ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পাকবাহিনীর বুদ্ধিভিত্তিক ঈর্ষা ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড

তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১১, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পাকবাহিনীর বুদ্ধিভিত্তিক ঈর্ষা ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড

তাপস রায় :  কোনো সন্দেহ নেই, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অন্তিম আঘাত। একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নির্বিচারে যে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় তার মর্মন্তুদ সমাপ্তি ঘটে এই নিধন যজ্ঞের মধ্য দিয়ে। শত্রু পরাজয় নিশ্চিত জেনেই স্বাধীন বাংলাদেশকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পঙ্গু করার চেষ্টা করে। সেই থেকে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ১৪ ডিসেম্বর এক করুণ-কঠিন সোপান, কালো দিন।

 

পৃথিবীতে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যে দেশগুলো স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে তারা স্বাধীনতা বা বিজয় দিবস পালন করলেও ‘শহীদ বুদ্ধীজীবী দিবস’ পালন করে এমন নজির মেলে না। এ থেকেই বোঝা যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টাদের সমূলে নিশ্চিহ্ন করতে কতটা শীতল নৃশংসতায় কর্মপরিকল্পনা সাজিয়েছিল। এবং তারা সফলও হয়। স্বাধীনতার ঠিক দুদিন পর ‘দ্য সানডে টাইমস’-এর এক প্রতিবেদনে ঢাকা থেকে সাংবাদিক নিকোলাস টোমালিন লেখেন: ‘... যদি পাইকারি হত্যাকাণ্ডকে সংবাদপত্র গণহত্যা আখ্যায়িত করে, তা অবশ্যই ভযংকর। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে বাছাই করে জাতির সবচেয়ে যোগ্য , বুদ্ধিমান ও গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ ও নারী হত্যার মাধ্যমে যদি একটি জাতির ভবিষ্যত ধ্বংস করে দেওয়া হয়, সেই ‘এলিটোসাইড’ এলিট হত্যা যে আরো বেশি ভয়ংকর। ... বহুদিন থেকেই অনুমান করা হচ্ছিল, পাঞ্জাব মরুভূমির রুক্ষ সেনারা বাঙালিদের প্রতি হিংস্র বর্ণবাদী ঘৃণা লালন করে আসছে। এখন দেখা যাচ্ছে, তারা বুদ্ধিভিত্তিক ঈর্ষাও লালন করছে, যার প্রকাশ ঘটেছে এই ব্যাপক হত্যাকাণ্ডে।’

 

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল তা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তী সংগ্রামী দিনগুলোর দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।  একটি জাতির বিশেষ করে যারা স্বাধীনতার জন্য ক্রমশ বিস্ফোরন্মুখ, অধিকার আদায়ে বেপরোয়া তাদের রাজনীতি, সংস্কৃতি, আদর্শ ও লক্ষ্য নির্মাণে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল জরুরি। এ দেশের কৃতী সেইসব সন্তানের হৃদয়ে দেশমাতৃকার যে প্রেরণা, কণ্ঠে যে কঠোর কর্তব্য-নির্দেশ, মস্তিষ্কে যে স্পর্ধার বীজ- তা তারা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে। যে কারণে একাত্তরের আগেও পূর্ববাংলার বুদ্ধিজীবীরা প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন বিভিন্ন সময়। সেই বীজ থেকে যাতে এই শ্যামল ধরণীতে আর কোনো নতুন চারা না জন্মায় সেজন্যই সুকৌশলে ঘটানো হয়েছিল বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড।  এটি ছিল একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র নির্মাণের বীজতলা চিরদিনের মতো ধ্বংস করে দেওয়ার ঘৃণ্য চক্রান্ত। এই বর্বরতার তুলনা হিটলারের জার্মানি কিংবা ফ্রাঙ্কোর স্পেনের সঙ্গেই কেবল তুলনা করা যায়।

 

১৪ ডিসেম্বর রাতে শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, শিল্পীসহ প্রায় দেড়শ বুদ্ধিজীবী ও বিভিন্ন পেশার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক অপহৃত হয়ে হত্যার শিকার হন। নিহতদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও আনোয়ার পাশা, ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক রশিদুল হাসান, ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, রিডার ড. আবুল খায়ের ও গিয়াসউদ্দিন আহম্মদ, শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের ড. সিরাজুর হক খান, ডা. ফজলে রাব্বী, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজুদ্দিন হোসেন, সেলিনা পারভীন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এই তালিকা আরো বড়, আরো বেদনাবহ। কারণ সেদিন সারা দেশ থেকেই শিক্ষকসহ বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় নিয়োজিতদের লক্ষবস্তু করেই ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়।

 

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাত থেকেই এই ঘৃণ্য কাজটি শুরু করেছিল তারা। পরে ধীরে ধীরে হলেও ডিসেম্বরের ১০ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত তারা তা করতে থাকে অত্যন্ত দ্রুতভাবে। চূড়ান্ত নির্দেশ পেয়ে রাতের আঁধারে গণবুদ্ধিজীবী হত্যার কাজটি সমাধা করেছিল ধর্মীয় সংগঠন জামায়াতের সদস্যদের নিয়ে গঠিত আলশামস ও আলবদর নামের দুটি কুখ্যাত ফ্যাসিস্ট গ্রুপ। পাকিস্তানিরা এই দুটি দল গঠন করেছিল মূলত বিশিষ্ট বাঙালিদের বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনকারী বুদ্ধিজীবীদের সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করার জন্য। তাদের তালিকা থেকে রেহাই পায়নি এ দেশের শত শত চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষাবীদ, চিন্তাবীদ, শিল্পী ও সাহিত্যিক, সংগঠক, সমাজকর্মী, রাজনীতিক, ছাত্র, অসামরিক কর্মকর্তা ও দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা।

 

ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ পাকিস্তানি কমান্ডারদের যখন আত্মসমর্পণের জন্য শেষবারের মতো নির্দেশ দিচ্ছিলেন তখন শত্রুরা কালক্ষেপন করতে থাকে। তারা তখন শেষ আঘাত হানতে মরিয়া। তারা তখন বুদ্ধজীবী হত্যার নীলনকশা আলশামস ও আলবদরদের হাতে তুলে দিতে ব্যস্ত। জেনারেল নিয়াজি তখনও দ্বিধাদ্বন্দ্বে, বৃহৎ শক্তির হস্তক্ষেপের আশায় তখনো পথ চেয়ে আছে তীর্থের কাক হয়ে। কিন্তু প্রতিশ্রুত সামরিক সাহায্য তারা পায়নি। তারা তখন শুধু পরাজয়ের বাস্তবতা মেনে নেওয়ার প্রতীক্ষায় মনে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, না, স্বাধীন বাংলাদেশ আর কখনও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।

 

স্বাধীনতার এতগুলো বছর পর আজ নিঃশঙ্কচিত্তে এ কথা বলা যায়, না, বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি। তরুণ প্রজন্ম শ্রদ্ধাচিত্তে স্মরণ করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের; করবে আগামী প্রজন্ম। তবে এই চেতনা যুগে যুগে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তির। আমরা এ কাজে কতটা সফল তা সময়ই বলে দেবে। আমরা শুধু দেখছি, আমাদের বধ্যভূমিতে আজও জন্মে আগাছার স্তূপ। বুদ্ধিজীবীদের কর্ম ও স্মৃতির ওপর ওড়ে কালের ধূলো। আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা এখনও অবহেলায় মৃয়মাণ। আমরা শুনছি, স্বাধীন বাংলার বাতাসে আজও বীরাঙ্গনার ক্ষোভ মেশানো চাপা কান্না। এখনও সমাজ থেকে পাকবাহিনীর আগাছা সমূলে উৎখাত করা যায়নি। 

 

এই ব্যর্থতার মাঝেও আমরা সান্ত্বনা খুঁজে পাই, বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত কয়েকজন শীর্ষ ঘাতকের বিচার ও শাস্তি কার্যকর হতে দেখে। আমরা ভোরের আলোয় শোকের এই লগ্নে আবিষ্কার করি আমাদের গ্লানি কিছুটা হলেও কমতে শুরু করেছে। এই কর্ম আমরা যেন বিস্মৃত না হই।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়