ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

১১ দিনেও স্বাভাবিক হয়নি জনজীবন

মো. আনোয়ার হোসেন শাহীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩৫, ৪ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
১১ দিনেও স্বাভাবিক হয়নি জনজীবন

মাগুরা প্রতিনিধি : মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার বালিদিয়ার দক্ষিণপাড়া গ্রামে আওয়ামীলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ, হামলা ও ভাংচুরের ঘটনার ১১ দিন পার হলেও পরিবেশ এখনো স্বাভাবিক হয়নি।  

সংঘর্ষের ঘটনায় এপর্যন্ত বিশেষ আইনে ৫টি মামলা হয়েছে। মহম্মদপুর থানায় দায়েরকৃত ৫টি মামলায় আসামি সংখ্যা ৬১৮। জানিয়েছেন ওই থানার এসআই নূরুজ্জামান। 

জানা গেছে,  দক্ষিণপাড়া গ্রামের সর্বস্ব হারানো সাধারণ মানুষের ঘাড়ে এখন মামলার বোঝা। একই ব্যক্তি দুই-তিনটি মামলার আসামী। পুলিশের গ্রেফতারের   ভয়ে পুরুষ লোকজন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বাড়িঘরে ফিরতে পারছেন না। বাড়ি থাকেন না  এমন ব্যক্তিরাও মামলার আসামি।  এছাড়া স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং সদ্য শেষ হওয়া এসএসসি ও সমমানের কয়েকজন পরীক্ষার্থীকেও আসামি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তাদের অভিভাবক ।

রাত-দিন বাড়িঘরে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। গ্রামের প্রবেশ মুখের কয়েক জায়গায় পুলিশ অবস্থান নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। একাধিক গ্রামবাসীর অভিযোগ, নিরীহ মানুষকে মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। 

প্রসঙ্গত, বালিদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান মিনার সঙ্গে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য ইউনুস আলী শিকদারের বিরোধে গত ২০ ফেব্রুয়ারি এ সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত ৫০ জন আহত হন। অর্ধশতাধিক ঘর ভাঙচুর করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ১০৮ রাউন্ড শটগানের গুলি ও ১৬ রাউন্ড টিয়ার গ্যাসের শেল ছোড়ে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের উপর হামলার ঘটনায়  ২০ফেব্রুয়ারি থানার এসআই জাহাঙ্গীর হোসেন বাদী হয়ে একটি মামলা (মামলা নং-০৯) করেছেন। মামলায় ৬৫ জনের নাম উল্লেখ আছে। অজ্ঞাত পরিচয় আরও পাঁচশ থেকে পাঁচশত পঞ্চাশ জনকে আসামি করা হয়েছে।  অন্য চারটি মামলার বাদী দুই আওয়ামীলীগ নেতার সমর্থক। ২৫ ফেব্রয়ারি মফিজুর রহমান মিনার গোষ্ঠীর লোক  শফিকুল ইসলাম মিনা, আবু সাইদ মিনা ও আলমগীর হোসেন মিনা বাদী হয়ে ২৭০ জনের নাম উল্লেখ করে তিনটি মামলা (মামলা নং-১৩,১৪ ও ১৫) করেন। মামলার আসামিরা সবাই ইউনুস আলী শিকদারের সমর্থক গ্রামবাসী।

এদিকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ইউনুস আলী শিকদারের সমর্থক মো. নজরুল ইসলাম মোল্যা বাদী হয়ে ২৮৩ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা (মামলা নং-২০) করেন। মামলার আসামিরা সবাই মফিজুর রহমান মিনার সমর্থক।

মামলার এজাহার থেকে জানা গেছে, পুলিশ ও আওয়ামীলীগ সমর্থকদের করা এসব মামলায় সরকারি কাজে বাধা, সংঘর্ষ, হামলা, ভাংচুর ও লুটের অভিযোগ আনা হয়েছে। সবগুলো মামলাই বিশেষ আইনে রুজু করা হয়েছে। পুলিশ এখন পর্যন্ত আটজনকে গ্র্রেফতার করেছে।

আজ শনিবার দুপুরে গিয়ে দেখা গেছে, গ্রামের চারদিক এখনো ভাঙাচোরা ঘরবাড়ির কাঠ বাঁশ টিন আর ইটের স্তুপ। ছড়ানো ছিটানো ধান কাপড়চোপড়সহ নানা গৃহস্থালী সামগ্রী। এগারো দিন আগের ধ্বংসচিহ্ন এখনো রয়ে গেছে। তিলতিল করে গড়ে তোলা সাজানো সংসারের সব হারিয়ে হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনেকেই। বাড়িঘরগুলো মেরামত করতে পারেননি। মিটারগুলো ভেঙে ফেলায় বিদ্যুতের সংযোগও  চালু হয়নি এখনো।

গ্রামটির চারদিক শুনশান নিস্তব্দ। কোন জনমানুষ নাই। মিনা গোষ্ঠীর লোকজনের একটি ঘরও হামলা-লুট থেকে রেহাই পয়ানি। প্রতিটি বিদ্যুতের মিটারগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। পুরো গ্রাম অন্ধকার। গুড়িয়ে দিয়েছে জমিচাষের পাওয়ার টিলার। গোলার ধানসহ নানা শস্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। টিউবয়েলের মাথা খুলে নেওয়ায় চলছে খাবার পানির সংকট ।

খেত খামারে কাজ বন্ধ। মাঠে পাকা রবিশস্য ও সদ্য রোপণকৃত বোরো ধান নষ্ট হচ্ছে। গবাদিপশুকে খাবার দেওয়ার লোক নেই। শিশুদের বইপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। গ্রামের তিনটি স্কুলে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কমে গেছে।  অনেক শিশু বাবা-মায়ের সঙ্গে এলাকা ছেড়ে যাওয়ায় স্কুলে আসছে না বলে জানা গেছে।

বাড়িতে রান্নাবান্না তেমন  হচ্ছে না।  বৃদ্ধ নারীদের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। কেউ ডাকলে প্রথমে সাড়া দিচ্ছেন না। এক কাপড়ে অর্ধাহারে অনাহারে আছেন তারা। আত্মীয় স্বজনদের পাঠানো খাবার খাচ্ছেন নারী-শিশুরা। 

পুলিশের টহল গাড়ি আসা-যাওয়া করছে। গ্রামের প্রবেশ পথে পুলিশকে অবস্থান নিয়ে থাকতে দেখা গেছে। এলাকায় এখনো থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে ।

বালিদিয়া মাজহারুল উলুম দাখিল মাদ্রাসার সহকারি  শিক্ষক মাওলানা জাফর সাদেক সম্প্রতি চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। তিনি জানান, তার দুই ছেলে   ঘটনার সময় ছিলেন না অথচ তাদেরকেও মামলার আসামি দেওয়া হয়ছে। এরকম আসামির সংখ্যা আরও আছে বলে  জানান      তিনি।                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                   

মিনা পাড়ায় ভাঙাচোরা ঘরের বারান্দায় বসে আছেন শাহিদা বেগম (৫৫)। জানান, ‘ঘরে খাবার-দাবার কাপড়-চোপড় কিছুই নেই। সব লুট করে নিয়ে গেছে । প্রতিবেশি একজনের দেওয়া খাবার খেয়ে দিন চলছে । ছেলে ও ছেলের বউ বাড়ি ছাড়া। ছেলে  মামলার আসামি,  প্রতি রাতে পুলিশ আসে।

কমলা বেগম (৬০) জানান, তার দুই ছেলে খেত খামারের কাজ করে। তারা কোন মারামারিতে নাই। ভাড়িঘর ভেঙে সব নিয়ে গেছে। উল্টো আবার  তারাই আসামী। পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

এনামুল মোল্যা জানান, সংঘর্ষে ও পুলিশের গুলিতে আহত  বেশ কয়েকজন ঢাকা ফরিদপুর ও মাগুরায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। এদের চিকৎসার ব্যায় মেটাতে  দরিদ্র পরিবারগুলো হিমশিম খাচ্ছেন।’

সামাল (১৩) ও  মিজানুর রহমান (১০) বালিদিয়া মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম ও চতুথর্ শ্রেণির ছাত্র। তারা জানায়, তাদের বইপত্র সব নষ্ট হয়ে গেছে। বাড়ি থেকে তাদের স্কুলে যেতে  দেওয়া হচ্ছে না।

মহম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. তরীকুল ইসলাম  বলেন, ‘আমরা দুই পক্ষকে নিবৃত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। পুলিশ কাউকে হয়রানি করছে না। মামলার তদন্ত চলছে। নির্দোষ কেউ আসামি থাকলে অবশ্যই তাদের নাম বাদ যাবে। ’



রাইজিংবিডি /মাগুরা/৪ মার্চ ২০১৭/মো. আনোয়ার হোসেন শাহীন/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়