ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

তারানগরে আর্সেনিক দানব, সুপেয় পানির হাহাকার

মহাসিন আলী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ২১ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তারানগরে আর্সেনিক দানব, সুপেয় পানির হাহাকার

মহাসিন আলী, মেহেরপুর : মেহেরপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরের মুজিবনগর উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী গ্রাম তারানগর। আর্সেনিকের ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়েছে তারানগর গ্রামসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে। সুপেয় পানির অভাবে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ।

তারানগর গ্রামের ১৬৫টি টিউবওয়েলের মধ্যে ১৬০টিতে অধিক মাত্রার আর্সেনিক শনাক্ত হয়েছে।এ গ্রামের আড়াই হাজার মানুষের মধ্যে প্রায় আটশত মানুষ আর্সেনিকে আক্রান্ত। আর্সেনিক ধরা পড়ার পরে গত ২০ বছরে গ্রামের প্রায় ২০০ মানুষ আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

জয়পুর-তারানগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শহিদুল ইসলাম জানান, এ গ্রামের লোকসংখ্যা ২ হাজার ২৫৮ জন। এখানের ভূ-গর্ভস্থ পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক শনাক্ত হয়েছে।

আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে গত ২০ বছরে তারানগরে মৃত্যুবরণকারীরা হলেন, কিতাব আলী মাষ্টার (৫২), তার স্ত্রী সাফাতন বিবি (৪৬), কলিমুদ্দিন (৪০), তার স্ত্রী মহুয়া খাতুন (৩২), মা আশেরা খাতুন (৫৫) ও বোন আকলিকা খাতুন (২৪),  কিতাব মল্লিক (৬০), তার ছেলে ফিতাজুল (২০), ফ্যাতা (৫২) তার স্ত্রী মহিলা খাতুন (৪৩), নামাজ আলী (৪২), তার ভাই কাশেম আলী (৩৮) ও হাশেম আলী (৩৫), ওয়াহেদ আলী (৫৫), লাল ভানু (৩২), ইসমাইল হোসেন (৫০), আব্দার আলী (৪০), মুজাম (৪৫), হারুন (২২) ও তার পিতা আলী হোসেন (৪৫), আজমত (৪২), হাবিবুল রহমান (৩৭), নূর ইসলামসহ (৫৫) সহ প্রায় ২০০ জন মারা গেছেন।

শিক্ষক শহিদুল ইসলাম বলেন, এখানের আক্রান্ত রোগির মধ্যে একই পরিবারের আপন তিনভাই শহিদুল ইসলাম (৪০), বরকত উল্লাহ (৩৬) ও শওকত আলী (৩২), আরেক পরিবারের আপন তিনভাই ইসরাফিল (৪৫), হাশেম আলী (৩৮) ও হোসেন আলী (৩২)। এ ছাড়া এই গ্রামের মোশারেফ হোসেন (৩৭), লুৎফর রহমান (৩৮), নেছা খাতুনসহ (৪৫) প্রায় আটশত লোক আক্রান্ত রয়েছেন।

তারানগরে খাবার জন্য সুপেয় পানির পাশাপাশি আর্সেনিকে আক্রান্ত দরিদ্র মানুষেরা চিকিৎসার জন্য অর্থ যোগাড় করতে পারছেন না। ফলে বিনা চিকিৎসায় তাদের মরতে হচ্ছে। আর্সেনিকে আক্রান্ত ইস্রাফিল বলেন, ‘মাঝেমাঝে এনজিওর লোকজন এসে বড়ি ওযুধ দেয়। ভাল চিকিৎসার জন্য টাকা পাব কোথায়? তাই বিনা চিকিৎসায় প্রাণ দিতে হবে। এটা মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের আর বিকল্প কি আছে?’

অধিকাংশ টিউবওয়েলে মাত্রারিক্ত আর্সেনিক থাকায় তাদের পানি পানেরও যেন উপায় নেই। এ গ্রামের প্রায় দুইশত ঘর লোক ওই গ্রামের মরহুম আজিজুল হক মাষ্টারের বাড়ির শত বছর আগের খনন করা ইন্দিরার পানি পান করে থাকেন। সকালে ও বিকেলে গ্রামের বধূরা লাইন দিয়ে ওই ইন্দিরার পানি তুলে কলস ভরে নিয়ে যান।  

তারানগরের বাসিন্দা গোপালনগর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল মালেক বলেন, ‘সুপেয় পানির জন্য ৫/৬ বছর আগে জনস্বাস্থ্য বিভাগের উদ্যোগে তারানগর গ্রামে ১৫/২০টি পাতকুয়া বসানো হয়। এগুলো ইতিমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। ২/৩টি ভাল আছে। তবে একেকটি থেকে মাত্র ২/৩টি পরিবারের পানি নেওয়া চলে। সেভ দি চিলড্রেনের উদ্যোগে আর্সেনিমুক্ত পানির জন্য গ্রামের ক্লাবপাড়ার মোড়সহ তিনটি স্থানে সিডকো আর্সেনিক রিমোভাল প্লান্ট স্থাপন করা হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ সংযোগের অভাবে একটি বন্ধ আছে। বাকি দু’টি অন্যের বাড়ির বিদ্যুতের সাইড লাইন নিয়ে কোনভাবে চালানো হচ্ছে।

ইন্দিরা থেকে টিউবওয়ল দিয়ে তোলা পানির জন্য অপেক্ষা


তারানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে ৩০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের জন্য বিদ্যালয়ে টিউবওয়েল ও পাতকুয়া থাকলেও তা আর্সেনিকমুক্ত নয়। প্রধান শিক্ষক প্রশান্ত মন্ডল বললেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পানির অভাবে কষ্ট পাচ্ছে।

জয়পুর-তারানগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বরকত আলীসহ ওই গ্রামের অবস্থাশালী কয়েক ব্যক্তি নিরাপদ পানি পেতে বাড়ির ছাদ থেকে পলিথিন পাইপের মাধ্যমে বড় বড় প্লাস্টিকের ট্যাংক অথবা মাটির নীচে বিশেষভাবে তৈরি কুয়ায় পানি ধরে রাখছেন। পরে বিভিন্ন উপায়ে পরিশোধন করে ওই পানি সারা বছর পান করার চেষ্টা করছেন। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র হওয়ায় ওইভাবে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করা সকলের পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা।

গ্রামের সুপেয় পানির উৎসগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্টদের কাছে বারবার ধর্ণা দিয়ে কোন ফল হয়নি বলে জানান ওই গ্রামের রোকনুজ্জামানান। তার বোনের মেয়ে মেহেরপুর জিনিয়াস ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী তনিমা জানায়, মেহেরপুর শহর থেকে নানা বাড়ি তারানগর গেলে সঙ্গে বোতল অথবা কন্টেইনার ভরে নিয়ে যেতে হয়।

 

মুজিবনগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু হেনা মো. জামাল জানান, আর্সেনিক আক্রান্তদের নতুন কোন তালিকা নেই। তবে নতুন করে তালিকাভুক্তির জন্য কাজ চলছে। তিনি পরামর্শ দেন লাল চিহ্নিত টিউবওয়েলের পানি পান না করতে। ডোবা-পুকুরের পানি আপাততঃ ফুটিয়ে পান করা যেতে পারে। অন্যথায় রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে, বলেন তিনি।

মুজিবনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে আর্সেনিক কবলিত তারানগর গ্রামের কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় এক এনজিও’র তথ্য মতে, তারানগর গ্রামের পানিতে ৩০০ পিপিবি থেকে ৫০০ পিপিবি মাত্রার আর্সেনিক আছে।

মেহেরপুর জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী (দায়িত্বপ্রাপ্ত) মুন্সি মোঃ হাসানুজ্জামান বলেন, ‘মেহেরপুর জেলার ভোলাডাঙ্গা, আলমপুর আমঝুপি ও তারানগরসহ কয়েকটি এলাকার পানিতে আর্সেনিক শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে তারানগরের অবস্থা ভয়াবহ। ওই গ্রামের ১৬৫টি টিউবওয়েলের প্রায় সবগুলোতে আর্সেনিকের উপস্থিতি রয়েছে। ওই গ্রামে ভূগর্ভে পাথর থাকায় ৩০০ থেকে ৩৫০ ফুটের বেশি পাইপ বসানো সম্ভব নয়। তাই আর্সেনিকমুক্ত পানি পাওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। তবে আর্সেনিক রিমোভাল প্লান্ট কিংবা মিনি ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করা গেলে গ্রামবাসীকে আর্সেনিকমুক্ত পানি পান করানো সম্ভব হবে।

 

 

 


রাইজিংবিডি/মেহেরপুর/২১ নভেম্বর ২০১৬/মহাসিন/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়