ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

নূরীর বেগম সম্পাদক হয়ে ওঠার গল্প

সাইফ বরকতুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৪২, ২৩ মে ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নূরীর বেগম সম্পাদক হয়ে ওঠার গল্প

নূরজাহান বেগম

সাইফ বরকতুল্লাহ : সেই নব্বই দশকের কথা। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি গিয়ে দেখি মা বেগম পত্রিকা পড়ছেন। কৌতূহলবশত আমি মার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম, মা কী পড়? ঠোঁটের কোণায় একচিলতে হাসি দিয়ে মা বলতেন, ‘বেগম পড়ি।’

 

আমি মার কাছ থেকে বেগম নিয়ে পাতা উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখতাম। জানার চেষ্টা করতাম- মা কেন বেগম পড়তেন? সে সময় নারীরা ছিল ঘরকেন্দ্রিক। বাইরে বের হলেই অভিভাবকের কঠোর বিধিনিষেধ। কিন্তু মাকে দেখতাম মাঝেমাঝেই গান গাইতে। আমার মায়ের মধ্যে যে সংস্কৃতির আলো আমি দেখেছি, তা হয়তো বেগমের আলো থেকেই এসেছে।

 

বেগম পত্রিকার কয়েকটি প্রচ্ছদ

 

বেগমের প্রায় সূচনালগ্ন থেকেই সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন নূরজাহান বেগম নূরী। জীবনের ইতি টানার আগ পর্যন্ত এ বন্ধন ছিন্ন হয়নি। সাহস নিয়ে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার মতো মানুষের মৃত্যুতে যেন একটি স্বর্ণযুগের পর্দা নেমে এলো। তিনি নিজেই একটি অবিস্মরণীয় ইতিহাস।

 

নূরজাহান বেগমের ‘বেগম সম্পাদক’ হয়ে ওঠার গল্পটাও অন্যরকম। বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘সওগাত’পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা। ১৯১৮ সাল থেকে সওগাত বের করেন। একবার চিন্তা করলেন সাহিত্যচর্চায় মেয়েদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এ চিন্তা থেকে তিনি সওগাতে চালু করলেন মহিলা বিভাগ। দায়িত্ব দিলেন সুফিয়া কামালকে। এরপর মাথায় ভাবনা আসে নারীদের জন্য আলাদা একটি পত্রিকা বের করার। এরপরই শুরু হয় ‘সাপ্তাহিক বেগম’এর যাত্রা।

 

যাত্রা শুরু পর কিছুদিন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন সুফিয়া কামাল। প্রথম চার মাস সম্পাদক হিসেবে এর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পরে ব্যস্ততার কারণে কাজ ছেড়ে দেন তিনি। এরপরই নূরজাহান বেগমের হাতে গড়ে ওঠে বেগম পত্রিকা। বেগমের প্রথম সংখ্যা ছাপা হয়েছিল ৫০০ কপি। মূল্য ছিল চার আনা। প্রচ্ছদে ছাপা হয়েছিল বেগম রোকেয়ার ছবি। পরে ১৯৫০ সালে ঢাকায় চলে আসে বেগম। নতুন ঠিকানা পুরনো ঢাকার পাটুয়াটুলি। গত ৬৬ বছর ধরে এখানেই আছে বেগম পত্রিকা। ১৯৬০ এবং ১৯৭০ দশকে প্রতি সপ্তাহে বেগম পত্রিকার প্রচার সংখ্যা ছিল ২৫ হাজারের মতো। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ডাকযোগে এই পত্রিকা পৌঁছে যেত।

 

বেগম পত্রিকার লেখক ও প্রদায়কদের সঙ্গে নূরজাহান বেগম

 

এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নূরজাহান বেগম বলেন, ‘সে সময় সওগাত অফিসের দোতলায় একটি রুমের মেঝেতে চাদর বিছানো থাকত। সেই চাদরের ওপর প্রতিদিন বিকেলে আসর বসতো। এতে যোগ দিতেন কাজী নজরুল ইসলাম, খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, হবীবুল্লাহ বাহার, ইব্রাহীম খাঁ, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ।’

 

নূরজাহান বেগম আরো বলেন, ‘এই সাহিত্য আসরে চা দিতাম। শুনতাম সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা। হাসি-গল্পে আসরটি মাতিয়ে রাখতেন সবাই। ছোট থাকায় সব আলাপ না বুঝলেও ভালোলাগা থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতাম। এই দাঁড়িয়ে থাকা ও শোনার মধ্য দিয়ে আস্তে আস্তে বই, পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও সাংস্কৃতিক জগতের দিকে ধাবিত হই। কাজী নজরুল ইসলামকে পর্যবেক্ষণ করতাম।’

 

এভাবেই নূরজাহান বেগম (দাদীর নামে নাম নূরী) বেড়ে ওঠেন। হয়ে ওঠেন বেগম পত্রিকার সম্পাদক। ১৯৫২ সালে নূরজাহান বেগমের বিয়ে হয় রোকনুজ্জামান খানের সঙ্গে। তিনি ‘দাদা ভাই’ নামেই অধিক পরিচিত। চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকায় এসে নারীদের ছবি আঁকতে, লেখার জন্য উৎসাহ দিতেন নূরজাহান বেগম। যারা লেখা পাঠাত, তাদের ছবিও ছাপাতেন বেগম পত্রিকায়। প্রথমদিকে পুরুষরাও এতে লিখতেন। তবে পরবর্তীতে এতে শুধুমাত্র নারীরাই লিখতেন।

 

<>

বেগম পত্রিকার ছাপাখানা

 

এরপর ১৯৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে `বেগম ক্লাব` প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট হন বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ, সেক্রেটারি হন নূরজাহান বেগম এবং বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন এর উপদেষ্টা।

 

নূরজাহান বেগম ১৯২৫ সালের ৪ জুন চাঁদপুরের চালিতাতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে পশ্চিমবঙ্গের ভাগলপুরে বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর কলকাতার লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা নেন তিনি। সোমবার রাজধানী ঢাকায় স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ মে ২০১৬/সাইফ বরকতুল্লাহ/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়