ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

নির্জন দ্বীপে ৪৩ বছর

শামীমা নাসরীন রিপা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৭, ৩০ জানুয়ারি ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নির্জন দ্বীপে ৪৩ বছর

ডায়েং আবু ও ডায়েং মেইডা

শামীমা নাসরীন : চামড়ায় অসংখ্য ভাঁজ। চোখের কোণা থেকে শুরু করে চিবুক পর্যন্ত ভাঁজ আর ভাঁজ। দাঁতহীন গোলাপি মাড়িতে নির্মল হাসি। সঠিক বয়স বলতে পারেন না। দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন অনেক আগেই। তবু ‘বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে’ কথাটা তার ক্ষেত্রে যায় না। এখনো দিব্যি নিজের কাজ করে চলেছেন । জীবিকার তাগিদে কারো ওপর নির্ভরশীল নয়। দাঁতহীন ফাঁকা মাড়ির হাসিতে প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে রেখেছে যেনো প্রকৃতি।

 

হ্যাঁ প্রিয় পাঠক, বলছিলাম ডায়েং আবু ও তার স্ত্রী ডায়েং মেইডার গল্প। তারা বসবাস করছেন ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি উপকূলের পালাও সেংকেহ দ্বীপে। আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে ৪৩ বছর ধরে তারা এই দ্বীপে বাস করছেন। ১৯৭২ সালে সবাইকে ছেড়ে জীবিকার তাগিদে ও সমাজের সব প্রতিবন্ধকতা থেকে বাঁচতে পালাও সেংকেহ দ্বীপে চলে আসেন।   

 

৮০ বছর আগে ২০ বছরের বড় ডায়েং আবুর সঙ্গে ঘর বেঁধেছিলেন মেইডা। তারপর থেকেই সুখে দুঃখে একসঙ্গেই রয়েছেন। আবু সমুদ্রের গভীর থেকে ঝিনুক আহরণ করে জীবনযাপন করতেন। এক সপ্তাহের জন্য আবু সমুদ্রে চলে যেতেন ঝিনুক আহরণের জন্য। আর মেইডা ঘরের কাজ, রান্না করতেন ও কাপড় বুনতেন। কখনো তারা মাছ খেতেন, কখনো শুধু ভাত। এভাবেই চলতো তাদের জীবন। বিয়ের পর তাদের ছয় সন্তান জন্ম নিলেও বেঁচে নেই একটিও। প্রথম পাঁচ সন্তানের বয়স এক বছর হওয়ার আগেই মারা গেছে। ষষ্ঠ সন্তান মারা যায় বড় হওয়ার পর।

 

  পালাও সেংকেহ দ্বীপ

 

নিঃসন্তান এ দম্পতির পথচলার সঙ্গী তারাই দুজন। একদিনে আবু হঠাৎ খেয়াল করলেন তার শরীর সিমেন্টের বস্তার মতো শক্ত হয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চিকিৎসক বললেন, আবুর হাত অসাড় হয়ে গেছে। কুষ্ঠরোগ হয়েছে। এর কিছুদিন পর আবু তার দৃষ্টিশক্তিও হারিয়ে ফেলেন। এ অবস্থায় দিশেহারা হয়ে পড়েন আবু ও মেইডা। চোখে শরষেফুল দেখতে শুরু করেন। কারণ আবু আর মাছ ধরতে বা ঝিনুক আহরণ করতে পারবেন না। আর মাছ ধরতে না পারলে তাদের আহার জুটবেনা। হতাশার মধ্যে হঠাৎ আলোর সন্ধান পেলেন আবু।

 

১৯৭২ সালে সেংকেহে দ্বীপে কচ্ছপের বংশবৃদ্ধি করতে সেচ্ছাসেবী নিয়োগের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। ভূতের অভয়াশ্রম হিসেবে পরিচিত নির্জন এ দ্বীপে কেউ যেতে চায়নি। এ সময় আবু ভাবলেন সমাজ থেকে পালিয়ে বাঁচার এটাই সবেচেয়ে ভালো উপায়।

 

 

বর্তমানে আবু ও মেইডা পরিবেশবাদী কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা সমুদ্রে কচ্ছপের বংশ বৃদ্ধি করা এবং সায়ানায়েড ও ডিনামাইট দিয়ে মাছ ধরার বিপক্ষে কথা বলে জেলেদের সচেতন করেন। একই সঙ্গে সমুদ্রে প্রবাল বাঁচানোর জন্য কাজ করছেন। সায়ানায়েড ও ডিনামাইট কীভাবে প্রবার প্রাচীর বিলুপ্ত করে সে বিষয়ে জানান আবু। যে দ্বীপে প্রেতাত্মা ছাড়া আর কেউ থাকতো না বলে ‘মিথ’ রয়েছে, সেখানে এখন অনেকেই যাওয়া আসা করে। দ্বীপের জীব বৈচিত্র্য সম্পর্কে জানতে এখন অনেকেই আবুকে অভিজ্ঞ মনে করেন।    

 

দ্বীপে যাওয়ার সময় তার স্বজনরা তাকে অনেক ভয় দেখিয়েছিল। তারা বলেছিল, সেংকেহ দ্বীপে ভূত ও অতৃপ্ত আত্মারা ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করেই সেদিন মেইডাকে সঙ্গে নিয়ে সেংকেহ দ্বীপে চলে যান আবু।

 

 

প্রথম যখন তারা সেংকেহ তে আসেন তখন সেখানে তপ্ত বালুময় সৈকত ছাড়া আর কিছু ছিল না। ছিলনা রাত্রি যাপনের কোনো আশ্রয়। প্রথম রাতে আবু ও মেইডা দুজনেই অনেক কেঁদেছিলেন।

 

কিছুদিনের মধ্যেই সেখানেই আঙ্গুরের চাষ শুরু করেন আবু। একইসঙ্গে সামুদ্রিক কচ্ছপের বংশবৃদ্ধির কাজও শুরু করেন। প্রথমত তারা এসব কচ্ছপ মাকাসার শহরে বিক্রি করতেন। তবে পরে সরকার সেগুলোকে সমুদ্রে ছেড়ে দিতে বলে।

 

বিষুবরেখার পাঁচ হাজার কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে ইন্দোনেশিয়ার ১৭ হাজার দ্বীপ। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রবালদ্বীপ। বিশেষজ্ঞরা জানান, এই দ্বীপের ৮০ শতাংশই হুমকির মুখে। ক্ষয়িষ্ণু এই জৈবপরিবেশ (ইকোসিস্টেম) সংরক্ষণ করতে কচ্ছেপ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই কচ্ছপগুলো প্রবালের জন্য ক্ষতিকর শ্যাওলা ও জলজ প্রাণী খেয়ে প্রবাল প্রাচীরকে রক্ষা করে।

 

আবু জানান, ১৯৯০ সালে প্রথম শ্রমিকের পরিশ্রম কমাতে সায়ানায়েড ও ডিনামাইট ছিটিয়ে মাছ ধরা শুরু হয়। প্রবাল প্রাচীরের মধ্যে একমুঠো কীটনাশক ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর মাছগুলো ভেসে ওঠে এবং জেলেরা মাছগুলো সংগ্রহ করে।

 

 

এখন এ দ্বীপে অনেকেই আসে। সায়েনায়েড ও ডিনামাইট দিয়ে মাছ ধরার নেতিবাচক দিকগুলো আবু জেলেদের কাছে তুলে ধরেন এবং প্রবাল প্রাচীর রক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বোঝান। আবু এখন দ্বীপের লোকজনের কাছে এসব বিষয়ে অভিজ্ঞ। কখনো কখনো আবু ‘ওয়াটার বোম্ব’ ব্যবহারকারী জেলেদের পুলিশে ধরিয়েও দেন।

 

আবু এখন বিশ্বাস করেন, তিনি এখন কুষ্ঠ রোগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। সেংকেহ দ্বীপে জীবনযাপন খুবই কষ্টসাধ্য। কিন্তু আবু ও মেইডার পরস্পরের প্রতি অসাধারণ ভালোবাসা তাদের জীবনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। তারা এখন কোনো প্রতিকূলতাকে প্রশ্রয় দেন না। আবুর দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে গেলেও মেইডা তাকে সঠিক পথে যাওয়ার জন্য ভালোভাবে নির্দেশনা দেন। ইন্দোনেশীয় একটি বেসরকারি সংস্থা আবুকে একটি কাঠের ঘর তৈরি করে দিয়েছে সেখানে বসাবাসের জন্য। পরিবেশবাদী হিসেবে কাজ করায় খুসি হয়ে আবু ও মেইডার জন্য ওই ঘর নির্মাণ করে দেয় ওই সংস্থাটি।

 

আবু জানান, একবার পানির অভাবে তারা প্রায় অর্ধমৃত হয়ে পড়েছিলেন। কারণ পানের উপযুক্ত পানি পৌঁছাতে দেরি হয়েছিল। এ ধরনের সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতেন তারা দুজনে মিলেই। আবু জানান, তিনি অত্যন্ত সুখি। এটা খুবই শান্তিপূর্ণ এক জীবন।

 

কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে আবু বলেন, ‘ঈশ্বর আমাকে যা দিয়েছে তার কিছুই আমি পরিবর্তন করতে চাই না। এমনকি আমার অসুস্থতাও নয়।’  

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ জানুয়ারি ২০১৬/সাইফ      

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়