ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

পান্ডার রাজ্যে || শান্তা মারিয়া

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫৭, ২৪ নভেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পান্ডার রাজ্যে || শান্তা মারিয়া

আদুরে পান্ডা

(চকবাজার টু চায়না- সপ্তম কিস্তি) : ‘গুন্ডাপান্ডা’ শব্দটি প্রচলিত থাকলেও চীনের পান্ডারা মোটেই গুন্ডা নয়। বরং উল্টো। পান্ডা অত্যন্ত নিরীহ গোছের প্রাণী। অবশ্য তেমন কোণঠাসা হলে পান্ডাও আক্রমণ করে বসতে পারে, তবে তেমনটি সচরাচর ঘটে না। যাই হোক চীনে এসে পান্ডা দেখাটা রীতিমতো ফরজ। তাই ডিসেম্বরের এক ভোরবেলায় শিহাব আর আমি রওনা হলাম বেইজিং জুর উদ্দেশে। পৃথিবীর বিখ্যাত ও সুন্দর চিড়িয়াখানার মধ্যে বেইজিং জু অন্যতম। শহরের মধ্যেই বেইজিং জু মূলত মিং সম্রাটদের আমলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

 

বিশাল এলাকা নিয়ে এই চিড়িয়াখানা। এর ল্যান্ডস্কেপ অপূর্ব সুন্দর। চীনের যে কোনো পার্ক যেমন জলাশয়, পাহাড়, বাগান, ভাস্কর্য নিয়ে গড়ে ওঠে, এই চিড়িয়াখানাও তার ব্যাতিক্রম নয়। বিশেষ করে বাঘের একটি বিশাল ভাস্কর্য রয়েছে যা শিল্প হিসেবে অনবদ্য। চিড়িয়াখানায় ঢুকে চোখ জুড়িয়ে গেল ভিতরের ল্যান্ডস্কেপে। যদিও তখন ডিসেম্বর মাস। বেশ শীত। হাত-পা জমে যাওয়ার অবস্থা। দিনটা রোদেলা। বেইজিংয়ের উত্তাপহীন বিশেষ রোদ মন ভালো করে দিলেও শীতের হাত থেকে একটুও বাঁচাতে পারে না।

 

চিড়িয়াখানায় প্রথম গেলাম পান্ডার আস্তানায়। পান্ডার জন্য বরাদ্দ বিশাল একটি এলাকা। চীনের জাতীয় পশু। একে নিয়ে চীনাদের আহ্লাদের সীমা নেই। বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী বলে অবশ্য সারা পৃথিবীতেই এদের কদর। চীন সরকার এদের সংরক্ষণে খুব উদ্যোগী। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এদের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে জোরে শোরে। পৃথিবীর খুব বেশি চিড়িয়াখানায় পান্ডা নেই। চীন সরকার পান্ডা বিক্রি করে না। অন্য চিড়িয়াখানায় ভাড়া দিতে পারে। যেসব চিড়িয়াখানা চীন সরকারের কাছ থেকে পান্ডা ভাড়া নেয় তাদের প্রতিবছর এ জন্য বেশ মোটা টাকা দিতে হয়। ফলে পান্ডাকে রোজগারী প্রাণীও বলা যায়।

 

কাচে ঘেরা বিশাল এক এলাকায় তাদের থাকার ব্যবস্থা। এই কাচের প্যাভিলিয়নের ভিতরে পান্ডার জন্য সবচেয়ে আরামদায়ক আবহাওয়া বিরাজ করছে। পান্ডারা বাঁশের কচি ডগা খেতে পছন্দ করে। তাদের জন্য বাঁশ ঝাড় রয়েছে সেখানে। আরও রয়েছে তাদের বিভিন্ন পছন্দের খাবার। পান্ডা ভীষণ অলস প্রাণী। অমিশুকও। এরা একা থাকতেই ভালোবাসে। ভিতরে দেখলাম কয়েকটি পান্ডা গাছের ডালে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। দুয়েকটি বাচ্চা পান্ডা খেলা করছে। শিহাবুর রহমান ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পান্ডার ভিডিও করার জন্য। আমারও খুব মজা লাগছিল পান্ডা ছানাদের দেখতে। দেখলেই সফট টয়েজ বলে মনে হয়। চীনে আদুরে পান্ডা বলে একটা কথা খুব প্রচলিত। বাচ্চাদের আদুরে পান্ডা বলে ডাকে বাবা-মায়েরা। চীনা ভাষায় পান্ডাকে বলে শিয়ান মাও। আমার এক সহকর্মী লিলিকে শিয়ান মাও বলে ডাকে তার বন্ধুরা।

 

বেইজিং অলিম্পিকের মাসকটও ছিল পান্ডা। চীনারা ব্যবসায় দারুণ পাকা। পান্ডার প্যাভিলিয়নের ভিতর বিক্রি হচ্ছে বেইজিং অলিম্পিকের ছবিওয়ালা পান্ডার নানা রকম স্যুভেনির। চাবির রিং, কলম, কলমদানি, ফুলদানি থেকে শুরু করে হরেক রকম জিনিস। পান্ডার সফট টয়েজও প্রচুর। কম দাম থেকে শুরু করে বেশি দামের জিনিস রয়েছে। পকেট বুঝে যার যা পছন্দের জিনিস কিনছে। আমিও ৩০ ইউয়ান দিয়ে একটা পান্ডা পুতুল কিনলাম।

 

কাচের মতো লেক

 

বেইজিং চিড়িয়াখানা বিশ্বে বিখ্যাত। ২২০ একর এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা এই চিড়িয়াখানায় ৯৫০ প্রজাতির ১৪ হাজার ৫০০ জীবজন্তু রয়েছে। বিরল প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে এখানে রয়েছে সোনালি নাক বানর, দক্ষিণ চীনাবাঘ, সাদাঠোঁট হরিণ, ক্রেস্টেড ইবিস, চীনা কুমির, চাইনিজ জায়ান্ট স্যালামান্ডার, সাইবেরিয়ান টাইগার, ইয়াক, স্নো লেপার্ড, তিব্বতী হরিণ, চমরী গাই এবং কিয়াং।

 

বিশ্বের খুব কম চিড়িয়াখানাতেই গোরিলা রয়েছে। বেইজিং জু তাদের অন্যতম। এখানে বেশ কয়েকটি গোরিলা আছে। আরও আছে সিংহ, জাগুয়ার, ক্লাউডেড লেপার্ড, এশীয় ও আফ্রিকান হাতি, গন্ডার, হিপোপোটোমাস, কালো ভালুক, মেরুভালুক, টাপির, সামুদ্রিক কচ্ছপ, পেঙ্গুইন, ক্যাংগারু, শিম্পানজি, মুন্টজাক,অ্যাডাক্স, জেবরা, ভোঁদর, লেমুর, ফ্লেমিংগো ইত্যাদি। পৃথিবীর পনেরো প্রজাতির সারসের মধ্যে তেরটি রয়েছে বেইজিং চিড়িয়াখানায়। আরও রয়েছে অসংখ্য জাতের পাখি, সাপ, ইত্যাদি। বেইজিং চিড়িয়াখানায় একটা বিশালাকার অ্যাকুরিয়াম রয়েছে। যেটি বিরাট এলাকা নিয়ে অবস্থিত। সেখানে রয়েছে ডলফিন থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণী।

 

আমরা বাঘের দেশের মানুষ। তাই খুঁজে খুঁজে বাঘের এলাকায় গিয়ে হাজির হলাম। মুনজালা হু বা রয়েল বেঙ্গল টাইগারও রয়েছে এখানে। রয়েছে সাদা বাঘ, সিংহ, বিশালাকার সাইবেরিয়ান টাইগার। এতসব জীবজন্তুর ভিড়ে আমাদের রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে বড় আপন মনে হল। বললাম, মামা, বিদেশে আছ, দেশের জন্য মন কাঁদে না?

 

বাঘমামা উত্তর দিলেন, হালুম, কাঁদে ভাগ্নি, কিন্তু তোমাদের মতোই পেটের দায়ে বিদেশে চাকরি করছি। তোমরা হয়তো দেশে ফিরতে পারবে। কিন্তু আমার তো আর জীবনেও সুন্দরবনে ফেরা হবে না।

 

বাঘমামার জন্য মনের কোণে ব্যথা নিয়ে অন্য এলাকার দিকে চললাম। লেকের পানি জমে কাচের মতো হয়ে আছে। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম সেই বরফ জমা লেকের ভিতরে লালনীল মাছ দেখা যায়। তার মানে নিচের পানি এখনও জমেনি। বড় সুন্দর সেই দৃশ্য।

 

চীনে বিভিন্নস্থানে বেড়াতে গিয়ে আমাদের মতো বিদেশীদের প্রতি স্থানীয় জনগণের ব্যাপক কৌতুহল দেখেছি। কোথাও গেলেই চীনারা এসে আলাপ করতে চায়। পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে। বিশেষ করে আমার কপালের টিপের প্রতি তাদের বিপুল আগ্রহ। এবারেও তার ব্যাতিক্রম হলো না। অন্য সময়ে বিষয়টা উপভোগ করলেও এবার একটু অস্বস্তি বোধ করলাম। কারণ চিড়িয়াখানায় এসে মানুষ জীবজন্তুর খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে। আমার সঙ্গে চীনাদের ছবি তুলতে চাওয়ার ব্যাপক আগ্রহের ফলে নিজেকে কিছুটা ‘এক্সিবিট’ বলে মনে হচ্ছিল।

 

চিড়িয়াখানাটায় বেজায় বড়। জীবজন্তু খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। তবে স্থির করেছি গোরিলা দেখতেই হবে। তাই খুঁজে খুঁজে গোরিলার বাড়ির সামনে এসে পড়লাম। গোরিলার বাড়ির সামনের চত্বরে অনেকগুলো প্রমাণসাইজ গোরিলার মূর্তি। নানা ভঙ্গিমায় গোরিলা রয়েছে এখানে। কোনো কোনোটার পিঠে চড়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। শিশুরা চড়ছে সেইসব পুতুল গোরিলার কোলে পিঠে। জীবন্ত গোরিলাদের রাখা হয়েছে কাচের বিশাল ঘরের ভিতর। ভিতরে গাছ, বাড়ি সবই রয়েছে। কাচের ঘরের ভিতর তাদের উপযোগী পরিবেশ। হা করে গোরিলার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, শিহাব মনে করিয়ে দিল অন্যান্য জীবজন্তু দেখা বাকি রয়েছে, বিশেষ করে পেঙ্গুইন। পেঙ্গুইনের ঘরও বিশাল। কাচের অ্যাকুরিযামের মধ্যে রয়েছে মেরু এলাকার পরিবেশ। পানিতে ভাসছে বরফের চাঁই। তার মধ্যে সাঁতরে বেড়াচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে পেঙ্গুইন। দারুণ লাগলো।

 

বেইজিং জু’তে বাঘের ভাষ্কর্য

 

পথনির্দেশ খুঁজে খুঁজে বিভিন্ন দিকে যাচ্ছি। ঘুরতে ঘুরতে পাখির এলাকায় এসে পড়লাম। বিশাল লেক। তার মধ্যে বিকেলের আলো এসে পড়েছে। রং বেরঙের অসংখ্য পাখি সেখানে। ঝাঁক বেঁধে উড়ছে, পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে। লেকের এই অংশের পানি কৃত্রিম উপায়ে জমে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা হয়েছে। ফলে জলজ পাখিরা স্বচ্ছন্দে ঘুরছে এখানে। সে যে কি অপূর্ব দৃশ্য। মনে হচ্ছিল স্বপ্নের জগৎ। স্বপ্ন ভাঙিয়ে শিহাবুর রহমান মনে করিয়ে দিলেন ফিরতে হবে।

 

চিড়িয়াখানা এত বিশাল যে একদিনে তো দূরের কথা কয়েকদিনেও পুরো এলাকা দেখে শেষ করা সম্ভব না। এদিকে শীতে আর খিদেয় জান যায়। শুধু বিস্কিট আর চিপস নিয়ে চিড়িয়াখানায় ঢুকেছিলাম। সকাল থেকে সারা দিন কেটে গেছে। বিকেল প্রায় পাঁচটা। এখন পেটের মধ্যে ছুঁচোরা হাডুডু খেলছে। শীতে হাত পা লেকের পানির মতো জমে যাওয়ার উপক্রম। তাই চিড়িয়াখানাকে বিদায় জানিয়ে পাড়ি জমালাম ম্যাকডোনালডসের দোকানের উদ্দেশে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ নভেম্বর ২০১৫/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়