ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

প্রথম কলকাতা || দেবব্রত মুখোপাধ্যায়

দেবব্রত মুখোপাধ্যায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ২৭ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রথম কলকাতা || দেবব্রত মুখোপাধ্যায়

ইংরেজিতে বলে, ওয়ার্ম রিসিপশন। বাংলা শব্দযুগল হলো, উষ্ণ সম্ভাষন।

‘উষ্ণ’ ব্যাপারটা ঠিক কতো উষ্ণ হতে পারে, সেটা আগে কখনো কল্পনা করতে পারিনি। মোবাইলের স্ক্রিন জানালো- উষ্ণতার পরিমাণ ৪৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। তাতেও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে বসে ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না। বাস থেকে নামতেই টের পাওয়া গেলো ব্যাপারটা।

 

বাইরে পা রাখতেই শরীরজুড়ে একটা গরম বাতাস ছুঁয়ে গেলো। রান্না করার সময় কখনো উনুনের কাছে দাঁড়িয়ে থেকেছেন? ঠিক এমন একটা বাতাস উনুন থেকে ভেসে আসে। বুঝলাম, জীবনের প্রথম ভ্রমণে কলকাতা আমাকে উনুন জ্বালিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে; খাটি ওয়ার্ম রিসিপশন আর কী!

 

এই অসময়ে কলকাতা তো দূরে থাক, বাসা থেকে বের হওয়াটাও নিতান্ত মূর্খের কাজ বলে গন্য হওয়ার কথা।

সারাজীবন নানারকম মূর্খামি করে তার চূড়ান্ত প্রদর্শনী করতে এপ্রিল মাসের কোনো এক দুঃস্বপ্নের মতো রাতে রওনা দিয়েছিলাম ভারত সফরে। এর আগে একবার উত্তর সীমান্ত হয়ে দার্জিলিং গিয়েছিলাম। কিন্তু ‘বাড়ির কাছের আরশিনগর’ কলকাতায় এই প্রথম।

বোকা লোকের বন্ধুরা দুষ্ট হয়। তাই সবাই বললেন, এপ্রিলে তেমন গরম থাকে না। ফলে এটা বেশ ভালো সময়। জব চার্নকের শহরটাকে এই বেলা দেখে এসো।

বুঝতে পারিনি, মনে মনে এতোটা রাগ ছিলো বন্ধুদের; পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন। অবশ্য কলকাতা পৌঁছানোর পর ওখানকার বন্ধুরা বললেন, কলকাতায় এই ৪৩ ডিগ্রি রেকর্ড! এর আগে যে ক’বার চল্লিশ ছাড়িয়েছে, সবই জুন মাসে। এবার এপ্রিলে ৪৩ ডিগ্রির রহস্যটা তারাও ধরতে পারছেন না।

আমি কথা বললাম না। এটা যে স্রেফ আমার জন্য, সেটা টের পেলে ভিসা বাতিল করে দেওয়ার ভয় ছিলো।

 

ভিসা বাতিলের ভয়টা আসলে বর্ডারেই পেয়েছিলাম। বর্ডার শুনলেই ছোটবেলা থেকে আমার মনে হয় দু’ পাশে বন্দুক হাতে শত শত জলপাই ছাপা পোশাক পরা মানুষ দাঁড়িয়ে। এর মাঝখান দিয়ে কাটা তারের বেড়া গলে যাতায়াত করতে হয় বুঝি।

বেনাপোল সীমান্তে পৌঁছে বুঝলাম, ব্যাপারটা অতোটা সিনেমাটিক নয়। দিব্যি রাস্তা আছে। এ পাশে দু’ দফা, ও পারে দু’ দফা নানারকম চেকিং হয়। কিছু গোপন দক্ষিনা দিলে কেউ ব্যাগ পেটরা ছুঁয়েও দেখে না। ফলে বর্ডার পার হওয়াটা দিব্যি আরামের হলো।

অবশ্য একেবারে শেষ মুহূর্তে ভারতীয় ইমিগ্রেশনে আটকে গিয়েছিলাম প্রায়। কর্মকর্তাটি হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় কোথায় নির্বাচন কাভার করবেন?’

আমি একটু আসমান থেকে পড়লাম, ‘নির্বাচন! আমি নির্বাচন কেনো কাভার করবো? আমি তো স্পোর্টস রিপোর্টার। আর এখন আপনাদের কি নির্বাচন? ক’দিন আগে না মোদি বাবু দুনিয়া কাঁপিয়ে ক্ষমতায় এলেন!’

ভদ্রলোক রসিক, ‘সাংবাদিক পাসপোর্ট। তারপরও বলছেন, নির্বাচন কী জানেন না! রাজ্যে নির্বাচন চলছে।’

একেবারে শচীন-দ্রাবিড়ের নামে দিব্যি করে বললাম, ‘রাজ্য, কেন্দ্র, বিশ্ব, জাতিসংঘ; দুনিয়ার কোনো নির্বাচনে আমার আগ্রহ নেই। বাংলাদেশ জাতীয় দল নির্বাচন নিয়ে কিছু আগ্রহ ছিলো; দ্বিস্তর বিশিষ্ট নির্বাচক কমিটি হবে শুনে সে আগ্রহও হারিয়ে ফেলেছি।’

ওনারা মুচকি হেসে ছেড়ে দিলেন। ক্রিকেটার নির্বাচন সংক্রান্ত জটিলতার ব্যাপার স্যাপার পশ্চিম বাংলার লোক ভালোই জানে; সৌরভের সময় বুঝেছে। তাই সমব্যথী হয়ে ছেড়ে দিলেন।

 

কলকাতায় পৌঁছে বুঝলাম, গরম আসলেই এখানে দ্বিবিধ-সূর্যের তাপ তো আছেই, তার চেয়েও গরম নির্বাচনী বালির তাপ। পত্রিকার পাতাগুলো ওল্টানোর আগেই দেখলাম, এখানকার রাজ্যসভার নির্বাচন নিয়ে রীতিমতো ত্রাহি ত্রাহি রব। এ বলছে, অমুক বাবু সব সিল মেরে দিচ্ছেন। ও পত্রিকা বলছে, তমুক দিদির লোক সবাইকে গুড়-বাতাসা খাইয়ে ‘টাইট’ করছে।

একটা ব্যাপার দেখলাম, ওখানকার বাংলা পত্রিকাগুলোর মধ্যে নির্বাচনের সময় ঘোমটা দেওয়ার কোনো ব্যাপার সেভাবে নেই। নির্বাচনে কে কোন দল সমর্থন করছেন, সেটা নিয়ে কোনো ঢাক ঢাক গুড় গুড় নেই। আমাদের এখানে যেটা হয়, নির্বাচন এলে সব সংবাদ মাধ্যমই একটু কৌশলে তার পছন্দের দলের উপকার করার চেষ্টা করেন; তবে পাঠককে একটা অনুভূতি দেওয়ার চেষ্টা করেন যে, তারা নিরপেক্ষ। কলকাতায় সেটার বালাইমাত্র নেই। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম, বলা ভালো মিডিয়া গ্রুপ যার যার পছন্দের দলের পক্ষে উঠে পড়ে লেগেছে। একদিন ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর বিরোধী বাংলার শীর্ষস্থানীয় একটা সংবাদ পত্রে হিসেব করলাম- প্রথম পাতায় ১১টা খবরের সবগুলোই শাসকদের বিকট নিন্দায় ভরপুর।

 

 

যাই হোক, বর্ডারে কথা দিয়ে এসেছি, নির্বাচন নিয়ে ভাববো না। কার্যত আমি ভাবতে কলকাতায় যাইনি। আমি গেছি মুগ্ধ হতে।

ফেলু মিত্তিরের কলকাতা, টেনিদার কলকাতা, মান্না দে, সতীনাথের কলকাতা। রবি ঠাকুর, নজরুলেরও বটে। চোখ-কান মেলার পর থেকে কলকাতার গল্প শুনে, পড়ে বড় হয়েছি। আজ কলকাতায় মুগ্ধ হতে এসেছি। কলেজ স্ট্রিট, বঙ্কিমচন্দ্র এভিনিউ থেকে শুরু করে ধর্মতলা চষে বেড়িয়েও আমার বই পড়া স্মৃতির সাথে কিছু মেলাতে পারলাম না।

ধিকি ধিকি করে টিকে থাকা কয়েকটা ট্রাম কেবল মাঝে মাঝে জানান দিয়ে যায়- এই সেই কলকাতা। শুধু ট্রাম আমাকে স্মৃতিকাতরতার অর্থে মুগ্ধ করতে পারলো না। মুগ্ধ হলাম কলকাতার শৃঙ্খলা দেখে।

মুগ্ধ নয়, বিস্মিত বলা চলে।

কলকাতা বয়সের দিক থেকে ঢাকার চেয়েও জুনিয়র।

এই নগরীর লোকজনের স্বভাব চরিত্র ঢাকার লোকেদের চেয়ে আকাশ পাতাল আলাদা, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। এই নগরী কোনো কোনো পাশ থেকে দেখলে ঢাকার চেয়েও অপ্রশস্ত রাস্তা আর ঘিঞ্জি। অথচ এমন একটা ‘প্রায় ঢাকা’ শহরকে এরা বইয়ে পড়া ইউরোপ-আমেরিকার শহরের মতো শৃঙ্খলাপরায়ণ ও জ্যামহীন বানিয়ে ফেলেছে!

 

 

এই শৃঙ্খলা বা জ্যামহীনতার মূল রহস্য একটু চোখ বুলালেই ধরা পড়ে- গন্ডা গন্ডা বিকল্প রাস্তা আর বিকল্প বাহন। শহরের বাইরে থেকে কলকাতার বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত বা শহরের ভেতরেই যাতায়াতের জন্য যেমন খুশী বিকল্প পথ আর বাহন ব্যবহারের স্বাধীনতা আছে। ঢের পাবলিক বাস আছে, অনেক সময় লাগিয়ে কম খরচে সেগুলোতে চড়তে পারেন। আবার দামি দামি পাবলিক বাসও আছে; আরাম করে চড়তে পারবেন। বিদ্যুতগতির ট্রেন আছে; সেখানেও অল্প ব্যয়ে ছোটা চলে। আর শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা অবদি আছে মেট্রো ট্রেন; শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রেন, যার বেশীরভাগটাই মাটির নিচ থেকে চলছে। এ ছাড়াই অন্তত চার ধরণের ভিন্ন ভিন্ন স্ট্যাটাসের ট্যাক্সি সার্ভিস আছে। ফলে নির্দিষ্ট কোনো বাহনে লাগাম ছাড়া ভিড় নেই। মারাত্মক গতির ফলে ট্রেনে যে প্রবল ভিড়টা হয়, সেটাও আর খুব একটা গায়ে লাগে না।

মোট কথা, এক দেড় শ কিলোমিটার ভ্রমণকে এরা ডালভাত বানিয়ে ফেলেছে।

 

এই দূরত্ব কমিয়ে আনার ফলে আরেকটা ব্যাপার হয়েছে- নগরী কলকাতায় বাসিন্দার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। ছোট বেলায় বইয়ে পড়েছি, নিউইয়র্ক শহর নাকি রাতে ফাকা হয়ে যায়; সকাল বেলা উপশহরগুলো থেকে কাতারে কাতারে লোক এসে জমিয়ে তোলে শহর। ঠিক এই ব্যাপারটাই করতে পেরেছে কলকাতা।

প্রতিদিন লাখো মানুষ শহর থেকে শ খানেক কিলোমিটার দূর থেকে এসেও অফিস করছেন; আবার বিকেল হলে ফিরে যাচ্ছেন। ফলে আমাদের ঢাকার মতো চব্বিশ ঘণ্টা কোটি লোকের ভিড় লেগে থাকছে না। শহর কিছুটা হলেও হাফ ছেড়ে বাঁচতে পারছে।

মানুষকে এই নগরী থেকে দূরে ঠেলে পাঠানোর আরেকটা কৌশল আছে দেখলাম। এটা পরিকল্পিত কি না, জানি না। তবে ব্যাপারটা খুব কার্যকর- কলকাতার কেন্দ্রের যতো কাছে থাকতে চাইবেন, জীবনযাত্রার ব্যয় ততো চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়বে। ফলে লোকে ব্যয় বাঁচাতেও কলকাতা থেকে বাইরে ছুটছে।

 

পাশাপাশি শহরের ভেতর দুটো ব্যাপার কতৃপক্ষ ঠিক করে ফেলেছে। প্রথমত লোকেদের ট্রাফিক আইন মানতে বাধ্য করে ফেলেছে। ট্যাক্সিওয়ালাদের বাড়তি টাকা দিয়েও অনির্ধারিত জায়গায় পার্কিং করতে রাজী করানো গেলো না। আরেকটা ব্যাপার হলো, প্রতিটা রাস্তা মহাপরিকল্পনার আওতায় আনা। কলকাতার আদি অংশের রাস্তাঘাটের প্রশস্ততা আমাদের পুরোনো ঢাকার চেয়েও খারাপ। ওরা কী করেছে, সেগুলোর একটা ব্যবহার আবিষ্কার করে ফেলেছে। এই অংশে প্রতিটা রাস্তা একমুখী। সেই একমুখীতা আবার প্রতিদিন দুপুরে একবার বদলে যায়। মানে, তারা হিসেব করেছে অফিস টাইমে কোন দিকে লোকের স্রোত বেশি, পথটা সকালে সেদিকে, বিকেলে তার উল্টো দিকে খোলা রাখছে।

 

কলকাতার অনেক গুণকীর্তন করে ফেললাম। হাফ ধরে গেছে। মাটির ভাড়ে চা খাওয়া দরকার।

ও হরি! এ তো এক ফোঁটা মাটির ভাড়। হাতে নিতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেললাম। ঠোঁটে ছোঁয়ানোর আগেই দোকানি বললে, ‘দাদা, ভাড় ফেলবেন পাশের ঝুড়িতে।’

বেশ বুঝে ফেলেছে, বাংলাদেশ থেকে এসেছি। এই ব্যাপারটা পুরোনো কলকাতা দারুণ বুঝেছে। বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ মার্কোস স্ট্রিট নামে একটা সরু রাস্তায় গিয়ে নামছে। কেউ আত্মীয়র টানে, কেউ পড়ার টানে, কেউ ব্যবসার টানে এবং অধিকাংশ চিকিৎসার টানে আসছেন। আর এদের কেন্দ্র করে আশেপাশে গজিয়ে উঠেছে গন্ডায় গন্ডায় হোটেল।

নিউ মার্কেট থেকে শুরু করে হগ সাহেবের মার্কেট; সাহেবদের সেকালের এলাকাটা এখন বাংলাদেশীদের পদচারণায় মুখর। আর এই ভ্রমণার্থীদের লক্ষ্য করেই বাড়তি দু’ পয়সা কামানোর সুযোগটা ছাড়ছে না কেউ। হোটেলের ম্যানেজার তাই বললেন, ‘এদিকে শপিং করবেন না। গড়িয়াহাট বা ওদিকে কোথাও চলে যান। চাইলে সল্ট লেকেও যেতে পারেন।’

 

যাওয়ার পথে চোখে পড়লো, কলকাতা বড় হচ্ছে। কলকাতার আসলে বিস্ফোরণ হচ্ছে। সত্যজিৎ, রবীন্দ্রনাথের সেই কলকাতা ডিম ফেটে বেরিয়ে আসছে। একটার পর একটা স্যাটেলাইট শহর জুড়ে দিচ্ছে লবণ হ্রদ থেকে শুরু করে আরও দূরের দূরের এলাকা। মাটি ফুড়ে বের হচ্ছে ঝা চকচকে আকাশ ছোঁয়া সব ইমারত। চলছে নতুন নতুন মেট্রো লাইনের কাজ। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, ‘মেগা বিল্ডার্স’ ধারাবাহিকের শুটিং চলছে।

কলকাতা এবার নিজেকে আরও বদলে ফেলবে।

এই বেলা সত্যজিৎ, শঙ্করের লেখাগুলো আলাদা করে রাখুন। বইয়ের বাইরে সেই কলকাতাকে আর বেশিদিন পাবেনই না।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ জুন ২০১৬/এএন/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়