ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পানি ভেবে রক্ত খেয়েছি

মামুন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০০, ২৩ এপ্রিল ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পানি ভেবে রক্ত খেয়েছি

রানা প্লাজার ভয়াবহ দূর্ঘটনার দুই বছর পূর্ণ হলো আজ । এদিনটি এলেই এক বিভীষিকাময় চিত্র সবার সামনে ফুটে ওঠে। স্মরণকালের ভয়াবহ মানবসৃষ্ট দূর্ঘটনায় ১১শর বেশি মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। আহত হন আড়াই হাজারেরও বেশি শ্রমিক।

 

তাদেরই একজন মাহমুদুল হাসান হৃদয়। ঘটনারদিন রানা প্লাজার ৮তলায় মাননিয়ন্ত্রণের কাজ করছিলেন তিনি। রাইজিংবিডি’র অর্থনৈতিক প্রতিবেদক আব্দুল্লাহ আল মামুনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হৃদয় বর্ণনা করেছেন সেদিনের সেই বিভৎসতার কথা।

 

রাইজিংবিডি : দুর্ঘটনার দিনের কথা কতটুকু মনে পড়ে আপনার?

মাহমুদুল হাসান হৃদয় : সে দিনটার কথা মনে হলে রাতে ঘুমাতে পারিনা। চোখের সামনে লাশ আর রক্ত ভেসে উঠে। আগের দিন ভবনে ফাটল দেখা দিলে আমাদের ছুটি দিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। সেখানকার অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরদিন আমাদের ফোন করে কারখানায় কাজ করতে নিয়ে আসে। আমি তখনও কারখানায় ঢুকিনি। কারখানার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার মত অনেক শ্রমিক ঢুকতে না চাইলেও তাদেরকে জোর করে কারখানায় ঢোকানো হয়। বলা হয়, ‘বাঁচা মরার মালিক আল্লাহ, তোরা কাজ কর।’

 

রাইজিংবিডি : তারপর কি হল?

মাহমুদুল হাসান হৃদয় : বাধ্য হয়ে আমরা কারখানায় ঢুকি। তখন কারখানায় বিদ্যুৎ ছিলো। পরে জেনারেটর চালু করে। জেনারেটর চালু করার ১ মিনিটের মাথায় ভবনটি ধ্বসে পড়ে। আমার তখন মনে হচ্ছিল, আমি নিচের দিকে দেবে যাচ্ছি। আল্লাহকে ডাকতে শুরু করলাম। তারপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

 

রাইজিংবিডি : কতক্ষণ পর আপনার জ্ঞান ফিরে আসে?

মাহমুদুল হাসান হৃদয় : আনুমানিক ২০/২৫ মিনিট পর জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর দেখি আমি একটা ধ্বংসস্তুপের নিচে। অনেক অন্ধকার ছিলো আর আমার প্রচুর পানি পিপাসা পেয়েছিলো। পরে দেখি ওপর থেকে পানি বেয়ে পড়ছে। তখন আমি পানি চেটে খেতে শুরু করলাম। অনেকক্ষণ পর যখন একটু আলোর দেখা মিলল, তখন দেখি পানি না আমি রক্ত খাচ্ছি। এক পর্যায়ে খিদার যন্ত্রণায় পাশের লাশের মাংস ছিড়ে খেয়েছি।

 

রাইজিংবিডি : সেখানে আর কেউ ছিলো?

মাহমুদুল হাসান হৃদয় : আমরা ১২ জন আটকা পড়ে যাই। এরমধ্যে কারো একটি পা, কারো একটি হাত, কারো অর্ধেক শরীর চাপা পড়ে ছিলো। আমি ৩ জনকে চোখের সামনে মরতে দেখেছি। আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো অনেক লাশ। ভয়াবহ এমন মুহুর্তে নিজে বাঁচার তাগিদে প্রস্রাবও খেয়েছি।

 

 

রাইজিংবিডি : তারপর সেখান থেকে আপনি মুক্তি পেলেন কিভাবে?

মাহমুদুল হাসান হৃদয় : আমি এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ১৭ দিন পর জ্ঞান ফিরে পাই। তখন দেখি পঙ্গু  হাসপাতালের বেডে। ডান পা চাপা পড়েছিলো। অবশ হয়ে যাওয়ায় তাতে কোনো বোধশক্তি নেই। পায়ে রড লাগানো আছে। কোমরেও প্রচন্ড ব্যাথা। পঙ্গু হাসপাতালে ১৭ দিন থাকার পর, ঢাকা মেডিকেলে ২২ দিন, তারপর সিআরপিতে। এখনও সিআরপিতে প্রতিদিন যেতে হয়। এ কারণে সিআরপির পাশেই একটি ঘর ভাড়া বসবাস ও নিয়মিত ডাক্তার দেখাই।

 

রাইজিংবিডি : পরিবারে এখন কে কে আছেন?

মাহমুদুল হাসান হৃদয় : রানা প্লাজা ধ্বসের এক সপ্তাহ আগে বিয়ে করেছিলাম। পঙ্গু অবস্থায় হাসপাতালে থাকাকালীন স্ত্রী কিছুদিন আমার সেবা করেছিলো। তারপর বাসায় আসার পর ১৫ দিন প্রায় না খেয়ে থাকি। অভাবের তাড়নায় অন্ত:সত্বা স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলে যায়। শুনেছি সাত মাসের বাচ্চা নষ্ট করে ফেলে সে। আমি অনেক অনুরোধ করেছিলাম বাচ্চাটা নষ্ট না করার জন্য। তবুও সে শোনেনি। এখন পরিবারে শুধু মা-বাবা, এক ছোট ভাই ছাড়া আর কেউ নেই।

 

রাইজিংবিডি : আপনার এখন সময় কাটে কিভাবে?

মাহমুদুল হাসান হৃদয় : এখন আমি বাসায় বসে রানা প্লাজার ভয়াবহ সেইসব দিনগুলো নিয়ে কবিতা লিখি। আমার বন্ধুরা মিলে সাভারে আমাকে একটি ফার্মেসী করে দিয়েছে। আর আমার প্রতিমাসে ৪ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। ফার্মেসীর ওষুধ বিক্রি করে আমি আমার ওষুধের টাকা যোগাড় করি। টাকার জন্য অনেকের কাছে গিয়েছি। কেউ আমাকে সহায়তা করেনি। অনেক মন্ত্রীর কাছে গিয়েছি, তারাও আমাকে সাহায্য না করেননি। আমার খুব খারাপ লাগে যখন আমাকে কেউ পঙ্গু-ল্যাংড়া বলে ডাকে। এখন আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। রানা প্লাজা আমার পুরো পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

 

রাইজিংবিডি : আপনার কিছু চাওয়ার আছে?

মাহমুদুল হাসান হৃদয় : আমি এই পর্যন্ত বিকাশের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা পেয়েছি। শুনেছি তা নাকি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে দেওয়া হয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে আর কোনো চিকিৎসা সহায়তা পায়নি। অভাবের তাড়নায় এক সময় আমি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম। আমি শুধু ভালোভাবে বেঁচে থাকতে চাই।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ এপ্রিল, ২০১৫/মামুন/সন্তোষ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়