ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পীত সাগরের তীরে || শান্তা মারিয়া

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৭, ১৭ আগস্ট ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পীত সাগরের তীরে || শান্তা মারিয়া

সাগরতীরে চীনা বন্ধুর সাথে লেখক

চকবাজার টু চায়না : পর্ব-১৩
বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে আছি। সাগরের ঢেউ ভিজিয়ে দিচ্ছে পায়ের পাতা। দূরে দিগন্তে নীল আকাশ মিশে গেছে নীল সাগরের সাথে। দাঁড়িয়ে আছি পীত সাগরের তীরে ছিং তাও সমুদ্র সৈকতে।

আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতিগুলোর অন্যতম হলো ছিং তাও শহরে কাটানো কয়েকটি দিন। উত্তর পূর্ব চীনের পূর্ব উপকূলে ইয়েলো সি বা পীত সাগরের তীরে অবস্থিত ছিং তাও শহর। ইংরেজিতে কিউ বর্ণ দিয়ে লেখা হয় বলে বাঙালি পর্যটকরা অনেকে ‘কিং দাও’ বলেন। কিন্তু আসল উচ্চারণটা হবে ছিং তাও। শান তং প্রদেশের একটি বড় শহর। বেশ বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র। পাহাড় ও সমুদ্র মিলিয়ে দুর্দান্ত সুন্দর শহর! আধুনিক শিল্পকেন্দ্রও।

 

নাম ইয়েলো সি হলেও দারুণ সুন্দর নীলসাগর। ইয়েলো সি নামকরণ করেছে ইউরোপীয়রা। কারণ এই সাগরের তীরবর্তি দেশে বাস করে হলুদ বর্ণের চীনা মানুষ।

ছিং তাও-এর সমুদ্র সৈকত যেমন সুন্দর তেমনি এই শহরে আছে দারুণ সব ঐতিহাসিক নিদর্শন, রয়েছে মান মন্দির বা অবজারভেটরি, অলিম্পিকের সময় বানানো চমৎকার সব স্থাপনা আর প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের শিল্পীদের বানানো দুর্দান্ত সব ভাস্কর্য।

‘ছিং’ শব্দের মানে সবুজ-নীল বা ফিরোজা আর ‘তাও’ মানে দ্বীপ। ফিরোজা রঙের দ্বীপ হলো ছিং তাও। এখানকার এয়ারপোর্টটাও দেখার মতো। এটা বিশেষভাবে সুন্দর করা হয়েছে বেইজিং অলিম্পিকের সময়। এই শহরে বেইজিং অলিম্পিকের ওয়াটার ইভেন্ট হয়েছে বেশ কয়েকটা। রেলস্টেশনটি সমুদ্রের তীরে। এটিও ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য রীতিতে তৈরি।

সমুদ্র তীরে অলিম্পিকের জ্বলন্ত মশালের চমৎকার একটি ভাস্কর্য রয়েছে। বিশেষ করে সন্ধ্যায় সেই মশালের মধ্যে এমন কায়দায় আলো জ্বলে যে মনে হয় আগুনের শিখাগুলো কাঁপছে। এই সমুদ্র তীরে রয়েছে অনেক দীর্ঘ হাঁটাপথ। এই হাঁটাপথ উপকূল ধরে চলে গেছে মাইলের পর মাইল। পুরো পথটা বাঁধানো। পথের ধারে সুন্দর সব ভাস্কর্য আর পাথরের বেদী রয়েছে। কেউ ক্লান্ত হয়ে পড়লে বসতে পারবে। ফুলের বাগান রয়েছে বসন্তের সবুজ আর রং বাহারি সম্পদ নিয়ে।

অলিম্পিকের মশাল

 

২০১৩ সালের এপ্রিলে ছিং তাওতে গিয়েছিলাম আমি ও সহকর্মী শিহাবুর রহমান। শান তং প্রদেশে তখন বসন্ত বা গ্রীষ্মের শুরু। আবহাওয়ায় হালকা শীতের আমেজ। দারুণ ভালো লাগছিল সমুদ্র সৈকতের বাঁধানো পথ ধরে হাঁটতে।

বিকেলে সমুদ্র তীর ধরে হাঁটছি, চোখে পড়লো এক অদ্ভুত দৃশ্য। ডুবুরির পোশাক পরা একজন লোক সেই সমুদ্রের তীর ধরে এগিযে যাচ্ছে সাগরের পানিতে নামার জন্য। কী ঘটনা দেখার জন্য দাঁড়ালাম। বেইজিংবাসীদের চীনা ভাষা কিছু কিছু বুঝি। কিন্তু ছিং তাও শহরবাসীরা চীনা ভাষা বলে নিজস্ব এক উচ্চারণে। বোঝার সাধ্য আমাদের দু’জনের নেই। ভিড়ের মধ্যে একজনকে পাওয়া গেল যিনি ইংরেজি বলতে পারেন। তিনি আমাদের বুঝিয়ে বললেন ঘটনা কিছুই নয়। মুক্তা সংগ্রহের জন্য এই ডুবুরি সাগরে ডুব দিচ্ছেন। ভাবলাম, মুক্তা তুলবেন ভালো কথা, কিন্তু এই অবেলায় কেন? চীনারা অবশ্য বেলা অবেলা মানে বলে মনে হয় না। ওরা কর্মী জাতি। বুঝলাম সাগরের জোয়ারভাটার কোনো একটা হিসেব নিকেশ আছে এখানে।

এই হাঁটা পথটার ধারে ধারে অনেক দোকান পাট। তবে সেটা সাগর তীরের দৃশ্যকে মাটি করে নয়। বরং এমন সুন্দর ঐতিহ্যবাহী রীতিতে কুঁড়েঘরের আদলে তৈরি এসব দোকান যে দেখতে ভালোই লাগে। কি পাওয়া যায় এসব দোকানে? আমাদের কক্সবা্জার আর বার্মিজ মার্কেটে যেসব জিনিষ মেলে সেগুলোতো আছেই। মানে, অনেক নকশার মুক্তার আর বিভিন্ন পাথরের মালা, শামুক ঝিনুকের গয়না, বিভিন্ন শোপিস। আর কাপড়চোপড় চৈনিক হস্তশিল্প এসবও রয়েছে। বেইজিংয়ের তুলনায় মুক্তার মালা বেশ সস্তা। এমনকি কক্সবাজারের তুলনাতেও সস্তা।  ভাবতে অবাক লাগে এত কম দামে মুক্তা বেচে কিভাবে। জানি যে চাষ করা মুক্তা। তবু যতই হোক মুক্তা তো।
ইয়েলো সির তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সাগরের বুকে টুপ করে খসে পড়লো সূর্য। সন্ধ্যার আলো-আঁধারির মধ্যে অপূর্ব সৌন্দর্য নিয়ে জ্বলে উঠলো অলিম্পিকের মশাল। শুধু মশালই নয়, আরো অনেক আলোর খেলা চোখে পড়ে অনেক খানি জায়গায়। সমুদ্র তীরে রেস্টুরেন্টও প্রচুর। এখানে স্থানীয় খাবারের দোকান রয়েছে। আর ম্যাকডোনাল্ডস তো আছেই।

এখানকার সি-ফুড বিখ্যাত। সামুদ্রিক চিংড়ি, ঝিনুক, কাঁকড়া, ছোট্ট ছোট্ট অক্টোপাস, সিউইড, সিহর্সসহ অনেক রকম জানা অজানা সামুদ্রিক খাবার রয়েছে তীরের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে। আমার মতো বাঙাল অবশ্য চিংড়ি মাছের কাঙাল হবে বলাই বাহুল্য। তাছাড়া চিংড়ি খাওয়াটাই নিরাপদ বোধ করলাম।

ইয়েলো সির সৈকতে

 

ছিং তাওয়ের ইতিহাস খুব প্রাচীন। ছয় হাজার বছর ধরে এখানে মানুষের বসবাস রয়েছে। খ্রীস্টপূর্ব ৭৭০-২৫৬ পর্যন্ত পূর্ব চৌ রাজবংশের শাসনামলে এখানে বড় নগর ছিল। শহরটির প্রাচীন নাম ছিল ‘চিয়াও আও’। মিং ও ছিং রাজবংশের সময়ও এই নগর বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৮৯৮ সাল থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত এখানে জার্মান উপনিবেশও ছিল। ফলে এখানকার অনেক ভবনে জার্মান স্থাপত্যরীতি চোখে পড়ে। ফলে প্রাচীন থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত অনেক সুন্দর সুন্দর স্থাপনা রয়েছে ছিং তাওতে। রাতের খাবার সেরে সমুদ্র সৈকতে বসে ভাবছিলাম এই জনপদের ইতিহাসের কথা। আর দেখছিলাম সাগরের ঢেউতে ফসফরাসের দারুণ সুন্দর খেলা। কখন যে রাত এগারোটা বেজে গেছে টের পাইনি। হোটেলে ফিরতে হবে।

চারিদিক বেশ নীরব হয়ে গেছে। বাস স্টপেজে গিয়ে দাঁড়ালাম। হোটেল এখান থেকে বেশ দূর। কোন বাস রাত দশটার পর বন্ধ হয়ে গেছে আর কোনটা চালু আছে তাও বুঝতে পারছি না। অনেকক্ষণ থেকে আমাদের লক্ষ্য করছিলেন এক ভদ্রমহিলা। এবার তিনি এগিয়ে এলেন সাহায্যে। কিছুটা ইংরেজি জানেন তিনি। আমাদের হোটেলের ঠিকানা লেখা কার্ড দেখে বললেন তার বাড়ি ওদিকেই। একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে তাতে আমাদের উঠতে বললেন তিনি। সঙ্গে তার স্বামীও ছিলেন। সারা পথ গল্প করতে করতে গেলাম। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি ও তার স্বামী দুজনেই খুব আগ্রহ প্রকাশ করলেন। আমাদের হোটেলে পৌছে দিলেন তারা। ট্যাক্সি ভাড়া দিতে চাইলে হেসেই উড়িয়ে দিলেন আমাদের প্রস্তাব। হ্যান্ডশেক করে অনেকক্ষণ ধরে বিদায় পর্ব চললো। একসাথে ছবিও তুললেন। তারপর বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন সেই সহৃদয় দম্পতি। চীনের সাধারণ মানুষের এই সদয় ব্যবহার এবং আন্তরিক ভদ্রতা আমাকে বরাবরের মতো এবারও অভিভূত করলো।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল আমার জন্মদিনটি কাটিয়েছিলাম ছিং তাও শহরের সমুদ্র তীরে। সন্ধ্যাটি ছিল দারুণ সুন্দর। শান তংয়ের বসন্ত তার অপরূপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিয়েছিল প্রকৃতির বুকে। ছিং তাও-এ সাগর যেমন রয়েছে তেমনি আছে পাহাড়। এই পাহাড়ে ছোট বড় অনেক দৃষ্টিনন্দন মঠ ও মন্দির আছে। শহরের প্রান্তে সেইন্ট মাইকেল ক্যাথিড্রালও বিখ্যাত। সাগর তীরের মানমন্দিরটিও আকর্ষণীয়। সমুদ্র সৈকতে চীনা তরুণ তরুণীদের সঙ্গে খুব আনন্দে কাটলো কিছুটা সময়। তাদের আন্তরিক বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার এবং প্রাণ খোলা হাসি ভোলার নয়। সারাদিন শহর ঘুরে এবং চমৎকার ডিনার খেয়ে অসাধারণ এক জন্মদিন কাটিয়ে অনেক রাতে হোটেলে ফিরেছি ক্লান্ত হয়ে। ফলে বাংলাদেশের কোনো খবর রাখিনি। তখনও জানতাম না কী ভীষণ বিপর্যয় ঘটে গেছে সেদিন।
পরদিন ২৫ এপ্রিল সমুদ্র সৈকতে গেছি। কয়েকজন চীনা তরুণ তরুণীর সঙ্গে আলাপ হচ্ছে। হঠাৎ এক চীনা যুবক আমাদের বাংলাদেশী পরিচয় পেয়ে উত্তেজিত হয়ে চীনা ভাষায় দ্রুত কী যেন বলতে লাগলেন। একটু পরেই তিনি দৌড়ে একটি ইংরেজি পত্রিকা এনে দেখালেন আমাদের। সম্ভবত ‘পিপলস ডেইলি’। সেখানে প্রথম পাতাতেই বড় হরফে বাংলাদেশের রানা প্লাজা বিপর্যয়ের খবর ছাপা হয়েছে। দেখে চমকে উঠলাম। মুহূর্তে মন ছুটে গেল দেশের দিকে। প্রকৃতির সৌন্দর্য কিংবা ঐতিহাসিক স্থাপনা কোন কিছুই আর ভালো লাগছে না। মনে হলো বেইজিং ফিরতে হবে, দেশের খবর জানতে হবে বিস্তারিত। ইয়েলো সিকে বিদায় জানিয়ে ফিরে চললাম রেলস্টেশনে বেইজিংয়ের ট্রেন ধরার উদ্দেশ্যে।

ছবি : শিহাবুর রহমান

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ আগস্ট ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়