সামনের দিকে।

 

(ম্যাকগ্র হিল, ইনক. কর্তৃক প্রকাশিত ডোনাল্ড এইচ সেন্ডারস-এর ‘কম্পিউটার টুডে উইথ বেসিক’ গ্রন্থ অবলম্বনে।)

 

লেখক: প্রশিক্ষক, বাংলা একাডেমি।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ অক্টোবর ২০১৫/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়