ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বন্দর নগরী কুয়াংচোও ।। শান্তা মারিয়া

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫৯, ১২ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বন্দর নগরী কুয়াংচোও ।। শান্তা মারিয়া

চকবাজার টু চায়না : পর্ব-২১

কুয়াংচোও নামটা কি অপরিচিত মনে হচ্ছে? গুয়াংজোও উচ্চারণ করেন অনেক বাঙালি। আর ক্যান্টন নামে সমধিক পরিচিতি রয়েছে এ শহরের। চীনের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এই শহর প্রাচীনকাল থেকেই বিখ্যাত সমুদ্রবন্দর। পার্ল নদীর তীরে এই শহরটি চীনের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যনগরী।

 

রোমে গিয়ে রোমান হতে হয় আর চীনে গেলে সবাই ব্যবসায়ী হতে চায়। চীন থেকে ফেরার পর আমারও মনে হলো কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য করা দরকার। সেই ব্যবসার সূত্রেই ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আবার পাড়ি জমালাম চীনে।

 

এবারের গন্তব্য কুয়াংচোও। খুনমিং (বাঙালি উচ্চারণে কুনমিং) থেকে লম্বা পাড়ি জমালাম বুলেট ট্রেনে। ৩৮ ঘণ্টা ট্রেন জার্নি। প্লেনেও যেতে পারতাম। কিন্তু ট্রেনেই যেতে চেয়েছি কারণ খুনমিং থেকে কুয়াংচোও যেতে হলে চীনদেশের অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে যেতে পারবো। পাড়ি দিয়ে যাবো পাহাড়, সমভূমি, ফসলের ক্ষেত, অরণ্য ও নদী। ইবনে বতুতা বা মার্কোপোলোর আমলে ট্রেন থাকলে তারাও এটাই বেছে নিতেন নিঃসন্দেহে। উড়োজাহাজ বা আকাশ যান আমার কখনও ভালো লাগে না। আমি তো রাবণ নই, পুষ্পক রথ দিয়ে আমার কী কাজ? উড়োজাহাজের তড়িঘড়ি ব্যস্ততার চেয়ে আমার অনেক ভালো লাগে কু ঝিক ঝিক ট্রেন। যার গতিও আছে আবার চারপাশে চেয়ে দেখার অবকাশও আছে।

 

চীনের বুলেট ট্রেন যে কাটায় কাটায় সময় ধরে চলে সে কথা আগেই অন্য লেখায় বলেছি। স্টেশনে পৌঁছিবার পূর্বে ট্রেন ছেড়ে না দিলেও পৌঁছানোর পর খুব একটা সময় পাইনি। ঝকঝকে খুনমিং স্টেশনে উঠে ততধিক ঝকঝকে ও অত্যাধুনিক বুলেট ট্রেনে চেপে বসলাম। দীর্ঘ ট্রেন যাত্রা। দেড় দিন থাকতে হবে এখানে। তাই বেশ একটু গুছিয়ে নিয়ে বসে সহযাত্রীদের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ের দিকে মন দিলাম। তারাও আমাদের বিষয়ে খুব কৌতূহলী। ভাঙা ইংরেজি আর টুকরো চীনা ভাষা মিলিয়ে আলাপ চলতে লাগল। আর চোখ মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল ট্রেনের বাইরে আমাদের সঙ্গে ছুটে চলা প্রকৃতির অপরূপ রূপ।

 

চীনের রেল লাইন সত্যিই বড় বিস্ময়কর। উঁচু পাহাড়, নদী, অরণ্যভূমির মধ্য দিয়ে কি স্বচ্ছন্দেই না চলেছে ট্রেনটা। ট্রেন কখনো পাহাড়ের ভিতরে টানেল পার হয়ে যাচ্ছে, কখনও উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে অন্য চূড়ায় শূন্যে সেতুর ওপর দিয়ে চলছে। ভাবতে অবাক লাগে কিভাবে এই সব দুর্গম জায়গায় রেললাইন বসানো হয়েছে। পাহাড়ে সূর্যাস্ত, লেকের জলে তার ছায়া, সবুজ অরণ্য আর শরতের স্নিগ্ধ তৃণভূমি দেখতে দেখতে যাচ্ছি। ট্রেনে খাবারের ব্যবস্থা আছে। আর আমাদের সঙ্গে আছে কাপ নুডুলস। ট্রেনে গরম পানির ব্যবস্থাও রয়েছে। আর একটু পর পর এসে ক্লিনার ময়লা থাক বা না থাক ক্লিন করে যাচ্ছে মেঝে ও ময়লা। ফলে সবকিছুই সব সময় ঝক ঝকে হয়ে আছে। একটু একটু করে রাত হচ্ছে আর সহযাত্রীরা সব ঘুমে ঢুলে পড়ছে। আমি জার্নিতে কখনও ঘুমাতে পারি না। তাই রাতের ও ভোরের অসাধারণ সৌন্দর্য নির্ঘুম চোখ মেলে দেখলাম। এই যাত্রাপথে আমি জীবনের সেরা কিছু প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখেছিলাম। চীনের প্রকৃতি যে কি অসাধারণ সুন্দর তা দেখার জন্য জীবনে একবার হলেও খুনমিং থেকে কুয়াংচোও ট্রেনে যাওয়া দরকার।

 

৩৮ ঘণ্টা শেষে কুয়াংচোও স্টেশনে পৌঁছালাম বেশ ক্লান্ত অবস্থায়। আমাদের হোটেল ঠিক করা ছিল না। তাই মালপত্র নিয়ে রওনা হলাম সান ইউয়ান লির দিকে। শহরের এই এলাকায় যে ছোট বড় অনেক হোটেল আছে সেটা নেট থেকে আগেই জানা ছিল।

 

সান ইউয়ান লিতে বিদেশি প্রচুর। এর আশপাশেই রয়েছে কাপড়, জুতা ইত্যাদির পাইকারি মার্কেট। আফ্রিকান ও দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবসায়ীরা এখান থেকে সস্তায় মালপত্র কিনে নিয়ে যায় দেশের জন্য। রেশম পথ বা সিল্ক রুটের ঐতিহ্য আজও রয়েছে, এখনও চীন থেকে পণ্য কিনে দেশে বিক্রি করে লাভের মুখ দেখেন ব্যবসায়ীরা। তবে উটের পিঠে নয় এখন মাল চালান যায় জাহাজে।

 

 

এখানে বিভিন্ন হোটেলে ক্যাপসুল রুমেরও ব্যবস্থা আছে। সেটা কেমন দেখার কৌতূহল হলো। বেলবয় আমাকে একটি ক্যাপসুল রুম দেখালেন। একটি বড় ঘরের মধ্যে ছোট ছোট প্রকোষ্ঠ, একটির ওপর একটি, অনেকটা মৌচাকের মতো। এই ছোট ছোট খোপে থাকে একজন করে মানুষ। এই ছোট্ট খোপের মধ্যে সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না। শুধু গুড়ি মেরে ঢুকে শুয়ে পড়তে হয়। আবার বিছানার মধ্যে বসাও যায়। এই ছোট্ট খোপে রয়েছে ল্যাপটপ চালানোর ব্যবস্থা আর কফির পানি গরম করার জন্য ছোট্ট ছোট্ট ইলেকট্রিক কেটলি। এই ছোট ক্যাপসুলের ভাড়াও কম।

 

আমি অবশ্য গোটা একটা ঘরই ভাড়া করলাম। কারণ শেয়ারে এভাবে থাকা পোষাবে না। হোটেলের নাম উ ফু। রিসেপশনে গিয়ে ভাবলাম অর্থ জিজ্ঞেস করব। কিন্তু ক্যান্টোনিজ চীনা ভাষা বুঝতে পারবো না ভেবে নিরস্ত হলাম।

 

বেইজিং ও সাংহাইয়ের পর চীনের তৃতীয় বৃহত্তম শহর কুয়াংচোও। শহরটার ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। খ্রিষ্টপূর্ব ১১০০ শতক থেকে এখানে জনবসতি গড়ে ওঠে। পার্ল নদীর মোহনায় অবস্থিত এই বন্দর শহরের সুদক্ষ নাবিকরা পাড়ি দিত দেশে বিদেশে। ইউরোপের সঙ্গে চীনের যোগাযোগের অন্যতম পথ ছিল এই বন্দর। এই শহরে এখনও প্রচুর বিদেশি বাস করে। বিশেষ করে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের লোকজন বেশি। বিখ্যাত ক্যান্টনফেয়ার বা কুয়াংচোও বাণিজ্য মেলা উপলক্ষে তো দেশবিদেশের প্রচুর ব্যবসায়ী এখানে আসেন।

 

সান ইউয়ান লি থেকে মেট্রোতে দুটো স্টেশন পরেই রয়েছে শিংফা মার্কেট নামে এক বিশাল পাইকারী মার্কেট। রাজ্যের কসমেটিকস এখানে। নিউমার্কেট থেকে শুরু করে যদি পুরো ধানমন্ডি এলাকা ধরে নেওয়া যায় একটা বৃত্ত বা চতুর্ভুজের মধ্যে তাহলে যে বিশাল জায়গা হবে, তার পুরোটাই এই শিংফা মার্কেট। বেশ কয়েকটা ভবন রয়েছে অবশ্য এখানে। কসমেটিকস, পার্লার ও স্যালুন সামগ্রীর মার্কেট এটি। এখান থেকে সারা বিশ্বে এসব সামগ্রী চালান যায়। ইউরোপ ও আমেরিকাতেও ব্র্যান্ড সামগ্রী চালান যায় এই শিংফা থেকে। দেখলে লোভ জাগে কিন্তু কেনার উপায় নেই। কারণ এটা পাইকারি মার্কেট এখানে খুচরা কিছু বিক্রি হয় না। চকবাজারের মেয়ে আমি। বিষয়টি বুঝতে অসুবিধা হলো না।

 

আমরা যখন গেলাম শিংফাতে তখন কসমেটিকস মেলা চলছে। সেটাও এক ইলাহি কারবার। রূপচর্চার জন্য মানুষের যে কত কিছু প্রয়োজন হয় এখানে না গেলে কখনও জানা হতো না। সামুদ্রিক ও রকসল্ট থেকে শুরু করে কত যে অ্যারোমা, বাথ জেল আর স্ক্রাব তার কোনো ইয়ত্তা নেই। চুলের যত্ন, হাত পায়ের যত্ন আর মুখের যত্নের জন্য এত সামগ্রী যে মনে হয় এত কিছু ব্যবহার করতে হলে কয়েক জন্ম পার হয়ে যাবে। পারফিউমের বোতলই যে কত রকমের আর কত বাহারের তা না দেখলে বলে বোঝানো কঠিন।

 

 

মেলাতে আলাপ হলো একটি কসমেটিকস কোম্পানির মালিক টমের সঙ্গে। ব্যবসায়িক সুবিধার জন্য চীনাদের আজকাল একটি করে সহজ ইংরেজি নাম থাকে। টমও একজন চৈনিক।

 

চীনের প্রতিটি শিল্প কারখানার আশপাশে বেশকিছু ব্রোকার থাকে। ওরা প্রত্যেকেই হয়তো ওই কারখানাটিকে নিজের বলে দাবি করে বিদেশি ক্রেতার কাছে। ফলে একেবারে বটম লাইন দামে ক্রেতারা কিনতে পারে না। এ বিষয়টি আগেই জানা ছিল বলে আমরা সতর্ক ছিলাম যে এমন কোনো ব্রোকারের পাল্লায় যেন না পড়ি।

 

টম কিন্তু ব্রোকার নয়। পার্টনারশিপে সে নিজেই কারখানার মালিক। তার  বড় অংশীদার হলেন জ্যাক নামে আরেক ভদ্রলোক। জ্যাকের বোন জেনিকে বিয়ে করেছে টম। ফলে টম-জ্যাক-জেনি মিলেই চালায় কারখানাটা। ওরা তিনজন আমাদের নিয়ে গেলেন কারখানা দেখতে। শিংফা থেকে অনেক দূরে বাইইয়ুন জেলায় এই কারখানা। এটা শিল্পাঞ্চল। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ দূরত্বে বাইইয়ুন। পাহাড়ঘেরা এই জেলা। এটাও কিন্তু কুয়াংচোও সিটির ভিতরেই।

 

যাত্রাপথেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো একটি বড় রেস্টুরেন্টে। এই রেস্টুরেন্ট সামুদ্রিক খাবারের জন্য বিখ্যাত। এখানে বিশাল বিশাল অ্যাকুরিয়ামে মাছ, অক্টোপাস, শামুক ঝিনুক জীবন্ত রয়েছে। পছন্দ অনুযায়ী খাবার উপযোগী করে দেওয়া হবে। বিশাল বিশাল গলদা চিংড়ি এবং অন্যান্য খাবার যখন টেবিলে পরিবেশিত হতে লাগল তখন বুঝলাম, কয়েক হাজার ইউয়ান খরচ করছে টম। আমাদের সঙ্গে ব্যবসা হবে কিনা তখনও কিছুই ঠিক ঠিকানা নেই। অথচ বিশ ত্রিশ হাজার টাকার খাবার আমাদের খাইয়ে দিচ্ছে সে। টমের সঙ্গে অবশ্য ব্যবসা হয়েছিল। এবং এই দামি  রেস্টুরেন্টটিতে আরো কয়েক দিন আমাদের আপ্যায়ন করেছে তারা বেশ ঘটা করেই। ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া কিছু সামগ্রী আমি উপহার দিয়েছিলাম ওদের। জেনিকে দিয়েছিলাম একটি কাতান শাড়ি। শাড়ি পরে খুবই সুন্দর লাগছিল তাকে। এবং লজ্জায় প্রায় নুয়ে পড়ছিল সে।

 

ব্যবসা সূত্রে আলাপ হওয়া আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আমাদের এমনি আপ্যায়ন করেছিল। আরেকটি প্রতিষ্ঠানের মালিকের নাম ছিল টমিটম। সে ভদ্রলোক দারুণ কৌতুকপ্রিয়। তিনিও আমাদের রাতে ভালো খাবার খাইয়েছিলেন। ভদ্রলোকের মনোভাব ছিল, ব্যবসা হোক না হোক বিদেশি কয়েকজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব তো হলো। এটাই চীনা আতিথেয়তা।

 

কুয়াংচোওর এই দিনগুলো আমাকে খুব স্মৃতি তাড়িত করে। সবুজ সুন্দর কুয়াংচোও শহর এবং তার অধিবাসী বন্ধুদের ভুলতে পারি না আজও।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ নভেম্বর ২০১৬/মারিয়া/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়