ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

প্রবাসী শ্রমিকের মৃত্যু ও দূতাবাসের করণীয়

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১২, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রবাসী শ্রমিকের মৃত্যু ও দূতাবাসের করণীয়

রুহুল আমিন : ইয়াছিন পাশের বাড়ির ছেলে। ছেলেবেলায় একসঙ্গে অনেক সময় পার করেছি। মাঝে অনেকদিন দেখা হয় না। গত সপ্তাহের এক সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বড় ভাই ফোনে জানালেন, সৌদি আরবে এক সড়ক দুর্ঘটনায় ইয়াসিন মারা গেছে। আমি জানতামই না ইয়াছিন সৌদি আরব গেছে। সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে সে মারা যায়।

ইয়াছিনরা তিন ভাই। সবার বড় ইয়াছিন।  নিজেদের শেষ সম্বল বিক্রি করে আট লাখ টাকা খরচ করে এক বছর আগে ইয়াছিন সৌদি আরব যায়। যতটুকু জানি, সে যে ভিসায় সৌদি গিয়েছিল তার নাম ‘বলদিয়া’। অনেকে আবার ফ্রি ভিসাও বলে। ফ্রি কারণ, এর বাধাধরা কোনো মালিক থাকে না। যেকোনো জায়গায় কাজ করা যায়। অবশ্য কোনো কোম্পানি বা স্থানীয় কোনো ব্যক্তির নামে ভিসা বের হয়। অন্য কোনো নামও থাকতে পারে এ ধরনের ভিসার। ইয়াছিন এক বছরে যে টাকা রিটার্ন দিয়েছে তা খরচের শত ভাগের দশ ভাগও না। ইয়াছিন বিদেশ যাওয়ার মাধ্যমে বাবা-মা ও ভাইদের নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল একটু ভালো থাকার। এখন অপঘাতের মৃত্যুতে বেঁচে থাকা বাকি চারজনের স্বপ্নের সলিল সমাধি তো হলোই, প্রিয় সন্তান হারানোর শোক, ভাই হারানোর শোক সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে তাদের। পুরো পরিবারটি পথে বসে গেলো ইয়াছিনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।

এর চার মাস আগে এলাকার বাদল নামে এক ব্যক্তি মালয়েশিয়ায় কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় মারা যায়। বাদলের স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়ে আর বৃদ্ধ মা এখন দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পুরো পরিবার এখন এক বেলা, দুই বেলা খেয়ে কোনোরকম জীবন ধারণ করছে।

প্রায় দেড় বছর আগে শাহজাহান নামে আরেক ব্যক্তি মালয়েশিয়ায় গিয়ে নিউমোনিয়াজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে তার বউ এখন মানুষের দ্বারে দ্বারে সাহায্যের আশায় হাত পাতে। সহায় সম্বল যা ছিল তা মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সময়ই বিক্রি করে দিয়েছিল শাহজাহান।

গত দুই বছরে আমাদের এলকার অন্তত ছয়জন ব্যক্তি প্রবাসে মারা গেছে। এর মধ্যে বাদল ও শাহজাজাহান কোনো ধরনের আর্থিক সহযোগিতা পাননি। না মালয়েশিয়া, না বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে। কারণ তারা অবৈধভাবে গিয়েছিল। ইয়াছিনের ব্যাপারটি এখনো সুরাহা হয়নি। আর বাকিদের ব্যাপারে আমি ঠিক এখনও জানি না।

আমার বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলায়। এই উপজেলায় বেশিরভাগ মানুষ প্রবাসী। দেশের বাইরে থেকে পাঠানো টাকা দিয়েই দেশে থাকা আত্মীয় স্বজন, পরিবার নিয়ে একটু ভালো থাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু একটি পরিবারের জন্য নিয়ে আসে অসীম আয়ুর শোক।

গত ৭ জানুয়ারি দেশের শীর্ষ স্থানীয় একটি পত্রিকা প্রবাসে বাংলাদেশের নিহত শ্রমিক সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গা শিউরে ওঠা তথ্য পাওয়া যায় এই প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, কেবল গত ডিসেম্বরেই ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মোট ২৬৭ জন প্রবাসী বাংলাদেশীর লাশ এসেছে। শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০ জন প্রবাসীর লাশ আসছে। আরো ভয়াবহ ব্যাপার হলো, গত ৪৫ বছরের মধ্যে ২০১৬ সালে সবচেয়ে বেশি প্রবাসীর মৃত্যু হয়েছে। ২০১৬ সালে দুই হাজার ৯৮৫ জন প্রবাসীর লাশ এসেছে। চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়েও অনেক লাশ এসেছে। এ ছাড়া বিদেশে বিপুলসংখ্যক প্রবাসীর দাফন হয়েছে। যার হিসাব প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জানা নেই।

প্রতিবেদনটিতে বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের বরাত দিয়ে বলা হয়, এইসব মৃত ব্যক্তির মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন স্ট্রোকে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু দুর্ঘটনায়। এ ছাড়া হৃদরোগ ও স্বাভাবিক মৃত্যুও আছে। গত চার বছরে যত প্রবাসীর লাশ এসেছে, তাদের মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অন্তত ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যু হয়েছে আকস্মিক। সবচেয়ে বেশি লাশ এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। যা মোট লাশের ৬২ শতাংশ। এই ক্ষেত্রে সৌদি আরব প্রথম ও মালয়েশিয়া দ্বিতীয় স্থানে আছে।

একটু ভালো থাকার আশায়, পরিবারের সদস্যদের মুখে দুমুঠো অন্য তুলে দিতে প্রবাসে পাড়ি জমান অনেকে। বেশিরভাগই নিজের শেষ সম্বল বিক্রি করে দেন। তারপর দিনের পর দিন আপনজনদের ছেড়ে থাকা যে কি ভীষণ রকম পীড়াদায়ক, যার প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা নেই সে কখনো বুঝবে না সে ব্যথা। আমি ব্যক্তিগতভাবে তা কিছুটা হলেও টের পাই। কারণ অল্প সময়ের জন্য হলেও প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা আমার আছে। সে সময় দেখেছি প্রবাস জীবন কেমন ভয়াবহ রকমের একাকিত্বের।

স্ট্রোক ও হৃদরোগে মৃত্যুর কারণই বলে দিচ্ছে কেমন থাকে প্রবাসীরা বিদেশের মাটিতে। অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই তো সবচেয়ে বড় লড়াই। জীবনের স্বার্থকতাও বোধ হয় অস্তিত্বের লড়াইয়ে ভালোভাবে সফল হওয়া।

বিদেশ গিয়ে অস্বাস্থ্যকরা পরিবেশে থাকা, খাওয়ার অনিয়ম, টানা পরিশ্রম, একাকিত্ব, পরিবারের চাহিদার চাপ, মালিকের অত্যাচার, বিনোদনহীন একঘেয়ে জীবনে নানা কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে প্রবাসীরা।

বাংলাদেশের অর্থনীতির কথা বললে রেমিটেন্সের কথা আগে আসবে। অথচ এই রেমিটেন্স পাঠানো ব্যক্তিদের দুর্দশার কথা বলার যেন কেউ নেই। আর বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে তো শ্রমিকদের কোনো ঠাঁই হয় না। আমি নিজেও দেখেছি সে অবস্থা। প্রকৃত পক্ষে শ্রমিকদের দুর্দশা শুরু হয় ঢাকা বিমানবন্দর থেকেই। এই দুর্দশা প্রবাস জীবনের পুরোটা সময় বয়ে বেড়াতে হয়। অথচ সরকারের একটু সহায়তা তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারতো। কারণ প্রবাসে যাওয়ার আগে সরকারের খোঁজখবর নেওয়া, স্বাস্থ্য পরীক্ষার সরকারি উদ্যোগ, অবৈধভাবে বিদেশ গমনে কড়াকড়ি আরোপসহ অনেক বিষয় আছে সরকার ও সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক হলেই কেবল সেগুলোর সমাধান হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক পাঠানোর ব্যাপারে আরো বেশি নজরদারি বাড়ানো দরকার। আর দূতাবাসগুলো যেন শুধু সরকারের প্রতিনিধি এবং ভিআইপিদের আচার অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ না থেকে শ্রমিক শ্রেণির বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এগিয়ে আসে সেদিকেও দৃষ্টি দেওয়া উচিত। শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। আমাদের একথা ভুলে গেলে চলবে না। তাই প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর মিছিল যেন আর বড় না হয় সে ব্যাপারে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।

গত রোববার প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, ২০১৭ সালে আট লাখ কর্মী বিদেশে পাঠানোর লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। ২০১৬ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাত লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জন বাংলাদেশী কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের দেশে এটা নিশ্চয় অনেক ভালো খবর। তবে শ্রমিক পাঠানোর আগে গমনেচ্ছু শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শুধু প্রশিক্ষণই নয়, মানসিক প্রেষণা থেকে শুরু করে খাবার-দাবার, জীবনযাপন, অবসর সময়ের বিনোদনসহ যাপিত জীবনের ক্ষেত্রে নানা অনুষঙ্গ নিয়ে আলোচনা করে তাদের দিক নির্দেশনার ব্যবস্থা করতে হবে। সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো ভালভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা। যতদূর জানি বিদেশ যেতে হলে হার্টের পরীক্ষা করা হয় না। কয়েকটি রক্ত পরীক্ষা করানো হয়। কিন্তু এখন থেকে বিদেশ যাওয়ার আগে হার্টের পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে বাধ্যতামূলকও করা যেতে পারে।

বাংলাদেশী দূতাবাসগুলো শ্রমিকদের কোনো ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করে না-অনেক পুরনো অভিযোগ। পৃথিবীতে এতো কিছু বদলায় কিন্তু আমাদের দূতাবাসগুলোর আচরণ যেন বদলায় না। সরকারকে এ দিকে নজর দিতে হবে। শ্রমিকদের অগ্রাধিকার বাধ্যতামূলক করা যায় কি না ভেবে দেখতে হবে। ভিআইপিদের চেয়ে শ্রমিকদের বিদেশের মাটিতে বেশি সাপোর্ট দরকার। তাদের ‍দুঃসময়ে দূতাবাসকে পাশে থাকতে হবে।

প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি সরকারের আন্তরিকতা আছে বিশ্বাস করি। কিন্তু তারপরও দিন শেষে কেমন যেন শ্রমিকদেরকে বিদেশে এতিমের মতোই থাকতে হয়। অথচ দূতাবাসগুলো হতে পারে শ্রমিকদে দুঃসময়ে নির্ভরতা, আশ্রয়ের জায়গা। আশা করি সরকার এ ব্যাপারে অতি দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। ওই পদক্ষেপই বাঁচাবে শ্রমিকদের, বাড়তে থাকবে আমাদের রেমিটেন্স, আরো সচল হবে আমাদের অর্থনীতির চাকা।

লেখক : সাংবাদিক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ জানুয়ারি ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়