ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ঝালমুড়ি বিক্রেতা জুলহাস

আরিফ সাওন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৮, ১২ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঝালমুড়ি বিক্রেতা জুলহাস

আরিফ সাওন : চুলগুলো পরিপাটি। চোখে সোনালী ফ্রেমের সাদা চশমা। কানে সাদা হেডফোন। গলায় বাঁধা টাই। টাইটা শার্টের সাথে ক্লিপ দিয়ে আটকানো। শার্ট ইন করে পরা। পরনে কালে প্যান্ট। বা হাতে সাদা চেইনের ঘড়ি। পায়ে চকচকে কালো সু। বেল্টের সাথে বাঁ পাশে গুজে রাখা সাদা টিসু। জামার পকেটে কলম আর বের হয়ে রয়েছে মোবাইল ফোনের কিছু অংশ।

 

ভঙ্গিমা তার অন্য রকম; ধীর-স্থির ও খুব শান্ত। দেখে মনে হবে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা বা বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ের কোন কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে আছেন  ঝালমুড়ির দোকানের সামনে, ঝালমুড়ি কিনবেন। কিন্তু না, তিনি তা কিনলেন না। দেখা গেলো, একজন এসে তার সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটি মগ বাঁ হতে নিয়ে তাতে ডান হাত দিয়ে মুড়ি তুলে আর মশলা মিশিয়ে ঠোঙায় ভরে সেই লোকটির হাতে দিলেন।

 

এবার সব কিছু পরিস্কার। বোঝা গেল, আসলে তিনি সরকারি বা বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠানের চাকুরিজীবী নন। তিনি নিজেই ঝালমুড়ি বিক্রেতা! জানা গেল, তার নাম জুলহাস হাওলাদার। তিনি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। এই ঝালমুড়ি বিক্রি করেই চলছে তার সংসার।

 

রাজধানীর শাহবাগ মোড়ের পাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গেটের বাইরে ফুটপাতে ঝালমুড়ি বিক্রি করেন জুলহাস হাওলাদার। কয়েক বছর ধরেই তিনি এই এলাকায় ঝালমুড়ি বিক্রি করছেন। সকাল ১০টায় আসেন আর রাত ১০টায় বাসায় যান।

 

দীর্ঘদিন এই এলাকায় ঝালমুড়ি বিক্রি করায় সকলের কাছেই তিনি পরিচিত। সাইফুল নামের এক ক্রেতা বলেন, ‘তার বানানো ঝালমুড়িতে অন্যরকম স্বাদ। অন্যদের চেয়ে তিনি খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। ঝালমুড়ি খেলে তার কাছ থেকেই খাই। তিনি ১০ টাকা করে নেন।’

 

জুলহাসের বাবা মো. তসলিম হাওলাদার ছিলেন মুক্তিযোদ্ধো। কয়েক বছর আগে তিনি মারা গেছেন। বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদের একটি কপি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি লেমিনেটিং করে দোকানের সামনে লাগিয়ে রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও বাবার আদেশ মানতে তিনি সব সময় বঙ্গবন্ধুর ছবি সাথে রাখেন।

 

জুলহাস জানান, তার বাবা মারা যাওয়ার আগে তাকে বলেছিলেন, যার জন্য এ দেশ স্বাধীন হয়েছে তাকে কোনদিনও ভুলে যেয়ো না। তাই সেই থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি সাথে রাখেন। এই ছবিটা দোকানে রাখার জন্য মার খেতে হয়েছে। ছবি ঝুলিয়ে রেখেছেন কেন- এই প্রশ্ন তুলে কয়েকটা ছেলে তাকে মেরেছে বলে জানান তিনি।

 

ফুটপাতে বসা নিয়ে জুলহাসকে বিভিন্ন সময়ে হয়রানির শিকার হতে হয়। এখন তার বিক্রি তেমন হচ্ছে না। আগে আরেক জায়গায় বসতেন। সেখান থেকে তাকে উঠিয়ে দেওয়া হয়। জুলহাস জানান, নতুন জায়গায় বিক্রি ভাল হচ্ছে না।

একটা টুলের উপরে তার দোকান। আর তার নিজের বসার জন্য আরেকটা টুল। এক জায়গা থেকে উঠিয়ে দিলে আরেক জায়গায় বসতে হয়। সেখান থেকে উঠিয়ে দিলে আরেক জায়গা। ঝালমুড়ি নিয়ে এভাবে স্থান পরিবর্তন করতে থাকলে বিক্রি কম হয়। আবার অনেককে ফাও খাওয়াতে হয়। এছাড়া পুলিশি হয়রানির শিকারও হতে হয়।

 

পুলিশি হয়রানির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক পুলিশ আছেন যারা খুব ভাল ব্যবহার করেন। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান শুনে তারা আমায় খুব আদর স্নেহ করেন। আবার কেউ কেউ আছেন খুব খারাপ আচরণ করেন। সে দিন এক পুলিশ লাঠি দিয়ে পেটে গুতো দিয়েছে। এতো ব্যথা পেয়েছি, যা বলে বোঝাতে পারবো না।’ ওই পুলিশের নাম জানতে চাইলে জুলহাস বলেন, ‘নাম দিয়েন না। আল্লাহ তার বিচার করবে।’

 

ছয় ভাই বোনের মধ্যে জুলহাস দ্বিতীয়। জুলহাসের পৈত্রিক বাড়ি শরিয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার ধানকাটি গ্রামে। বর্তমানে তিনি রাজধানীর বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের পেছনে একটি ভাড়া বাসায় বাস করেন। জুলহাসের বাঁ চোখে সমস্যা। একটু কম দেখেন।

 

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই সন্তানের বাবা। ছেলে সুলাইমান হাওলাদার প্রতিবন্ধী। সে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। মেয়ে জিতনী আক্তারের বয়স পাঁচ বছর। ছেলেকে নিয়ে তিনি খুব কষ্টে আছেন। অনেক চেষ্টা করেও একটা হুইল চেয়ার জোগার করতে পারেন নি। একটা হুইল চেয়ার পেলে ছেলেটার  জন্য দুশ্চিন্তা একটু কমতো।

 

জুলহাস পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। তার একরঙের ৯টি শার্ট আছে। একটি শার্ট দুই দিন করে পরেন। টাই আছে ৩০ থেকে ৩৫টি। তিন চার মাসের মাথায় জুতা পরিবর্তন করেন।

 

এভাবে টাই পড়ে জালমুড়ি বিক্রির কারণ জানতে চাইলে জুলহাস জানান, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, ডিজিটাল হচ্ছে, জুলহাস কেন পিছিয়ে থাকবে। সুন্দর পোশাক, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা জুলহাসের কাছে ডিজিটালের একটা অংশ।

 

তিনি বলেন, ‘বাসে বা ফুটপাত দিয়ে যাওয়ার সময় মানুষ যখন আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন, তখন আমার খুব ভাল লাগে। ঝালমুড়ি বিক্রির সময় আত্মীয় স্বজন বা এলাকার মানুষের সাথে দেখা হলে লজ্জা লাগে। লজ্জা লাগলে ভাবি চুরি করে তো খাচ্ছি না। রোজগার করে খাচ্ছি। সরকারকে ভ্যাট দিচ্ছি। সরকারকে সহযোগিতা করছি।’

 

কী ভাবে ভ্যাট দিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মোবাইল ফোনে কথা বলছি ভ্যাট দিয়ে। কিছু কিনতে গিলে ভ্যাট দিচ্ছি। তাছাড়া সরকারের সব কিছু মেনে চলছি। তার মানেই সরকারকে সহযোগিতা করছি। সরকার যদি বলে, প্রয়োজনে পরিবারের সবাই এক বেলা না খেয়ে সরকাকে ভ্যাট দেবো।’

 

তার রয়েছে অগাধ দেশপ্রেম। অসহায় অবস্থায় জীবনযাপন করলেও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে দেশের কাছে তার চাওয়ার কিছু নেই। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে তিনি ফুটপাতে ঝালমুড়ি বিক্রির নিশ্চয়তা চান। কারণ, ফুটপাতে বসতে না পারলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তাকে না খেয়ে থাকতে হবে।’

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ ডিসেম্বর ২০১৬/ আরিফ সাওন/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়