ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

পাহাড়ি নদীর পাড়ে এক রাত

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ১৬ এপ্রিল ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পাহাড়ি নদীর পাড়ে এক রাত

বাঘের মুখ যাওয়ার পথে খানিক বিরতি

ফেরদৌস জামান

আয়তনের দিক থেকে ছোট্ট একটা দেশ হলেও বাংলাদেশে রয়েছে কম বেশি প্রায় ৪৫টি জাতি ও জাতিসত্তার বসবাস। আবার এই জাতি-গোষ্ঠীগুলোর মাঝেই রয়েছে নানান ধর্মের অনুসারী। ধর্মগুলো কেন্দ্র করে রয়েছে একেক ধর্মের একেক উৎসব। যেমন মুসলমানদের দুই ঈদ, হিন্দুদের দুর্গাপূজা, খ্রিস্টানদের বড়দিন, বৌদ্ধদের বৌদ্ধপূর্ণিমা ইত্যাদি। অপরাপর ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মতো খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বড়দিন এ দেশে বেশ জাকজমকভাবে পালিত হয়। দেশের তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম (অনুসারীর সংখ্যা অনুপাতে) হিসেবে এর গুরুত্ব রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত রয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের খ্রিস্টানরাও বেশ ঘটা করে এ দিন পালন করে।

পার্বত্য অঞ্চলের খ্রিস্টানদের একটি অংশ পুরনো ধর্ম বিশ্বাস ত্যাগ করে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছে। এ জন্য দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা অনেকাংশে দায়ী। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে খ্রিস্টান মিশনারীরা তাদের ধর্ম প্রচার ও প্রসারে সেসব এলাকায় মনোনিবেশ করেছে। যে কারণে পার্বত্য এলাকার বৃহৎ জনগোষ্ঠী খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী। তিন্দু বাজারের সুবাস ত্রিপুরা এবং তার স্ত্রীর নিমন্ত্রণ পেয়ে সাজানো হলো এবারের ভ্রমণ পরিকল্পনা।

২৪ ডিসেম্বর রাতে সায়দাবাদ থেকে বাসে উঠতে ব্যর্থ হওয়ায় শেষ ভরসা হলো ট্রেন। কিন্তু সময় মত রেল স্টেশনে পৌঁছতে পারা আমাদের জন্য সহজ ছিল না। তারপরও কমলাপুর গিয়ে দেখি চট্টগ্রাম মেইল আছে। কিন্তু এখানেও বিপত্তি। কোনো টিকিট নেই। এখন উপায় একটাই, যেতে চাইলে নিরাপত্তা রক্ষিদের জন্য বরাদ্দ মালবগিতে যেতে হবে। তাতেই সই। মাথাপ্রতি দেড়শ টাকায় চট্টগ্রাম। আমরা উঠে পড়লাম। আমাদের দেখাদেখি আরো অনেকে উঠলেন। এক পর্যায়ে লোকে ঠাসাঠাসি হয়ে গেল। সস্তার তিন অবস্থা যাকে বলে! পুরনো কার্টন ও চট বিছানো ঢালাও বিছানায় বসে পড়লাম সবাই। গাড়ি চলতে শুরু করল বটতলী (চট্টগ্রাম রেলস্টেশন) উদ্দেশে।

পরদিন সকালে ট্রেন থেকে নেমে সময় মত বাস টার্মিনাল পৌঁছলেও বান্দরবানগামী বাসে কোনো আসন পেলাম না। পরের বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হবে বেলা দেড়টা পর্যন্ত। অথচ তখন বাজে মাত্র সাড়ে নয়টা। উৎসবে যোগ দিতে পারার অনিশ্চয়তা তখন অধিকতর স্পষ্ট হয়ে উঠল। সুতরাং দেরি না করে মেইল বাসে রওনা হলাম সাতকানিয়া পর্যন্ত। সেখান থেকে অন্য বাসে বান্দরবান। পথিমধ্যে যানজটে আটকে গেলাম। জটের হেতু বড়দিনের সরকারি ছুটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শুক্র, শনি দুই দিন। ফলে ভ্রমণপিয়াসীরা ছুটছে কক্সবাজার, বান্দরবানসহ ওই পথের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রে। কয়েক ঘণ্টার জট শেষে বান্দরবান পৌঁছে জানতে পেলাম, থানচীগামী  দিনের শেষ বাসটিও ছেড়ে গেছে মাত্র  কয়েক মিনিট আগে। এখন জিপ রিজার্ভ করে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু ভাড়া বহুগুণ বেশি। পর্যটক গিজগিজ করছে শহরে। হোটেলে থাকার জায়গা নেই। থাকলেও এমন সব হোটেলে রুম আছে যেখানে এক রাত থাকলেই পকেট ফাঁকা হয়ে যাবে।

সুতরাং জিপেই যাব ভাবলাম। ভালো হয় আরেকটি দল পাওয়া গেলে। সে রকম দলের খোঁজ করেও পাওয়া গেল না, ফলে আমাদেরও আর জিপ ভাড়া করা হলো না। যাও বা একটি দল পেয়েছিলাম তারা আমাদের প্রস্তাব খুব একটা পাত্তা দিল না। কারণ তারা নিজেরাই জিপের ব্যবস্থা করে ফেলেছে। এবং একটু পর আমাদের মুখের সামনে দিয়ে তারা সোল্লাসে চলে গেল হাই, বাই, টাটা কিছু না বলেই। এমন পরিস্থিতিতে উৎসবের কথা ভুলে রাতে বান্দরবান থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত  নিতে বাধ্য হলাম। পাশাপাশি এও ভেবে রাখলাম, এতো দূর যখন এসেছি তখন থানচী থেকে সাঙ্গুর উজানে যেতে যেতে যেখানে ভালো লাগবে সেখানেই আস্তানা গাড়ব। তবে বাঘের মুখ আমাদের প্রথম পছন্দ।

মোড়ে ছোলা-পিঁয়াজুর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দোকানী আমাদের অবস্থা দেখে বলল, জায়গা না পেলে শেষ ভরসা হিসেবে আমার এখানে চলে আসবেন, মেঝেতে পাটি বিছিয়ে দেব। কিন্তু আমাদের ইচ্ছা শহরের ধনেশ মোড় ও লোহার সেতুর মাঝামাঝি মসজিদে থাকার। আমরা ইমাম সাহেবকে গিয়ে বললাম। ইমাম সাহেব সব শুনে বললেন, সকলেই মুসলমান তো? নামাজ শেষ হোক দেখি কি করা যায়।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি অবলোকন করছিলাম। এমন সময় পেছনের বস্তির এক চাচা (ইউসুফ) আমাদের বিপদে এগিয়ে এলেন। তিনি ‘আসেন আমার সাথে, দেখি কি করা যায়’ বলে আমাদের নিয়ে চললেন বস্তির ঘরে। কাঠের দোতলা ঘর। নিন্ম আয়ের মানুষেরা ভাড়া থাকে। একটি ঘর ফাঁকা থাকায় শেষপর্যন্ত সেখানেই থাকার ব্যবস্থা হলো। টাকাপয়সা দিতে হয়নি। বরং আমাদের থাকার জায়গা দিতে পেরে তিনি খুশি!

পরদিন ভোর এবং সকালের থানচীগামী বাসের সব টিকিট আগের দিনই বিক্রি হয়ে গেছে। আমাদের এ যাত্রায় বিপত্তি আর পিছু ছাড়ছে না! কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে জানলাম, ছাদে যাওয়া যাবে। শীতের সকাল, সে ঝুঁকি নেওয়ার সাহস হলো না। হতাশ হয়ে হাঁটাহাটি করছি। বড় রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে যেতেই ট্রাক পেয়ে গেলাম। পাঁচজন এক হাজার টাকা মিটিয়ে উঠে পরলাম। ট্রাকে ওঠায় লাভ হলো এই, পাঁচ ঘণ্টার জায়গায় থানচী বাজার পৌঁছে গেলাম মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টায়। ট্রাক থেকে নেমেই দেখা হয়ে গেল সেই দলের সঙ্গে। আমাদের দেখে হিসাব মিলাতে না পেরে তারা যেন গোলকধাঁধায় পড়ে গেল। আমরা এবার উল্টো তাদের পাত্তা দিলাম না। আমরা গন্তব্যে রওনা হলাম। বাঘের মুখ গিয়ে উপস্থিত হতেই দোকানী চিনতে পারলেন। স্ত্রীকে চা দিতে বলে জানতে চাইলেন, এবার কোথায় যাওয়ার পরিকল্পনা?
যখন জানলেন তার এখানেই আমরা এসেছি তখন অকৃত্রিম হেসে স্ত্রীর দিকে নির্দেশ করে বললেন, দেখ, এরা কী বলছে শুনেছো?

হিমালয়ের পাদদেশে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। তার ক্ষুদ্র একটা অংশজুড়ে পার্বত্য অঞ্চল। বর্ষা বিদায় হয়েছে ক’মাস আগে অথচ সবুজে ঢাকা পাহাড়ে তার স্পন্দনের সতেজতা ছড়িয়ে আছে। পাখির ডাক, মেঘ-কুয়াশার বিচরণ আর বাতাসে কলতান, সব মিলিয়ে এক আহামরি সাজে রাঙানো চারপাশ। পাথরের সুউচ্চ দেয়ালের ফাঁকফোকড় দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া সাঙ্গু, তার ধারে অস্থায়ী বসতিটা দিনে দিনে এতটা আপন হয়ে উঠল!  চা পান শেষে আশপাশটা ঘুরে দেখা হলো। হরিণের শুঁটকি কয়েকবার খাওয়া হয়েছে কিন্ত আস্ত হরিণ কীভাবে শুকিয়ে রাখা হয় তা দেখা হয়নি। নিকটেই বাঁশের ডগায় চামড়া ছিলে ঝুলিয়ে রাখা একটা মাঝারি আকারের হরিণ দেখলাম। জানতে চাইলে বলল, শুঁটকি বানানোর জন্য রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে।

কথা বলছিলাম, এমন সময় দোকানী দাদার তিন সন্তান এলো। ওদের বয়স পাঁচ থেকে দশের মধ্যে। সকলেই নাচ-গান জানে। এনজিও’র স্কুলশিক্ষিকা শিখিয়েছে। তাদের প্রকৃত বাড়ি রেমাক্রি বাজারে। শুকনো মৌসুমে বাঘের মুখ এসে দোকান পাতে। যাতায়াতের মধ্যবিরতিতে যাত্রীরা এই দোকানে চা-বিস্কুট অথবা ভাত খায়। ব্যবসা তাতে মন্দ হয় না। তাই স্ত্রী পরিবারসহ এসে দোকান ঘরের সাথে অস্থায়ী নিবাস গড়ে তুলেছেন তিনি।
 
পথে তিনশ টাকা কেজি দরে আড়াই কেজি ওজনের একটা পাহাড়ি মুরগি কিনেছিলাম ঝলসে (বারবিকিউ) খাওয়ার জন্য। বিকেল থেকে শুরু হলো মুরগি কাটা। সূর্য ডুবে যাওয়ার আগেই সাদা মেঘের আড়ালে ঢেকে গেল লাল টকটকে সূর্য। পাহাড়ি সনাতন পদ্ধতিতে মুরগি ঝলসানোর আয়োজন চলল। আশপাশ থেকে সংগ্রহ করা কাঠ ও বাঁশে ক্যাম্পফায়ার প্রস্তুত হলো। তার নিকটেই মাংস ঝলসানোর মাচা প্রস্তুত করলাম। ক্যাম্পফায়ারের গনগনে কয়লা মাচার নিচে স্থানান্তরিত করে তার উপর একাধিক চোখা কাঠিতে মাংস গেঁথে সাজিয়ে দিলাম। এরই এক ফাঁকে বাচ্চারা নাচ-গান ও অভিনয় করে দেখাল। এক ঘণ্টার মধ্যেই মাংস খাওয়ার উপযোগী হয়ে গেল। হুটহাট আয়োজনের সাফল্যজনিত তৃপ্তিতে ঘুঁচে গেল বড় দিনের উৎসবে যোগ দিতে না পারার ব্যর্থতা।

 
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ এপ্রিল ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়