ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘বঞ্চনার বহিঃপ্রকাশ থেকেই ভাষা আন্দোলন’

বাদশাহ্ সৈকত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৯, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘বঞ্চনার বহিঃপ্রকাশ থেকেই ভাষা আন্দোলন’

ভাষাসংগ্রামী আব্দুল করিম সরকার

বাদশাহ্ সৈকত, কুড়িগ্রাম : শুধু ভাষা নয়, নানা বঞ্চনা থেকে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিল বাহান্নর ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর থেকেই তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকদের কাছে মাতৃভাষা বাংলা  ছিল লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার ভাষা। উর্দু না জানলে সরকারি কোনো চাকরি জুটত না। ট্রেনে কোনো সিট মিলত না। বিহারীরা শুয়ে-বসে সব সিট দখল করে নিত। ট্রেনে দাঁড়িয়ে যেতে হতো বাঙালিদের।

 

এরই মধ্যে যখন রাষ্ট্রভাষা উর্দু ঘোষণা করা হল, তখন বাঙালিরা তাদের ভাষা রক্ষায় আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আর সে আন্দোলন শুধু ভাষার জন্য নয়। সেটা ছিল বাঙালিদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। আর সে আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ বপন করা হয়েছিল।

 

রাইজিংবিডির সঙ্গে তার নিজ বাসভবনে একান্ত সাক্ষাৎকারে কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রামের ভাষাসংগ্রামী অ্যাডভোকেট আব্দুল করিম সরকার।

 

সেসময় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চারত স্কুলের শিক্ষার্থীরা রংপুর থেকে মাতৃভাষা নিষিদ্ধের কথা শুনে আন্দোলন শুরু করেন। মিছিল মিটিংয়ের পাশাপাশি নির্মাণ করেন শহীদ মিনার।

 

বর্তমানে কুড়িগ্রামে একমাত্র জীবিত এ ভাষাসংগ্রামী ৮৫ বছর বয়সেও কাজ করছেন কুড়িগ্রাম জজকোর্ট ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে বসবাস করছেন কুড়িগ্রাম পৌরসভার প্রাণিসম্পদ অফিস সংলগ্ন কৃষ্ণপুরের চড়–য়াপাড়ার নিজ বাড়িতে। আইন পেশার পাশাপাশি লেখালেখি করে দিন কাটাচ্ছেন তিনি।

 

রাইজিংবিডি : কেমন আছেন আপনি ?

অ্যাডভোকেট আব্দুল করিম সরকার : ভালো আছি। কিন্তু তোমার পরিচয় কি? কেন এসেছো?

 

রাইজিংবিডি : আমি সংবাদকর্মী, রাইজিংবিডি থেকে এসেছি আপনার ভাষা আন্দোলনের কথা শুনতে। ভাষা আন্দোলনের সময় আপনার বয়স কত ছিল?

 

আব্দুল করিম সরকার : তখন আমি কুড়িগ্রাম মহকুমার রিভারভিউ হাই স্কুলের মেট্রিক পরীক্ষার্থী ছিলাম। সেসময় এখনকার মতো কোনো যোগাযোগের মাধ্যম ছিল না। বিদ্যুৎ ছিল না। কাঁচা রাস্তা-ঘাটেরও খুব ভগ্নদশা ছিল। রেডিও ছিল না। যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ট্রেন ও গরুর গাড়ি। ভাষা আন্দোলনের কয়েকদিন পর রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে খবরটি শুনতে পাই। বাংলা ভাষার ওপর এমন নিষেধাজ্ঞার কথা শুনে আমরা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চারত ছাত্ররা আলোচনা করে আন্দোলন শুরু করি। আন্দোলনের পাশাপাশি বর্তমান মজিদা আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের গেট সংলগ্ন যে শহীদ মিনারটি আছে সেটা নির্মাণ করি।

 

নিজ বাসভবনে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলছেন ভাষাসংগ্রামী আব্দুল করিম সরকার

 

রাইজিংবিডি : কবে শহীদ মিনারটি নির্মাণ করেছিলেন। তার সাল ও তারিখটা কি বলতে পারবেন।

 

আব্দুল করিম সরকার : অনেক দিন আগের কথা বাবা। সম্ভবত ১৯৫৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি হবে।

 

রাইজিংবিডি : কেন ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন?

 

আব্দুল করিম সরকার : ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর থেকেই আমরা বাঙালি জাতি তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকদের কাছে নির্যাতিত হয়ে আসছিলাম। বাঙালিদের কোনো চাকরি দিতে চাইত না পাকিস্তান সরকার। ট্রেনে উর্দুভাষি বিহারীরা সব সিট দখল করে শুয়ে-বসে যেত। আর বাঙালিদের দাঁড়িয়ে যেতে হত। সবকিছু সহ্য করার পরও যখন আমাদের কথা বলার ভাষা কেড়ে নিতে চাইছিল তখন কি আর বসে থাকা যায়?

 

রাইজিংবিডি : কতজন ছাত্র সেসময় আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন?

 

আব্দুল করিম সরকার : অ্যাডভোকেট আমান উল্ল্যাহ, আব্দুল মতিনসহ বেশ কিছু ছাত্র। বললামইতো সেসময় যারা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিচর্চা করেছিলামÑতারাই।

 

নিজ বাসভবনে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলছেন ভাষাসংগ্রামী আব্দুল করিম সরকার

 

রাইজিংবিডি : আপনি বলেছিলেন সেসময় সাহিত্যচর্চা করেছিলেন?

 

আব্দুল করিম সরকার : হ্যাঁ তখন থেকে সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক আমার। ১৯৬২/৬৩ সালে কুড়িগ্রামের ইউর প্রেস থেকে আলী প্রকাশনায় ‘চৈতালী হাওয়া’ নামের একটি বই বের করেছিলাম। তারপর থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ‘নদীর নাম ধরলা’, ‘ভালোবাসার মরণ নেই’সহ অনেক লেখা বেরিয়েছে।

 

রাইজিংবিডি : আপনার অতীতের ওসব লেখা নিয়ে বর্তমানে কোনো বই প্রকাশের ইচ্ছে আছে কি?

 

আব্দুল করিম সরকার : ইচ্ছে তো আছে। কিন্তু আমাকে সাহায্য করবে এমন কাউকে পাই না। তারপরও প্রস্তুতি নিচ্ছি একটি বই প্রকাশ করার।

 

রাইজিংবিডি : দেশ স্বাধীন হল। মায়ের ভাষা পাওয়ারও কয়েক যুগ কেটে গেছে। বর্তমানে এই সময়ে এসে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রতি আপনার কিছু বলার আছে কি?

 

আব্দুল করিম সরকার : আমার দুঃখ হয় এটা ভেবে যে, এই বাংলা ভাষার জন্য এতকিছু করা হল। আর এখন রাস্তা-ঘাটে চলতে-ফিরতে চোখে পড়ে বাংলা শব্দও ইংরেজিতে লেখা হচ্ছে। যানবাহনে পরিবহন বাংলায় না লিখে ইংরেজিতে লেখা হচ্ছে। এ কষ্ট এখনো আমাকে ভাবিয়ে তোলে।

 

রাইজিংবিডি : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য।

 

আব্দুল করিম সরকার : রাইজিংবিডি এবং আপনাকেও ধন্যবাদ।

 

 

 

রাইজিংবিডি/কুড়িগ্রাম/৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/বাদশাহ্/রিশিত খান

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়