ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

পঞ্জিকার প্রকারভেদ || মোসতাফা সতেজ

মোসতাফা সতেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ১৩ এপ্রিল ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পঞ্জিকার প্রকারভেদ || মোসতাফা সতেজ

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

হাট-বাজারে হালখাতার মৃদু আমেজ ছড়িয়ে পড়ে শেষ চৈতি হাওয়ায়। বিকোতে থাকে হরেক রকমের পঞ্জিকা। বইয়ের বাজারে সাহিত্যের বইয়ের কাটতি কমে গেলেও পঞ্জিকার কাটতি এ সময় রমরমা। মোহাম্মদী পকেট পঞ্জিকা ঘরে ঘরে। মুসলিম সমাজের ওপর পঞ্জিকার প্রভাব যতখানি তার চেয়ে বেশি রয়েছে হিন্দু সমাজে। পঞ্জিকার প্রয়োজন কবে থেকে চালু হয়েছে তা জানা না গেলেও এটুকু বলা যায় যে, মানুষ যখন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি লক্ষ্য করেছে তখন থেকেই এই প্রয়োজন চাঙ্গা হয়েছে। আমরা জানি, পৃথিবীর অনেক দেশেই পঞ্জিকা চালু আছে।

খ্রিস্টপূর্ব বারো থেকে তেরো শতকের মধ্যবর্তী সময়ে পঞ্জিকারূপে যে বইটি বেরিয়েছিল বৃটিশ মিউজিয়ামে আজও তা রক্ষিত আছে। মিসরের প্রাচীন পঞ্জিকাতেও কোন দিনে শিশু ভূমিষ্ঠ হলে তার জীবন কেমন হবে তা উল্লেখ থাকত। পশ্চিম বাংলার নদীয়া জেলার শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত রামচন্দ্র বিদ্যানিধিকে দিয়ে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র পঞ্জিকা সংকলন করাতেন। তখন হাতে লেখা পঞ্জিকার দাম ছিল দু’আনা থেকে ষোলো আনা পর্যন্ত। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সচিত্র পঞ্জিকার নাম ‘রামহরি পঞ্জিকা’। ১৮১৮ সালে এটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়।

বাংলা একাডেমি নির্ধারিত বাংলা মাসের তারিখ গণনার নিয়মসহ বাজার ছেয়ে গেছে রকমারি পঞ্জিকায়। বৈশাখ হতে ভাদ্র পর্যন্ত প্রতি মাস ৩১ দিন এবং আশ্বিন হতে চৈত্র পর্যন্ত প্রতি মাস ৩০ দিন। এ ছাড়া ইংরেজি লিপ ইয়ারে ফাল্গুন মাস ৩১ দিন। এসব দিন-ক্ষণ নিয়ে বইয়ের বাজারে এখন ১০ টাকা থেকে ৬০ টাকায় পঞ্জিকা বিক্রি হচ্ছে। কলকাতা থেকেও পঞ্জিকা আসছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পঞ্জিকার প্রভাব যথেষ্ট। এ দেশে চাঁদ দেখা কমিটি গঠনের আগে রমজান, ঈদসহ অনেক ধর্মীয় উৎসব পালন করা হতো পঞ্জিকা দেখে।

যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সাধারণত ভারতীয় পঞ্জিকা মতে পূজা-পার্বণ পালন করে থাকেন। এরও কারণ আছে। তা হলো আমাদের পঞ্জিকার সাথে ওদের একদিন তফাৎ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অস্টাদশ শতক থেকে হিন্দু সমাজের ওপর জ্যোতিষ আর পঞ্জিকার গভীর প্রভাব পড়তে থাকে। হিন্দু সম্প্রদায় চলেন সৌর মাস ধরে। আর মুসলমান চলেন চান্দ্র মাস অনুযায়ী। চাঁদকে বাদ দিয়ে মুসলমানদের কোন ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠিত হয় না। শারদীয় দূর্গা শরতকালে আসেন, কিন্তু ঈদের চাঁদ প্রতি বছর একই সময়ে ওঠে না। তার পরিক্রমা বদলে যায় মাসান্তরে। বিজ্ঞানভিত্তিক পঞ্জিকার প্রধান তথ্য গণনার জন্যে প্রথমেই প্রয়োজন হয় সূর্য ও চাঁদের প্রতিদিনের আকাশে অবস্থানের সঠিক গণনা। এই গণনা এত নির্ভুল হতে হয় যাতে সূর্য ও চাঁদের গণিত অবস্থানের সঙ্গে মহাকাশে দেখা তাদের প্রকৃত অবস্থানের সম্পূর্ণ ঐক্য বজায় থাকে। এর সাথে পঞ্জিকায় দেওয়া বিবরণে যদি পার্থক্য না হয় তা হলে সেই পঞ্জিকাকে বলা হয় ‘দিকসিদ্ধ পঞ্জিকা’। পঞ্জিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল তিথি।

১৮২৫-২৬ সালে মুদ্রিত পঞ্জিকার সরলিকরণ শুরু হয়। এর আগে সাধারণ পাঠক পঞ্জিকার সংক্ষিপ্ত বিবরণ পড়ে কিছুই বুঝত না। তাই দৈবজ্ঞ পণ্ডিতরা তুলোট কাগজে ভুষো কালি আর খাগের কলম দিয়ে ছোট ছোট পুঁথিতে গ্রহ নক্ষত্রের কথা লিখতেন। তার অবস্থান ও মানুষের বাড়ি গিয়ে পঞ্জিকা পড়ে শোনাতেন। ১২৭৭ বঙ্গাব্দের পঞ্জিকায় বাড়তি হিসেবে থাকত জ্যোতিষী, রাশিমালা, খনা ও ডাকের বচন। পীঠস্থানের নাম, বড় শহরের রাস্তাঘাটের নাম, জ্যোতিষীদের ঠিকানা, রেলের নিয়ম। এগুলো ছাড়াও অসংখ্য বিজ্ঞাপনও এতে থাকত।

কবে কী খাওয়া উচিত, কিংবা উচিত নয়, তারও বিধান থাকত একশ বছর আগেকার পঞ্জিকাতে। রবীন্দ্রনাথ তাই ঠাট্টা করেই বলেছেন : ‘আমি ঠিক করিয়া দিলাম, কোন তিথিতে মূলা খাইলে তাহার নরক এবং চিড়া খাইলে তাহার অক্ষয় ফল। তোমরা মূলা ছাড়িয়া চিড়া খাইয়া কী উপকার হইল তাহার কোন প্রমাণ নাই। কিন্তু যাহা অপকার হইল ইতিহাসে তাহা উত্তরোত্তর পঞ্জীকৃত হইয়া উঠিতেছে।’

পঞ্জিকার সাথে একুশ শতকের আধুনিক মানুষের দৈনন্দিন জীবনে মানুষের যোগ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। আমাদের দেশে এখনও ইংরেজি ক্যালেন্ডার মতে ডায়েরি বেরোয়। বেতন পরিশোধ হয়। তারপরেও বাংলা পঞ্জিকার চাহিদা কমেনি। আজকাল পঞ্জিকা ছাপা হচ্ছে নিউজ পেপার ও সাদা কাগজে। পাঠকপ্রিয়তা যত বাড়ছে ততই এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ভারী হচ্ছে। অসংখ্য বিজ্ঞাপন থাকছে। কেবল মাত্র পকেট পঞ্জিকা হিসেবে মোহাম্মদী এখনও চালু আছে।

অপর দিকে বাজারে নবযুগ, লোকনাথ, তারাচাঁদ পঞ্জিকা ছোট ও বড় দু’রকমই পাওয়া যায়। কোন পঞ্জিকা সঠিক তা বলা একটু কষ্টই। তিথি, নক্ষত্র বা যোগের যে সময় দেওয়া থাকে তা নির্ভুল হল কিনা তা প্রমাণ করবে কে? আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘড়ির সাথে মিলিয়ে সেটা বুঝার কোনও উপায় নেই। তারপরও আজকাল অনেকেই নতুন বছরের  জন্য পঞ্জিকা সংগ্রহ করে থাকেন। অনেকের বাড়িতে সাহিত্য পাওয়া না গেলেও পঞ্জিকা পাওয়া যায়।

লেখক : লোক গবেষক


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ এপ্রিল ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়