ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

নিউ ইয়র্কে বাংলা উৎসব ও বইমেলা || শিহাব শাহরিয়ার

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৯, ২৭ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নিউ ইয়র্কে বাংলা উৎসব ও বইমেলা || শিহাব শাহরিয়ার

উৎসব মঞ্চে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অতিথিবৃন্দ

হাঁটি হাঁটি পা পা করে নিউ ইয়র্কের আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা ছুঁয়ে দিল চব্বিশ বছর। আমেরিকায় ‘বাঙালি পাড়া’ খ্যাত জ্যাকসনহাইটের বাংলা উৎসব ও বইমেলা বয়সে এখন এক তাজা তরুণ। সাবওয়ের প্রান্ত ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলা বইয়ের ঘর মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের কর্ণধার বিশ্বজিৎ সাহা তার চেতনার রং দিয়ে নিজে হেঁটে হেঁটে উত্তর আমেরিকার বাঙালিদের কাঁধে এখন তুলে দিয়েছেন এই বই-উৎসব ও মিলনমেলার চাবি। গত চব্বিশ বছরে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে এই মেলায় যোগ দিয়েছেন অসংখ্য লেখক-কবি-সাহিত্যিক এবং প্রকাশক। প্রতি বছরই পালাক্রমে যাচ্ছেন লেখক ও প্রকাশকরা। কেউ কেউ একাধিকবার  যাচ্ছেন। এতে অনেকের আমেরিকা দেখার স্বপ্নও পূরণ হচ্ছে। অর্থাৎ এক ঢিলে দুই পাখি মারছেন তারা- কলা বেচাও হচ্ছে, রথও দেখা হচ্ছে তাদের।

বাক্যটি একটু খারাপ শোনালেও সত্যি। তবে এতে আমি দোষ দেখি না। কারণ দেশের সর্ববৃহৎ একুশের চেতনায় স্নাত বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলা ছাড়া ঢাকা বইমেলাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বইমেলার বাইরে বাঙালিরা যোগ দেন আগরতলা, কলকাতা, টোকিও, ফ্রাঙ্কফুট ও নিউ ইয়র্ক বইমেলায়। এর মধ্যে নিউ ইয়র্ক বইমেলার দুটো দিক বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বৈশিষ্ট্য এ জন্যেই বলছি যে, এই উৎসব ও বইমেলার মাধ্যমে বাংলা বই ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ছে যেমন সুদূর আমেরিকায়, তেমনি এই মেলা কেন্দ্র করে উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত বাঙালিদের মধ্যে এক আনন্দঘন মিলনও ঘটছে। শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু গুণ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথিতযশা কবি এবং লেখকরা এই উৎসবকে দারুণভাবে অলঙ্কৃত করেছেন। শুধু তাই নয়, তারা এই মেলায় দেখতে পেয়েছেন ‘মিনি বাংলাদেশ’।

২০১৪ সালে উৎসবের উদ্বোধক ছিলেন কবি মহাদেব সাহা। সে বছর তিনি বলেছেন, ‘নিউ ইয়র্কে আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা দেখে আমার মনে হয় মাথার ওপরে বাংলা অক্ষরের এক অনন্ত আকাশ। কোটি কোটি বাংলা বর্ণমালা সেই আকাশে ফুটে আছে। সেখানে বাংলাদেশের মাটি, ১৩ শত নদীর জলধারা, রাশি রাশি পুষ্প, আলো ও সুগন্ধ বিলাচ্ছে। বাঙালির এ এক অসামান্য উৎসব, অসামান্য মিলন মেলা। আমার প্রাণ ভরে যায়, এই মেলা উদ্বোধন করে আমি নিউ ইয়র্কের আকাশে বাংলাদেশের আকাশ দেখছি, ৭ই মার্চ দেখছি, ১লা বৈশাখ দেখছি, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে দেখছি।’

লেখক আহমদ মাযহার লিখেছেন : ‘নিউ ইয়র্কের বইমেলার সঙ্গে বাংলা একাডেমির বইমেলার একটি ক্ষেত্রে সাদৃশ্য রয়েছে। একুশের চেতনায় যেমন ছিল বাঙালিত্বের প্রকাশ তেমনি বাংলাদেশ থেকে বহুদূরে অবস্থানরত অভিবাসী বাঙালিদের বাঙালিত্বের চেতনার এক ধরনের প্রকাশ নিউ ইয়র্কের বাংলা উৎসব উপলক্ষে অনুষ্ঠিত বইমেলাটি। তার উপর এই বইমেলায় বাঙালিত্বের রূপটি সম্প্রসারিত একটি মাত্রা অর্জন করেছে।’


এবারের উৎসব ও বইমেলা উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ও ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের প্রধান রোকেয়া হায়দার উৎসব সম্পর্কে বলেছেন, ‘দেখতে দেখতে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব এবং বইমেলা চব্বিশ বছরে পা রাখলো। ১৯৯২ সালে যে বইমেলার গোড়াপত্তন হয়েছিল সেই বইমেলাটি এখন রীতিমত চব্বিশ বছরের টগবগে যুবক। বেশ দেখতে পাই গত চব্বিশ বছরে এই বইমেলার শাখা-প্রশাখা অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে, ফুলে ফলে চারিদিক আলোকিত করে সুশোভিত হয়েছে। নিউইয়কে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত এই বইমেলাটি এখন আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসবে পরিণত হয়েছে। উত্তর আমেরিকা তো বটেই পৃথিবীর নানা প্রান্তের বাঙালিদের সহযোগিতায় এই আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলাটি এখন আক্ষরিক অর্থেই বাঙালির মিলন মেলায় পরিণত হয়ে গেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মুক্তধারা চব্বিশটি বছরের নিরলস পরিশ্রম আর সাধনার ফসল এই আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব এবং বইমেলা।’     

নিউ ইয়র্কের আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা ২০১৫ অনুষ্ঠিত হলো ২২, ২৩ ও ২৪ মে। তিন দিনের এই মেলায় যোগ দেয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস ২০ মে ২০১৫ তারিখে আমাকে জানাল, তোমার ভিসা হয়ে গেছে। আমি তখন সিদ্ধান্তহীন, কারণ ২২ মে শুরু হবে উৎসব। গিয়ে ধরতে পারবো কিনা? টিকিট পাবো কিনা? এমতাবস্থায় স্থির করলাম যাবো, টিকিটও একটা পেলাম এবং উড়ালও দিলাম উৎসবে যোগ দিতে, আমন্ত্রিত বাংলাদেশের শেষ যাত্রী হিসেবে। কারণ ইতোমধ্যে চলে গেছেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, লেখক আহমদ মাযহার, শিশুসাহিত্যিক আমীরুল ইসলাম, সাংবাদিক গোলাম মর্তুজা, শিশুসাহিত্যিক হুমায়ুন কবীর ঢালী, সংগীত শিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী ও সামিনা চৌধুরী এবং প্রকাশনা সংস্থা- মাওলা ব্রাদার্স, সময় প্রকাশ, বাংলা প্রকাশ, গতিধারা, সন্দেশ, নালন্দা ও ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের প্রতিনিধিরা। উড়াল দেবার আগে ফেসবুকে একটি স্টেটাস দিলাম আর নিউ ইয়র্কে বসবাসরত কবি শামস আল মমীনকে টেলিফোনে জানালাম, আমি আসছি। কারণ গিয়ে উঠবো তাঁর বাসাতেই। তিনি বললেন, চলো এসো একসাথে উৎসবে যাবো।

ভোর রাত। কুয়েত এয়ারলাইন্সের বিমানটি ভরে গেল বাংলাদেশি শ্রমিকদের দ্বারা। মনে হলো নিউ ইয়র্কের যাত্রী শুধু আমি একা। বিমান উড়ল আকাশে। বলে রাখি, বিমান ভ্রমণ আমার কাছে সব সময়ই পীড়াদায়ক। কিন্তু কিছু করার নেই, মেনে নিতেই হবে দীর্ঘ প্রায় চব্বিশ ঘণ্টার একটানা ভ্রমণ। মনে মনে ভাবছি, পেছনে বঙ্গোপসাগর, সামনে আরব ও আটলান্টিক। অবশেষে পৌঁছাবো নিউ ইয়র্কের নীল আকাশে। আকাশ থেকে নামলেই মন্ত্রমুগ্ধ শহরের হাতছানি। যে শহরে জীবন ও যানের চঞ্চলতা কেবল! যে শহরের ঘুম নেই, যে শহরে প্রেমিকার আঁচল ওড়ে না। তখন মনে পড়ে কবি আবিদ আজাদের ‘ঘাসের ঘটনা’র সেই চরণধ্বনি- যে শহরে তুমি নেই, তুমি থাকবে না।’

শহর ঢাকা আর শহর নিউ ইয়র্কের তুলনায় মেতে মেতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি মধ্য আকাশের মেঘেঘেরা বিমানের উইন্ডোপাশে। ঘুম ভাঙে আরব সাগরের উপরে। জানালা খুলে দেখি, সকালের রোদ ফুটে আছে মরু বালির শরীরে। এরপর কুয়েত বিমানবন্দরে নামা, সেখান থেকে  আবারও উড়াল। যাও বিমান, পার হও মহাসাগর আটলান্টিক। অবশেষে পৌঁছে যাবো গন্তব্যে। যে গন্তব্যেও আকাশজুড়ে এখন খাবি খাচ্ছে গ্রীষ্মরোদ। অবশেষে নরম রোদের ভিতর ধীরে ধীরে নেমে গেলাম পরিচ্ছন্ন এক শহরের শরীরে। এই শহর এখন ধারণ করে অসংখ্য বাঙালি। বাংলা ভাষাকে, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে। এই শহরে এখন বাংলায় লেখা আছে অনেক দোকানপাট, ঘর-বাড়ি। প্রতিনিয়ত জনপদজুড়ে হেঁটে বেড়াতে দেখা যায় শ্যামলা রঙের অসংখ্য মানুষ। এখন অন্তত মনে হয় না এক অচেনা, অজানা দেশে এলাম।

নিউ ইয়র্ক সময় বিকাল সোয়া পাঁচটায় নেমে সোয়া ছ’টায় জেএফকে থেকে বেরিয়ে এলাম। ঢাকা থেকেই বলে রেখেছিলাম সাইকেলে বিশ্বজয়ী কেরানিগঞ্জের লিঙ্কন ও তার স্ত্রী ভাগ্নি তানিয়াকে। ওরা আমাকে নিতে আসবে বিমান বন্দরে। আমি ইমিগ্রেশন শেষ করেই ওদের দেখা পেলাম। ওরা ওদের গাড়িতে উঠিয়ে সোজা চলল কুইন্সের দিকে। এর পাশেই লংআইল্যান্ড। ব্যক্তিগতভাবে লংআইল্যান্ড আমার কাছে দারুণ লাগে। আটলান্টিক সমুদ্রঘেরা আইল্যান্ড বা দ্বীপ ভূমিতে প্রচুর বাঙালি বসবাস করেন। অত্যন্ত অভিজাত ও সুন্দর করে গড়ে তোলা হয়েছে এই আইল্যন্ড। বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে ওদের গাড়িতে উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মনে মনে উচ্চারণ করলাম আহা আমার ঢাকা শহরকে কি এমন সুন্দর করে সাজাতে পারি না, কত পরিচ্ছন্ন, কত পরিপাটি, কত কত কি, এই নিউইয়র্ক! যে ভ্যাপসা গরম রেখে এলাম ঢাকায়, তার কিছুই নেই এখানে। বরফ থেকে বেরিয়ে রোদের কিরণে ঝলঝল করছে নিউ ইয়র্ক।


কুইন্সের বেলরোজে কেনা তার নতুন বাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন আশির কীর্তিমান কবি শামস আল মমীন। গাড়ি থামার সাথে সাথেই দরোজা খুলে বেরিয়ে এসে আমাকে স্বাগত জানালেন আন্তরিকতায়। বললেন, গোছল সেরে চা-নাস্তা খেয়ে চলো বেরিয়ে পড়ি। আমি এলেই, তিনি আমাকে নিয়ে যাবেন- এ বছরের নিউ ইয়র্কের আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলায়। এ রকমই কথা হয়েছিল ঢাকা থেকে উড়াল দেবার আগে। ফ্লাইট সিডিউল অনুযায়ী বইমেলার উদ্বোধনী দিন বিকেল বেলায় আমার পৌঁছুবার কথা। মমীন ভাই তার বাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।

রাত শুরু হয়ে গেলেও সূর্যের আলো ছেয়ে আছে নিউ ইয়র্কের গায়ে। এখানে এমনই, রাত হয়ে যায় তবু সূর্য ডোবে না। হাইওয়ে ধরে গাড়ি চালাচ্ছেন শামস আল মমীন। আমি পাশের ছিটে বসে ভাবছি ২০০৯ সালের কথা। তখন এই উৎসবে যোগ দিতে প্রথমবার এসেছিলাম। উৎসব শেষে ঘুরে গেছি নিউজার্সী, নিউ প্যানসেলভিনিয়া, ওয়াশিংটন ডিসি ও ভার্জিনিয়া। এবারও এসেছি একই উৎসবে লেখক হিসেবে যোগ দিতে। এবারের উৎসব কমিটির আহ্বায়ক ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের প্রধান রোকেয়া হায়দারের আমন্ত্রণে। এরপর  সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ও ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের ভিসা নিতে হয়েছে।

ইতোমধ্যে ঝকঝকে তকতকে হাইওয়ে পেরিয়ে মমীন ভাই গাড়ি থামালেন বইমেলার সামনে। ঢাকা থেকে সর্বশেষ আসা আমি এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি ধরতে পারিনি। যেটি পেরেছিলাম ২০০৯ সালে। তখন বাংলাদেশ থেকে এসেছিলাম কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হকের নেতৃত্বে হুমায়ূন আহমেদসহ কয়েকজন লেখক ও প্রকাশক। পশ্চিমবঙ্গ থেকে লেখক সমরেশ মজুমদারসহ কয়েকজন এসেছিলেন। নিউ ইয়র্কে বাঙালিদের সরব-স্থান জ্যাকসন হাইটের একটি স্কুলঘর ও তার মাঠেই বসেছিল মেলা ও উৎসব। এবারও একই স্থানে বইমেলা হচ্ছে। এই উৎসবের আয়োজনে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি থাকলেও একজনের নাম সর্বাগ্রে নিতে হয়, তিনি বিশ্বজিৎ সাহা। অসম্ভব পরিশ্রমী ও নিষ্ঠাবান এই বই ও বাঙালি সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষটি নেপথ্যে থেকে দীর্ঘ বছর ধরে তিলে তিলে এই আয়োজন সার্থক করে যাচ্ছেন। প্রথমেই দেখা হলো তাঁর সঙ্গে। তারপর এক এক করে অনেক পরিচিত মুখের সঙ্গে। ইদানীং যাদের ঢাকায় দেখি না, তাদের অনেকের দেখা পেলাম এই উৎসবে। কবি শহীদ কাদরী অসুস্থ বলে আসেননি মেলায়। দেখলাম না জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও পূরবী বসুকে। কিন্তু বাকি সবার সঙ্গেই বাঙালিদের এই মিলন মেলায় দেখা হলো।

রোকেয়া হায়দার, হাসান ফেরদৌস, সাজেদ কামাল, আলেয়া চৌধুরী, ফাহিম রেজা নূর, মুজিব বিন হক, ফজলুর রহমান, কৌশিক আহমেদ, আকবর হায়দার কিরন, আনোয়ার শাদাৎ, শারমিন আহমেদ, মিথুন আহমেদ, লুৎফরন্নাহার লতা, জুলি রহমান, সুফিয়ান চৌধুরী, ফারহানা তুলি দর্পন কবীর ও কামরুজ্জামান বাচ্চুসহ অসংখ্য লেখক ও সাংবাদিকবৃন্দের সঙ্গে। আর বাংলা কবিতার আশির তিন শক্তিশালী কবির কথা একটু আলাদাভাবেই বলতে হয়, এরা হলেন শামস আল মমীন, ফকির ইলিয়াস ও তমীজ উদ্দিন লোদী। অত্যন্ত আন্তরিকতায় এরা আমাকে সম্ভাষণ জানালেন। কারণ কবিতাকর্মী বলেই এই তিন জনের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে বিশেষ করে ফেসবুকের বদৌলতে। আমি নিয়মিত তাদের কবিতা পড়ছি, তারাও আমার লেখালেখির খোঁজ-খবর রাখছেন প্রতিনিয়ত। এদের বাইরে দেখলাম যান্ত্রিক জীবনের ফাঁকে এখানে আনন্দ কুড়াতে এসেছেন নানা বয়সী অভিবাসী বাঙালি। একদিকে গ্রীষ্মের রৌদ্রমাখা নিউ ইয়র্ক ও অন্যদিকে সাপ্তাহিক বন্ধের দিন বলে এই উৎসবে মানুষের প্রচুর সমাগম। যে স্কুলে বইমেলাটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে তার নিচতলায় বইয়ের স্টল ও একটি কক্ষে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা পর্ব এবং দোতলায় অডিটরিয়ামে উৎসবের মূল পর্বগুলো অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

মনে পড়লো বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলার কথা; ১৯৮৪ সাল থেকে নিয়মিত যে বইমেলায় যাই। যেখানে একইসঙ্গে চলে সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও হাজার হাজার নতুন বইয়ের গন্ধভরা সমাবেশ।এখানেও একই সুরে ভরা। আমি কলকাতা, টোকিও, ফ্রাঙ্কফ্রুট কিংবা পৃথিবীর অন্যান্য বইমেলায় যেতে পারিনি, কিন্তু একুশে বইমেলা, ঢাকা বইমেলা কিংবা বাংলাদেশের স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ করে যে আনন্দ পাই, এই বইমেলাতেও একই আমেজ পেলাম। কারণ লেখক-প্রকাশক-পাঠক সমাবেশের এই আয়োজন বরাবরই আনন্দের। এবারের উৎসবে আমার দুটি বিষয়ে অংশগ্রহণ ছিল, স্বরচিত কবিতা পাঠ ও লেখক-প্রকাশক আলোচনাচক্র। স্বরচিত একটি দীর্ঘ কবিতা পড়ে বেশ আনন্দ পেলাম। প্রশংসাবাক্যে স্নাত হলাম। দেখলাম অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করলেন আমার কবিতার বই কেনার জন্য। সঙ্গে নেয়া আমার সর্বশেষ প্রকাশিত কবিতার বই ‘খড়ের খোঁয়াড়’ বেশ কয়েক কপি বিক্রি হলো।

দেখলাম আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বসবাসরত অনেক বাঙালি লেখক ও পাঠক স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নিয়েছেন মেলায়। লক্ষ করলাম নিউ ইয়র্কে গড়ে উঠেছে কয়েকটি সাহিত্য বিষয়ক সংগঠন। শামস আল মমীন ও কবি ফকির ইলিয়াস গড়ে তুলেছেন ‘বহুবচন’নামে নিবিড় সাহিত্য-চর্চা সংগঠন। আছে সাহিত্য একাডেমি, আছে বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রসহ বেশ ক’টি সংগঠন। এদের প্রতিনিধিরাও উৎসবে যোগ দিয়েছেন। যোগ দিয়েছেন নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সমস্ত বাংলা সাপ্তাহিকের সম্পাদক ও লেখক। তিনদিনই এসব লেখক ও সাধারণ দর্শকদের সঙ্গে  কথা হলো, আড্ডা হলো। একটি বিষয় লক্ষ করলাম- নিউ ইয়র্কে বাংলা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে কথাসাহিত্যে জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও পূরবী বসু এবং কবিতাচর্চার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন শামস আল মমীন, ফকির ইলিয়াস ও হাসানআল আবদুল্লাহ। এখন যুক্ত হয়েছেন কবি তমীজ উদ্দিন লোদী। এ ছাড়াও আরো অনেকে রয়েছেন।

অনেকে অবশ্য বলবেন, শহীদ কাদরীর কথা। তিনি বোস্টন থেকে নিউ ইয়র্কে আসেন ২০০৬ সালে। এর আগেই উল্লিখিত কবিরা বিশেষ করে কবিতাচর্চায় বিরাট ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। দেখলাম কয়েকটি বাংলা টিভি চ্যানেল সম্প্রচার শুরু করেছে, তাদের প্রতিনিধিরাও এসেছেন মেলায়। ভয়েস অব আমেরিকার পক্ষ থেকে মেলার উপর একটি প্রামাণ্য অনুষ্ঠান দেখলাম। অনেকেই বই কিনছে, আলোচনায় অংশ নিচ্ছে, দর্শক হিসেবে অংশ নিচ্ছে। বইয়ের স্টলের পাশাপাশি ছিল কয়েকটি পোশাকের স্টল। সেখানে ভিড় দেখলাম। প্রবাসী বাঙালি নারীরা কিনছেন বাংলাদেশের শাড়ি, সালোয়ার কামিজসহ নানা রকম হস্তশিল্পের আইটেম। স্বরচিত কবিতা পাঠ, আবৃত্তি, শিশুদের অনুষ্ঠান, নতুন বই নিয়ে আলোচনা, লেখক-প্রকাশক মত বিনিময়, নাটক নিয়ে আলোচনা, সংগীতানুষ্ঠানসহ বিভিন্ন পর্বে সাজানো অনুষ্ঠানমালা। এক এক করে শেষ হলো সমস্ত আয়োজন। অর্থাৎ উৎসব ও বইমেলার আনন্দঘন সময় শেষ হলো ২৪ মে গভীর রাতে। সবাই ফিরে গেলেন আপন আলয়ে।   


মুক্তধারার বইয়ের দোকানটিই লেখক-পাঠকদের সম্মিলন ঘর। পরের দিনগুলো কিছু সময় আমরা এখানে আড্ডা দিয়েছি। এরপর আমাদের ঘুরে বেড়াবার পালা। কারণ আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, একজন লেখক শুধু বই পড়া ও লেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবেন না, তাকে ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও নিতে হবে। সুতরাং বেরিয়ে পড়লাম নিউ ইয়র্কের সৌন্দর্য-শোভা দেখতে। বলে রাখি, ২০০৯ সালে আমার তিন বন্ধু ও এক ছোট ভাইয়ের মাধ্যমে বইমেলা শেষে ঘুরেছিলাম। সেবার কবি ও কথাশিল্পী দিলারা হাশেম আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ভয়েস অব আমেরিকার স্টুডিওতে। সেখানে তিনি প্রায় ছয় মিনিটের একটি সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন আমার। এটি আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা।

কুনি আইল্যান্ড নিউ ইয়র্কের কক্সবাজার বলে খ্যাত। একদিন ঝলমলে রোদে দেখতে গেলাম এই আইল্যান্ড। কবি কামরুজ্জামান বাচ্চু আমাকে তার গাড়িতে করে নিয়ে গেলেন। দেশি-বিদেশি অসংখ্য সমুদ্রবিলাসী মানুষের ভিড় সৈকতে। রৌদ্রস্নান করছেন কেউ কেউ। সমুদ্র ঘিরে পুরো এলাকা দারুণ লাগল দেখতে। এই সৈকতগুলোতে গেলে বোঝা যায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকে আমরা কতটা অবহেলায় ফেলে রেখেছি। প্রথমেই চোখে পড়লো, সমুদ্রের নীল জল, তারপর দীর্ঘ সৈকতে অসংখ্য সমুদ্রবিলাসী দেশি-বিদেশি মানুষ। একদিন গেলাম প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর দেখতে। বিশ্বের বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটানের সেন্ট্রাল পার্কের পাশে এই ন্যাচারাল কিস্ট্রি মিউজিয়ামটি সত্যি দেখার মতো। দেখলাম ট্রেড সেন্টারটি আবার নতুন করে ঝলঝলে গা নিয়ে দাঁড়িয়েছে। হার্ডসন ও ইস্টার রিভার দিয়ে কলকল শব্দ তুলে বয়ে যাচ্ছে জল। শাদা, কালো আর শ্যামলা মানুষগুলো ছুটছে জীবনের টানেÑ কখনো সাপের মতো আঁকা-বাঁকা সড়ক পথে, কখনো সাবওয়ের অন্ধকারে সবুজ, লাল আর শাদা বাতির নিয়ন আলোয়। রাতের নিউ ইয়র্ক জ্বলে উঠছে অন্য রমণীয় রূপে। এই আলো-আঁধারিতে ছড়িয়ে পড়ছে, মিশে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ বাঙালির হাসি-কান্না। জেগে উঠছে বাংলাদেশি বালুচর। এই বালুচরের বাসিন্দাদের অসংখ্য অজানা গল্প শোনা হলো এবারের কয়েকটি আড্ডায়, খণ্ড খণ্ড আলাপে, ব্যক্তিগত আলোচনায়। মনে পড়ল জীবনানন্দ দাশের কথা। কী অসাধারণ উচ্চারণই না তিনি করে গেছেন- অদ্ভুত আঁধার এক পৃথিবীতে এসেছে আজ’।        

নিউ ইয়র্কে রয়েছে তিনটি বাংলা চ্যানেল। শামস আল মমীন, বিশ্বজিৎ সাহা, তমীজ উদ্দিন লোদীর মাধ্যমে তিনটি চ্যানেলেই তিনটি সাক্ষাৎকার প্রদান করার সুযোগ হলো। তমীজ উদ্দিন লোদী নিজেই একটি চ্যানেলে আমার ইন্টারভিউ নিলেন। চ্যানেলগুলো কোনো সম্মানী দেয় না। তবু বিনা সম্মানীতে কথা বলে খারাপ লাগেনি। এবার সুযোগ হলো কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে প্রথমবারের মতো দেখা করার। শামস আল মমীন আমাকে নিয়ে গেলেন তার বাসায়। একটি স্মরণীয় মুহূর্ত আমার জন্য। তাঁকে সালাম দিলাম। উনি বসতে বললেন। তারপর প্রায় চার ঘণ্টা তার সঙ্গে আড্ডা হলো। বললেন, জীবনের অনেক কথা। আলোচনা করলেন সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে। তার একটি ইচ্ছার কথাও বললেন, সেটি হলো বাংলাদেশের কবিতা নিয়ে একটি বড় কাজ করতে চান। যেখানে তিনি আমাকে সঙ্গে রাখতে চান। আমি সানন্দে তাঁর প্রস্তাবে রাজি হলাম।  

এবারও যাওয়া হলো না স্ট্যাচু অব লিবার্টিতে। যাওয়া হলো না বোস্টন, বাফেলো, মেরিল্যান্ড, জর্জিয়া, টেকসাস, ফ্লোরিডা, ক্যালিফোর্নিয়া কিংবা লুইজিয়ানায়। তাতে কী? হলো তো সামান্য অর্জন, সামান্য অভিজ্ঞতা। এ টুকু নিয়ে ৪ মে ২০১৫ ঝলমলে বিকেলে শামস আল মমীনের গাড়িতে উঠলাম। তার গাড়ি ছুটে চলেছে জন এফ কেনেডি বিমান বন্দরের দিকে। আমাকে ডাকছে ঢাকা, ডাকছে বাংলাদেশ। ডাকছে কক্সবাজার, ডাকছে কুয়াকাটা। আর বিদায় বাংলা উৎসব ও বইমেলা, বিদায় নিউ ইয়র্ক, বিদায় আমেরিকা। বিদায় শহীদ কাদরী। ভালো থাকবেন শামস আল মমীন। বুক মিলিয়ে চলে গেলেন তিনি, আমি ঢুকে গেলাম ইমিগ্রেশনে। কিছুক্ষণ পর উড়বো আকাশে, আবারও ওল্টো পথে পাড়ি দেবো আটলান্টিক, আরব সাগর। ভাসমান মেঘের সাথে খেলা করে নেমে যাবো শ্যামলা মায়ের আদরভরা আঁচলে, দেখবো সামনেই প্রিয় বঙ্গোপসাগর। দেখবো ইনানিতে নিভে যাচ্ছে দিনের আলো। আহা, কী যে সুন্দর সন্ধ্যার কালি নদী! পাশেই অগণিত সমুদ্র-ঢেউ।

ছবি : হুমায়ূন কবীর ঢালীর সৌজন্যে

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুলাই ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়