ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

নোবেলজয়ী সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ্

মারুফ রায়হান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১৭, ৯ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নোবেলজয়ী সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ্

সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ্

মারুফ রায়হান ||

স্যুটকোট পরিহিত একজন দাঁড়িয়ে আছেন আয়েশি ভঙ্গিতে, ভাবটা পর্যবেক্ষকের। পেছনে সবুজের পটভূমি। দাঁড়ানোর অবয়ব অবিকল মানুষের মতো মনে হলেও লোকটার মাথা কুকুরের। এমন একটা প্রচ্ছদ দেখে প্রবল নাড়া খাই। সে কুড়ি-পঁচিশ বছর আগের কথা। বইটার নাম ‘লাইফ ইজ এলসহোয়্যার’, লেখক মিলান কুন্ডেরা। তখন থেকেই এই লেখক মনের ভেতর জায়গা করে নিয়েছেন। পরে শুনি তিনি নোবেল পেতে চলেছেন। এই চলাটা এক দশক কি হবে না?

এ বছরও তাকে নোবেল দেয়া হলো না। নোবেলের যোগ্য দাবীদার ছিলেন অন্তত আরো দু’জন। অথচ পেলেন কিনা এমন একজন, যার লেখা বাঘা বাঘা সাহিত্য সমালোচকেরাও পড়েননি। বাংলাদেশের অবস্থাও ভিন্ন কিছু নয়। মনে পড়ে বেশ ক’বছর আগে বিশ্বসাহিত্যের পাঠকদের এমনতর ধাক্কা দিয়েছিলেন নোবেল কমিটি। ভাগ্যচক্রে তিনিও ছিলেন নারী। বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গনে প্রায় অনামীই বলা যায় রুমানীয় বংশোদ্ভূত জার্মান লেখিকা হেরটা মুয়েলারকে। জার্মানির বাইরে তাঁর তেমন পরিচিতি নেই। এর আগে অবশ্য জার্মানীর সম্মানজনক ‘ইমপ্যাক ডাবলিন সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেছেন তিনি। নোবেলপ্রাপ্তির পর সে দেশের অপর নোবেলজয়ী লেখক গুন্টার গ্রাস বলেছিলেন, যোগ্য লেখকই এবার নোবেল পেয়েছেন (এমনকি হেরটার অনুজ এক খ্যাতিমান জার্মান সাহিত্যিক চটজলদি প্রবন্ধ লিখে হেরটার গুরুত্ব তুলে ধরেন); তারপরও কথা উঠেছিল ওই মর্যাদাকর পুরস্কারের রাজনৈতিক বিবেচনা নিয়ে।

রুমানিয়ায় জন্মগ্রহণকারী হেরটা মুয়েলার একজন ঔপন্যাসিক, কবি ও প্রাবন্ধিক। রুমানিয়ায় জার্মানভাষি নাগরিকদের নিষ্পেষিত বাস্তব পরিস্থিতির মর্মস্পর্শী বিবরণের জন্য স্বভাষি পাঠকদের ব্যাপক সহানুভূতি পান হেরটা মুয়েলার। নোবেল প্রাপ্তির কল্যাণে বিশ্বব্যাপী এই লেখককে নিয়ে পরে আলোচনার ঝড় ওঠে। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের সাহিত্য সাময়িকীও তৎপর হয় বিশাল আলোকপাতের জন্যে। যদিও নোবেলপ্রাপ্তির আগে এই হেরটা মুয়েলার নামটি একটিবারের জন্যও স্থানীয় পত্রপত্রিকায় আসেনি। অথচ এক সপ্তাহ ব্যবধানে পাওয়া যায় বেশ ক’জন ‘হেরটা মুয়েলার বিশেষজ্ঞ’ এবং পরের শুক্রবারই (১৬ অক্টোবর ২০০৯) ভুরি ভুরি লেখা প্রকাশিত হয়। যদিও ঢাকার বাজারে তাঁর কোনো গ্রন্থই তখন পর্যন্ত আসেনি।

একই অবস্থা সদ্য নোবেলজয়ী সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ্-এরও (জন্ম ১৯৪৮)। এবার এমন একজনকে সাহিত্যের জন্য পুরস্কার দেওয়া হলো যিনি না কবি, না কথাশিল্পী। তাকে বরং সাংবাদিক বললেই যথার্থ শোনায়। তবু এটিকে এখনি অঘটন বলা সমীচীন হবে না। নন-ফিকশন রাইটার হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার বিষয়টি অনুধাবন করে দেখা চাই। এক কথায় বললে বলতে হবে এই লেখক যুদ্ধবিরোধী, নিপীড়নবিরোধী, মানবতাবাদী লেখক। তার লেখার ধরন ভিন্নতর। মানুষের জবানিতেই তিনি তুলে আনেন মানব-দুর্ভোগ। বয়ান ও সাক্ষাৎকাররীতি প্রয়োগ করেন লেখায়। সাংবাদিকতাকে সাহিত্যের মোড়কে পরিবেশনের চল বহু পুরনো। আবার সাংবাদিকতা যে উন্নত সাহিত্যের দৃষ্টান্ত হতে পারে তার প্রমাণ পাই গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজে (অ্যা নিউজ অব এ কিডন্যাপিং-১৯৯৬)।

যাই হোক, সোয়েতলানার বিশেষত্ব বুঝতে হলে ইউক্রেনের চেরনোবিলের পারমাণবিক দুর্ঘটনার ফলে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় নিয়ে লেখা তার বইখানা পড়লে নিশ্চয়ই বোঝা যাবে। ইন্টারনেটের কল্যাণে চটজলদি চোখ বুলোতে বুলোতে আমার মনের পর্দায় যেসব ছবি ফুটছে তাকে উপেক্ষা করে যেতে পারছি না। অভিন্ন অনুভূতি হবে যে কোনো সংবেদনশীল পাঠকেরই। সাহিত্যে মনের মাধুরি মেশানোর বিষয়টি অপরিহার্য। চেরনোবিল ডায়েরি নামে একটা সিনেমা আছে, খুব দেখায় স্টার মুভিজ, এইচবিও। পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে একদল মানুষ কীভাবে ভয়াবহ জন্তুর মতো হয়ে ওঠে, সুস্থ মানুষ পেলেই তাকে ভক্ষণের জন্য উন্মাদ হয়ে ওঠে তারই বয়ান। স্ক্রিপ্ট রাইটার ও পরিচালক সার্থক বটে। এ জাতীয় ছবি মানুষ রুদ্ধশ্বাসে দেখে। নোবেলজয়ী লেখক সোয়েতলানা  এইসব কল্পনার ধার ধারেন না। বানানো ফানানোর মধ্যে তিনি নেই। একেবারে কঠোর কঠিন নির্জলা বাস্তব থেকে উপাদান সংগ্রহ করেন।

সোয়েতলানা ‘ভয়েজেস ফ্রম চেরনোবিল’-এর পিডিএফ কপিতে চোখ বুলোতে বুলোতে আমাদের এমনটা মনে হতেই পারে যে, লেখক (না, আমি তাঁকে সাংবাদিক বলবো না, সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের উর্ধে তার এই রচনা) ভাবীকালের ঔপন্যাসিকদের জন্য রেখে যাচ্ছেন এমন কিছু মৌলিক উপাদান এবং কাহিনীর বীজ- যেখান থেকে তৈরি হতে পারে বহুকৌণিক কথাসাহিত্য। মনে রাখছি, সোয়েতলানার দেশ বেলারুশই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় চেরনোবিল দুর্ঘটনায়। এক দশক আগে প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে লেখক এভাবেই ব্যক্ত করেছেন এ বইটি রচনার অভিজ্ঞতা যা সমীহ জাগানিয়া। তিন বলছেন, ‘আমি বুঝতে পারলাম যে ওখানে (চেরনোবিলে) উপস্থিত আর দশজন সাংবাদিকের মত আমিও একটা বই চাইলে খুব দ্রুত নামিয়ে দিতে পারি। ওই ধরনের বই নেহায়েত কম লেখা হয়নি, কয়েকশো তো হবেই। তাই আমি একটু ভিন্ন পথে অগ্রসর হলাম। সাক্ষীদের সাক্ষ্য নিতে শুরু করলাম, পাঁচ শতাধিক লোকের প্রশ্নোত্তর নিয়েছিলাম, তাতেই আমার দশ বছর চলে যায়। হঠাৎ করে নতুন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছি আমরা- তাই আমি এমন লোকের খোঁজ করছিলাম যারা সেই অভিজ্ঞতায় একেবারে দুমড়ে মুচড়ে গেছেন। আসলে কি ঘটেছিল, সে বিষয় নিয়ে তাদের ভাবতে বলি, সেকেলে রীতিপদ্ধতি দিয়ে তারা যে নতুন পৃথিবীর মোকাবেলা করার চেষ্টা করছেন, সে নিয়ে চিন্তা করতে বলি।’

শুক্রবার সকালে এটি লিখবার সময়ে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বিশিষ্ট অনুবাদক ফজল হাসানকে অনুরোধ করি পাঠকদের জন্য ‘ভয়েজেস ফ্রম চেরনোবিল’ (চেরনোবিলের জবানবন্দি) গ্রন্থটি থেকে ছোট্ট একটু অংশ অনুবাদ করে দিতে। তিনি চটজলদি ‘শব্দবিহীন সঙ্গীত’ অংশটুকু অনুবাদ করে দেন, যা এখানে তুলে দেয়া হলো।

শব্দবিহীন সঙ্গীত
মূল: সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ্  
অনুবাদ: ফজল হাসান

[‘শব্দবিহীন সঙ্গীত’ চেরনোবিলের বিপর্যয়ের নীরব সাক্ষী মারিয়া ভোলছোক নামের একজন প্রতিবেশি মহিলার জবানবন্দি, যা তিনি লেখককে সাক্ষাৎকার হিসেবে দিয়েছেন।]

আপনার সামনে ভিক্ষা চাওয়ার ভঙ্গিতে আমি করজোড়ে হাঁটু গেড়ে বসতে রাজি আছি। দোহাই আপনার, আমাদের আনা সুশকোকে খুঁজে বের করুন। তিনি আমাদের এই কজুশকি গ্রামেই বাস করতেন। তাঁর নাম আনা সুশকো। তাঁর সম্পর্কে আমি আপনাকে সবই বলবো এবং আপনি সেটা টাইপ করে ফেলুন। তিনি ছিলেন কুঁজো এবং জন্ম থেকেই বোবা। তিনি একাকী বাস করতেন। তাঁর বয়স ছিল ষাট। দুর্ঘটনার পরে জনগণকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার সময় তারা তাঁকে অ্যাম্বুলেন্স করে এক অজানা স্থানে নিয়ে যায়। তিনি কোনোদিন লেখাপড়া শিখেননি। তাই আমরা কখনই তাঁর লেখা কোনো চিঠি পাইনি। নিঃসঙ্গ এবং অসুস্থ লোকজনদের বিশেষ এক জায়গায় স্থানান্তরিত করেছে। তারা এসব অথর্ব লোকজনকে লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু কেউ কোনো হদিশ জানে না। এটাও লিখে রাখুন...

মহিলার জন্য আজ  গ্রামবাসী শোকার্ত এবং তাঁর প্রতি একধরনের অনুকম্পা বোধ করছে। আমরা তাঁর দেখভাল করতাম, যেভাবে ছোট মেয়েদের দেখাশুনা করতে হয়। আমাদের মধ্যে স্বেচ্ছায় কেউ একজন তাঁর জন্য কাঠ কেটে আনতো, কেউবা দুধ এনে দিত। কেউ হয়তো তাঁর সঙ্গে বসে খোশগল্প করে বিকেল কাটিয়ে দিত এবং চুলা জ্বালাতো। দুর্ঘটনার পরে আমরা সবাই দু’বছর অন্য জায়গায় বসবাস করেছি এবং তারপর একসময় আমাদের ঘরবাড়িতে ফিরে এসেছি। তাঁকে বলবেন, তাঁর বাড়িটা এখনও বহাল তবিয়তে আছে। ঘরের ছাদ, এমনকি জানালাও, আগের মতোই আছে। তবে যা কিছু ভেঙে গেছে কিংবা চুরি হয়েছে, সেগুলো আমরা অনায়াসে মেরামত কিংবা ঘাটতি পূরণ করতে পারবো। তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন? আপনি শুধু তাঁর ঠিকানাটা আমাদের বলুন। আমরা সেখানে যাবো এবং তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো। তাহলে তাঁকে এক বুক দুঃখ নিয়ে এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে না ফেরার দেশে যেতে হবে না। আমি আপনার কাছে হাতজোড় করে অনুরোধ করছি। একজন নিষ্পাপ বোবা মানুষ অপরিচিতদের মাঝে থেকে শুধু কষ্ট ভোগ করছে ...

তাঁর সম্পর্কে আরেকটা কথা। আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। তিনি যখন দুঃখে কাতর থাকতেন, তখন একটা গানটা গাইতেন। তবে গানের মধ্যে কোনো কথা ছিল না, শুধু ছিল তাঁর কণ্ঠস্বর। তিনি কথা বলতে পারেন না। কিন্তু তিনি যখন কোনো কিছুর জন্য মনে কষ্ট পেতেন, তখন শুধু গাইতেন আ আ আ। এটা যে কারোর মনকে বিষণ্ন করে দিতে পারে।  


(সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ্-এর ওয়েবসাইট থেকে)


 

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ অক্টোবর ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়