ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

নিশানা বিদেশি নাগরিক!

প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:০৫, ১৩ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নিশানা বিদেশি নাগরিক!

প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু : ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজার রাজধানীকে খুন হন গত ২৮ সেপ্টেম্বর। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো আসামিকে শনাক্ত করা যায়নি। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এখনো রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি।

গুলশান ২-এর ৯০ নম্বর সড়কের ফুটপাতে গুলিতে নিহত তাবেলা (৫০) নেদারল্যান্ডসভিত্তিক আইসিসিও কো-অপারেশন নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রফিটেবল অপরচুনিটিজ ফর ফুড সিকিউরিটি (প্রুফ) কর্মসূচির প্রকল্প ব্যবস্থাপক ছিলেন। তার সঙ্গে কারো শত্রুতা থাকতে পারে কি না,  এটা নিঃসন্দেহে তদন্তের বিষয়। আরেক দিকে বিবেচনা করলে যেটা ধরা পড়ে তা হলো, তার সঙ্গে কারো শত্রুতা থাকার কারণ থাকারও কথা নয়। বাংলাদেশের রাজনীতি কিংবা কারো সঙ্গে শত্রুতা সৃষ্টি করতে পারে- এমন কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি জড়িত- এমন কোনো তথ্যও গণমাধ্যমে আসেনি।

অস্ট্রেলিয়া যখন তার ক্রিকেট দলের নিরাপত্তা ঝুঁকির প্রশ্ন তুলে দলের বাংলাদেশ সফরকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিল, ঠিক এই পরিস্থিতিতে তাবেলা খুন হলেন। বিদেশি পর্যটক হত্যার ঘটনাকে পুঁজি করে বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের নিরাপত্তা হুমকির অজুহাত আরো জোরালো হয়ে উঠতে সহায়ক হলো। অস্ট্রেলিয়ার পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে এল। বাংলাদেশ দায়িত্ব নিয়ে বলল অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হবে। বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিসিবি সভাপতি নিরাপত্তার বিষয়ে বাংলাদেশের জোরালো অবস্থানের কথা তাদের সামনে তুলে ধরলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর স্থগিত হলো। যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশে অবস্থানরত তাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা হুমকিজনিত রেড অ্যালার্ট জারি করে দিল।

আমরা তো জানি, কোনো দেশের নিরাপত্তা অবস্থা কতটা নাজুক পর্যায়ে এলে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর বাতিল এবং বিদেশি নাগরিকদের জন্য তাদের দেশের রেড অ্যালার্ট জারি এটাই দাবি রাখে যে বাংলাদেশে চরম নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ বিরাজ করছে।

২ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অবস্থিত পুলিশ সদর দপ্তরের সামনে বন্দুকধারীদের হামলার ঘটনা ঘটে গেল। অস্ট্রেলিয়া নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্ন তুলল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতার প্রমাণ মিলল অস্ট্রেলিয়াতেও। এই ঘটনার কারণে অস্ট্রেলিয়া প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। বাংলাদেশেও অনেক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে, বইবে।

নিরাপত্তার অজুহাত তুলে অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশ সফর বাতিল কিংবা স্থগিত করা অবশ্যই বাড়াবাড়ি। এর আগেও বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়াও বাংলাদেশে খেলেছে। নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগ তোলার মতো কোনো অঘটন ঘটেনি। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলকে নিরাপত্তা দেওয়ার মতো সামর্থ্য বাংলাদেশের আছে। বাংলাদেশের অনুরোধকে অস্ট্রেলিয়ার মূল্যায়ন করা উচিত ছিল। এই বিষয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমী মানুষ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার এই আচরণকে ভালোভাবে নেয়নি। আমরা আশা রাখি অস্ট্রেলিয়া শিগগিরই বাংলাদেশ সফরে আসবে। খেলায় খেলায় স্টেডিয়ামকে মাতিয়ে তুলবে। আর বাংলাদেশও দেখিয়ে দেবে নিরাপত্তা কাকে বলে।

তবে বিদেশি পর্যটক হত্যার ঘটনাকে মামুলি ঘটনা হিসেবে নেওয়া উচিত হবে না। তাবেলা হত্যায় রক্তের ছোপ মুছে না যেতেই রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যার ঘটনা ঘটল। এই দুই বিদেশি একইভাবে হত্যার শিকার হয়েছেন। একজন প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে থাকাকালীন নিহত হন আর অপরজন প্রধানমন্ত্রীর দেশে ফেরার দিন হত্যার শিকার হলেন।

দেশে পর পর বিদেশি নাগরিক হত্যার শিকার হওয়ার কারণ কি? এই ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় কি না? আর কোনো বিদেশি পর্যটক খুন হওয়ার আগে রাষ্ট্রকে যা করার তা করতে হবে। সরকারের উচিত বিদেশি নাগরিক হত্যার বিষয়টিকে স্রেফ বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে না দেখা। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ড দেশীয় না আন্তর্জাতিক মদদে পরিচালিত হয়েছে, তা তদন্তসাপেক্ষ বিষয়। কিন্তু এই ধরনের ঘটনা রাষ্ট্রকে নিরাপত্তা হুমকির প্রশ্নের পাশাপাশি সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির ক্ষেত্রও তৈরি করে দিতে পারে। কোনো মহল ঠিক এটাই চাইছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা দরকার।

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরও বেফাঁস কথাবার্তা বলা থেকে বিরত থাকা উচিত। যেকোনো ধরনের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা এই ধরনের জঘন্য ঘটনাকে আরো উৎসাহিত করতে পারে।

সংবাদ এবং গণমাধ্যমের বরাত অনুযায়ী, ২০০৪ সাল থেকে গত আগস্ট পর্যন্ত র‌্যাব ১ হাজার ১০৯ জন জঙ্গিকে আটক করেছে। পুলিশ আটক করেছে ২ হাজার ৫৪৩ জন জঙ্গিকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে সংবাদ সম্মেলন করে এমন তথ্য দেশবাসীকে জানানো হয়েছে। কিন্তু সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে বেড়ান দেশে কোনো জঙ্গি নেই। আবার রামু সহিংসতার মতো সাম্প্রদায়িক কোনো ঘটনা ঘটলে বলেন এই ঘটনা জঙ্গিগোষ্ঠী করে থাকতে পারে। এই ধরনের বেফাঁস কথাবার্তার কারণে একদিকে জঙ্গিগোষ্ঠী প্রশ্রয় পেতে পারে এবং অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গি মোকাবিলায় নিরুৎসাহী হয়ে উঠতে পারে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক মানের বিভিন্ন অভিধা বা স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা আনন্দিত এবং গর্বিত। দেশের জন্য যদি একটুও ভালোবাসা থেকে থাকে তাহলে আওয়ামী মতাদর্শ পছন্দ করেন না- এমন ব্যক্তিরও আনন্দিত হওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া পুরস্কারগুলোতে কোনো আন্তর্জাতিক রাজনীতি আছে বলে মনে করি না। প্রাপ্ত পুরস্কারের মধ্যে এমনও সব পুরস্কার আছে যা কোনো নির্দিষ্ট দল, সম্প্রদায় কিংবা নিজের রাষ্ট্র থেকে দেওয়া হয়নি। যেমন ২০১২ সালে রামু সহিংসতা ঘটার পর ঢাকার কমলাপুর ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারে ‘বৌদ্ধ সমাজ সুরক্ষা জাতীয় কমিটি’ নামক নতুন গজিয়ে ওঠা একটি সংগঠন  প্রধানমন্ত্রীকে ‘শান্তি পুরস্কার’ দিয়েছে। এই ক্ষেত্রে তথাকথিত সুরক্ষা কমিটির দুরভিসন্ধি সম্পর্কে গোটা বৌদ্ধ সমাজ অবগত ছিল। আর এই পুরস্কারের গুরুত্ব কতখানি, তাও দেশবাসী জানেন।

যে কথা বলতে চাই, প্রধানমন্ত্রীর এই অর্জন বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু এই অর্জনের বাঁধভাঙা আনন্দ জোয়ারে যেন বিদেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ডের মতো স্পর্শকাতর বিষয়টি তলিয়ে না যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রধানমন্ত্রীর অর্জনের কীর্তিগাথা বিশ্ব গণমাধ্যমে ততটা জায়গা পায়নি যতটা পেয়েছে বিদেশি নাগরিক হত্যার বিষয়টি। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা, বাংলাদেশ এবং বর্তমান সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করা, বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করাসহ বিভিন্ন সমীকরণ এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কাজ করেছে বলে মনে করি। ৫ অক্টোবর পাবনার ঈশ্বরদীতে দিনেদুপুরে ঘরে ঢুকে খ্রিষ্টান ধর্মযাজক লুক সরকারকে হত্যার চেষ্টা থেকে আমরা কী ইঙ্গিত পাই?  

দুজন বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনাকে পরিকল্পিত ঘটনা বলেই মনে হচ্ছে এবং এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের লক্ষ্যবস্তু আপাতত কেবল বিদেশি এবং দেশিরাই। রাষ্ট্রের এখন প্রথম কাজ হলো অতি অল্প সময়ের মধ্যে অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যার ঘটনায় জাপান কড়া প্রতিক্রিয়া না দেখালেও একটা বিষয় স্পষ্ট বোঝা যায় যে, জাপান এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চায়। বাংলাদেশ সরকার এই বিষয়ে কতটা আন্তরিক, সেই প্রমাণ তারা চায়।

 

ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জেলাগুলোর প্রশাসনকে আরো তৎপর হওয়ার জন্য বলেছে। পর্যটন শহর হিসেবে কক্সবাজারের জন্যও মাথাব্যথার কারণ বেশি। তাই কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব আরো অনেক বেশি। যে সকল হোটেল-মোটেলে পর্যটকরা থাকেন সেখানকার কর্তৃপক্ষেরও আরো সজাগ এবং যত্নশীল হতে হবে।

 
      
লেখক : প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু, আবাসিক ভিক্ষু, কেন্দ্রীয় সীমা বিহার, রামু

 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ অক্টোবর ২০১৫/শাহনেওয়াজ/এএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়