ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ফিলিপাইনে মাদক যুদ্ধে বলি হবে কে?

তৈয়বুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪৪, ২৭ আগস্ট ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফিলিপাইনে মাদক যুদ্ধে বলি হবে কে?

তৈয়বুর রহমান : ফিলিপাইনে তালিকা তৈরি করে সন্দেহভাজন মাদকদ্রব্য গ্রহণ ও পাচারকারীদের হত্যা করা হচ্ছে। সে দেশের প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুয়েত্রেত যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন মাদকদ্রব্য ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে। যুদ্ধে কারো না কারো হার হয়। এই যুদ্ধে হার হবে কার ?

 

মাদকসেবী ও বিক্রেতাদের যে হার হবে তা নিঃসন্দেহ শুরুতেই বলে দেয়া যায়। তবে শেষ পর্যন্ত টিকে যাবে তারাও। অপরাধীরাও যে আইনের ফাঁক-ফোকর গলে বেরিয়ে যাবে, সেটাও বলে দেয়া যায় এখনই। তাহলে হারবে কে? উত্তর নিঃসন্দেহে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট। তবে বলি হবে অনেকে। এমন কি প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুয়েত্রেত যদি বলি হন, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। তাহলে জিতবে কে ?

 

যুদ্ধে যারা মারা পড়ছে মাদকসেবী ও বিক্রেতারা, কখনো পুলিশের গুলিতে, কখনো অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের গুলিতে। কিছুদিন আগে যুক্তরাজ্যের গর্ডিয়ান পত্রিকায় বলা হয়, ৯ মে রডরিগো দুয়েত্রেত প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর হত্যা করা হয় ১ হাজার ৮’শ মানুষকে। আবার কেউ কেউ বলছেন, নিহতের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। ৩০ জুন দুয়েত্রেতের শপথ গ্রহণের পর সন্দেহভাজন মাদকদ্রব্য সেবনকারী হিসেবে বেশ কিছু ঊর্ধ্বতন কমকর্তার নামও ঘোষণা করা হয়। সেনাবাহিনীর জেনারেল, পুলিশ বাহিনীর সদস্য ও বিচারকদের বলা হয়, মাদক দ্রব্য বিক্রেতা ও সেবনকারীদের লাগাম টেনে ধরতে। কিন্তু কি ঘটছে আসলে দেশটিতে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে কেবল মৃত ব্যক্তিদের তালিকা।

 

কিস্তু এই হত্যাকা-ের জন্য দেশ বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা মুখে পড়েন প্রেসিডেন্ট দুয়েত্রেত। কিন্তু সমালোচনাকে গায়ে মাখছেন না তিনি। কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তার আপন কায়দায়। মানবাধিকার সংগঠগুলোর কথা কানেই তুলছেন না বা তোলার প্রয়োজন মনে করছেন না। অপরাধের মূল উৎপাটনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসেন দুয়েত্রেত। ক্ষমতা গ্রহণের পরপর তিনি বলেছিলেন, এক হাজার গ্যাংস্টারকে হত্যা করে যদি লাশ ম্যানিলা বে’তে ফেলে দিতে হয়, প্রয়োজনে তিনি তাই করবেন, তারপরও থামবেন না। অপরাধের মূলোৎপাটন করেই ক্ষান্ত হবেন। অনেক ফিলিপিনো তার এই বক্তব্যকে হাততালি দিয়ে স্বাগত জানায়। অথচ এই ফিলিপিনোদের অনেকেই অপরাধ ও দারিদ্রের নির্মম কশাঘাতে জর্জরিত।

 

বক্তৃতা শেষ হওয়ার আগেই যেমন ‘কথা’ কর্পূরের মতো উড়ে যায়, তেমনি তাদের উচ্ছ্বাসও মিইয়ে যেতে সময় লাগেনি। আক্ষরিক অর্থেই, অনেক সমস্যায় জর্জরিত ফিলিপাইন। কিন্তু সেই সব সমস্যা সমাধানের প্রতি মনোযোগ না দিয়ে দুয়েত্রেত তার দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ঠেলে দিচ্ছেন আরও দরিদ্রতার মুখে।

 

দুয়েত্রেতের স্কুল জীবন কেটেছে সহিংস রাজনীতিতে বিপর্যস্ত মিন্দানাও দ্বীপে। দ্বীপপুঞ্জের একেবারে দক্ষিণের বৃহদাকার এই দ্বীপটিতে আইন-কানুনের বলাই নেই বললেই চলে। এলাকাটিতে খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও কম নয়। মিন্দানাওয়ের পরিস্থিতি এখন যথেষ্ট অস্থিতিশীল। মুসলিম ও কমিউনিস্ট তৎপরতাও চলছে সমানতালে। আল-কায়েদা ও আইএসের ভেঙে যাওয়া গ্রুপগুলোও এখানে তাদের তৎপরতা চালয়ে যাচ্ছে। এর ওপর সময়ে-অসময়ে তৎপর হয়ে উঠে ডেথ স্কোয়াডগুলোও।

 

এই মিন্দানাওয়ের একটি শহর দাভাও সিটির মেয়র হিসেবে একটানা ২১ বছর দায়িত্ব পালন করেন দুয়েত্রেত। তখনও কিন্তু তার পক্ষে সহিংস অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি।

 

দুয়েত্রেত দাবি করেন যে, খারাপ লোকদের কবল থেকে তিনি দাভাও মুক্ত করেছেন। কিন্তু কার্যত বলতে গেলে মোটেও সফল হননি। শহরে অপরাধের হার অনেক বেশি। এরই মধ্যে শহরটি পরিচিতি লাভ করেছে হত্যাকা-ের রাজধানী হিসেবে। দাভাওয়ে যে পদ্ধতি তিনি অবলম্বন করেছিলেন, তা এখন নিয়ে গেছেন ম্যানিলায়। বর্তমানে ফিলিপিনো প্রতিষ্ঠানগুলো বলতে গেলে একেবারে পচে গেছে। যেমনটা পচে গিয়েছিল স্বৈরশাসক প্রয়াত ফার্দিনান্দ মার্কোসের শাসনামলে। পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের শাসনামলে যতোটুকু উন্নতি ঘটেছিল তা আবার ফিরে গেছে আগের যায়গায়।

 

দুয়েত্রেত এখন বিশ্ববাসীকে বিশ্বাস করাতে চাইছেন, ফিলিপাইনের দুর্নীতিবাজ ও অদক্ষ পুলিশ বাহিনী হঠাৎ সর্বজ্ঞ হয়ে উঠেছে। কারা অপরাধী থেকে নিরপরাধ বা নিরপরাধ থেকে অপরাধী হয়ে উঠেছে, তা বলতে সক্ষম এখন সেদেশের পুলিশ বাহিনী। এমন কি, তারা একথাও বলতে সক্ষম যে কাদের এখন বেঁচে থাকা উচিত ও কাদের মারা যাওয়া উচিত। শপথ নেয়ার পরপর তিনি যে দেড় শতাধিক কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে বলেছিলেন, তারা সবাই মাদক বিক্রির সঙ্গে জড়িত। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ওই কর্মকর্তাদের তিন ভাগের দুই ভাগই মারা গেছেন। আক্ষরিক অর্থেই, এটি এখন হাস্যকর একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

এই মুহূর্তে মনে হয়, প্রেসিডেন্ট দুয়েত্রেত বৃত্তের বাইরে বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছেন। প্রধান বিচারপতি ওয়ারেন্ট ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তারে নিষেধ করলে দুয়েত্রেত সামরিক আইন জারি করার হুমকি দেন। এ সব হত্যাকা- নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত দুয়েত্রেতের তীব্র সমালোচনা করলে তাকে অভিহিত করেন সমকামী হিসেবে। ইকোনোমিস্ট পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দুয়েত্রেতকে থামাতে ফিলিপিনো ও তাদের বিদেশি বন্ধুদের উচিত তার (দুয়েত্রেত) ওপর চাপ প্রয়োগ করা।

 

মাদকদ্রব্যের বিরুদ্ধে লাতিন আমেরিকার যুদ্ধ থেকে আক্ষরিক অর্থেই কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেননি দুয়েত্রেত। শিক্ষা নেননি মাদকের বিরুদ্ধে অন্যান্য দেশের যুদ্ধ থেকেও। যদি শিক্ষা নিতেন তাহলে বুঝতে পারতেন বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- কোনো সমস্যারই সমাধান করে না, পরিস্থিতিকে ঠেলে দেয় কেবল অবনতির দিকে। আর এর সুযোগ নিয়ে থাকে অপরাধীরা। প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপগুলোকে নির্মূলের চেষ্টায় লিপ্ত হয় তারা।

 

এই অবস্থা চলতে থাকলে ফিলিপাইনে বর্তমানে বিরাজমান ঘৃনা ও প্রতিশোধ পরায়নতা ধীরে ধীরে বেড়ে যাবে এবং এর পরিণতিতে অবশ্যই আতঙ্কময় একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। অবশেষে দেশ থেকে পালিয়ে যাবে আইনের শাসন। বিশ্বায়নের সুযোগ নিয়ে যেসব বিনিয়োগকারী এসেছিলেন, তল্পিতল্পা গোটাবেন তারা। মাদকের বিরুদ্ধে দুয়েত্রেতের এই ‘অসুস্থ যুদ্ধের’ বলি হবে দরিদ্ররা। তারা দরিদ্র থেকে আরো দরিদ্র হবে এবং অবশেষে এই যুদ্ধে একমাত্র বিজয়ী হবে বিদ্রোহীরা। আরেকটি পক্ষ জয়লাভ করবে এই যুদ্ধে, সেই পক্ষ হলো ‘সহিংসতা’। চিন্তার কোনো কারণ নেই, সহিংসতা কেবল সহিংসতারই জন্ম দেয়। এর বলি হতে পারেন দুয়েত্রেত নিজেই।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ আগস্ট, ২০১৬/তৈয়বুর রহমান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়