ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বর্ষা

জাহাঙ্গীর আলম বকুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৩০ জুন ২০১৫   আপডেট: ১৫:৫৭, ১৫ জুন ২০২১
বর্ষা

জাহাঙ্গীর আলম বকুল

ঋতুচক্রে বাংলায় আবার বর্ষা এসেছে। আষাঢ়ের অবিরাম বরিষণে সিক্ত হচ্ছে প্রকৃতি। জনহীন মাঠে অবিরাম ধারার মধ্যে নিঃসঙ্গ তালগাছটি যবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে তৃষ্ণা মিটাচ্ছে। বিদ্যুৎ ঝলকানির আলোয়, আর মেঘের গগনবিদারী গর্জন নির্জন-শান্ত পরিবেশকে মাঝেমধ্যে করছে চমকিত। কিছুক্ষণের বিরতি ‍দিয়ে ঝরছে মুষলধারায় বৃষ্টি।

গ্রীষ্মের তপ্ত-বিধ্বস্ত প্রকৃতি বর্ষায় আবার পল্লবিত হতে শুরু করেছে। শুকিয়ে যাওয়া নদী-প্রান্তর ভরছে নতুন জলে। কানায় কানায় পূর্ণ হবে খাল-বিল। গ্রামের-প্রান্তরের ডোবায়, ঝিলে শোনা যাবে ব্যাঙের বিরতিহীন ডাক।

এ জনপদের মানুষের জীবনে বর্ষার প্রভাব বহুমাত্রিক। আবহমানকাল থেকে এখানকার মানুষের জীবন-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে নদীমাতৃক অববাহিকাকে ভিত্তি করে। বর্ষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির আনন্দ-নিরানন্দের বহু গল্প-গাথা। অনেক বিরহের উপাখ্যান। এই বর্ষা একই সঙ্গে বাঙালিকে দিয়েছে উৎপাদন, করেছে ধ্বংস। বর্ষায় নদী ছাপিয়ে যাওয়া পানি পলি ছড়িয়ে দিয়ে উর্বর করেছে বাংলার মাঠকে। পলি আর পানি অধিক ফলন দেয় কৃষককে। নিরাপদ ও সহজ করে মাছে-ভাতে বাঙালির জীবনযাত্রাকে। বর্ষা বাঙালির জীবন-গাথার সঙ্গে মিশে জীবনকে যেমন করেছে রোমাঞ্চিত, শিহরিত, আবার কখনো তা নিষ্ঠুরতার-বেদনার।

ঝুম বর্ষার মধ্যে যখন প্রকৃতি নিস্তব্ধ, প্রিয়জন ছাড়া গৃহে একাকী নারীর বিরহের ব্যথা প্রকাশ হয়েছে রাধার কণ্ঠে। কৃষ্ণ বিরহে রাধার যে ব্যাকুলতা তাতে শাশ্বত বাঙালি নারীর রূপ-ই ধরা পড়েছে। মধ্যযুগের কবি বিদ্যাপতি রাধার কণ্ঠে বলিয়েছেন- ‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর/ এ ভরা বাদর মাহ ভাদর/শূন্য মন্দির মোর।’

বর্ষার প্রথম সাদা মেঘকে দূত বানিয়ে প্রেয়সীর কাছে বিরহের বার্তা পাঠিয়েছেন মহাকবি কালিদাস। তার মেঘদূতের নায়ক যক্ষের ধরণীর আকাশে আষাঢ়ের প্রথম মেঘ দেখে প্রেয়সীকে মনে পড়ে। বিধাতার আদেশে প্রেয়সীকে অলকাপুরীতে রেখে ধরাধামে আসতে হয়েছে যক্ষকে। বর্ষায় রামগিরি পর্বতের শিখরে সাদা মেঘ উড়ে যেতে দেখে প্রেয়সীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় পাগলপ্রায়। তার ব্যাকুলতার কথা জানানোর জন্য মেঘকে সে দূত করে পাঠিয়েছে অলকাপুরিতে।

বর্ষায় রোমাঞ্চকে উপেক্ষা করতে মানা করেছেন কবিগুরু রবি ঠাকুর। কালপরিক্রমায় বর্ষার পরে আসবে পাঁচটি ঋতু। ভিন্ন ভিন্ন রূপে সাজবে প্রকৃতি, কিন্তু বর্ষার দিনের মতো স্মৃতি রোমন্থন করার আবহ আর আসবে না। ‘আজি বরিষণমুখরিত শ্রাবণরাতি/ স্মৃতিবেদনার মালা একেলা গাঁথি।।/ আজি কোন্‌ ভুলে ভুলি আঁধার ঘরেতে রাখি দুয়ার খুলি/ মনে হয় বুঝি আসিছে সে মোর দুখরজনীর সাথি।।’ দুখরজনীর সাথি ধরা দিয়েছে বর্ষায়।

বর্ষায় সাদা-কালো মেঘের মতো মনকে হংসবলাকার পাখায় ভর করিয়ে উড়িয়ে নিতে আহ্বান করেছেন- ‘মন মোর হংসবলাকার পাখায় যায় উড়ে/ ক্বচিৎ ক্বচিৎ চকিত তড়িত-আলোকে।/ঝঞ্জনমঞ্জীর বাজায় ঝঞ্ঝা রুদ্র আনন্দে।’

মুষলধারায় বর্ষা জগৎ-সংসার তুচ্ছ করে গৃহকোণে প্রিয়াকে গোপনে কথা বলার সুযোগ করে দেয়। রবীন্দ্রনাথ ‘এমন ঘনঘোর বরিষায়’ প্রিয়াকে সম্মুখে বসিয়ে আধো-অন্ধকারে ‘কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে/ হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভাব’ করতে বলেছেন।

তবে শুধু রোমাঞ্চ আর বিরহের আবহ নিয়ে বর্ষা আসে না, যুগে যুগে বর্ষা নিয়ে এসেছে ধ্বংস আর দুঃখের উপাখ্যান। কিছু মানুষের জন্য বর্ষা রোমাঞ্চের। কিন্তু সম্বলহীন মানুষের জন্য বর্ষা দারুণ কষ্টের। বর্ষা নিয়ে আসে বন্যা, ধস, ভাঙন। ভারি বর্ষা মানেই ভাটি অঞ্চলের এ দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে থইথই পানি। পাহাড় ধসে পড়ে মৃত্যু, আর হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি। ২০০০, ২০০২, ২০০৩, ২০০৪ ও ২০০৭ সালের প্রবল বর্ষণে দেশ বন্যায় প্লাবিত হয়। নদীভাঙনের কবলে পড়ে অনেক অঞ্চল।

এ বছর গত কয়েক দিনের টানা ভারি বর্ষণে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বহু এলাকা পানিতে তালিয়ে গেছে। কক্সবাজার, বান্দরবানে পাহাড়ি ঢলে এবং পাহাড়ধসে কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। বৃষ্টির এ প্রবল ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তবে মৃত্যুর সংখ্যা এবং ক্ষতির পরিমাণ নিশ্চয় বাড়বে। খেতের ফসল এবং ঘর হারিয়ে পথে বসবে বহু প্রান্তিক মানুষ।

বর্ষা সুখকর নয় পাহাড়ের পাদদেশে বাস করা মানুষের। বর্ষা আসে, পাল্লা দিয়ে পাহাড় ধসে পড়ে। মাটি চাপা পড়ে মৃত্যু হয় মানুষের। গত ১৫ বছরে চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পাহাড় ধসে তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তারপরও থেমে নেই পাহাড়ের ঢালে বসবাস। যাওয়ার জায়গা নেই এই সব মানুষের।

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০০০ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাড়ে সাত কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর্থিক ক্ষতি সাড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। গত দুই দশকে দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) বার্ষিক গড়ে ১ দশমিক ৮ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে।

২০০০ সালের বন্যায় ৪০ উপজেলা, ২০০২ সালের বন্যায় ২০৯টি উপজেলা, ২০০৩ সালের দুই দফায় বন্যায় ৩৬টি জেলা প্লাবিত হয়। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে ৩০টি জেলা, এর দুই বছর পর ২০০৯ সালে আইলায় ৬৪ উপজেলা বিধ্বস্ত হয়।

এ দেশের গণমানুষের কাছে বর্ষা রোমাঞ্চের অনুভূতি আনে না। বর্ষা মানে অসহায় দিনমজুরদের কাজের অভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা। নদীভাঙনে হাজার হাজার মানুষ সহায়-সম্বল হারিয়ে পথে বসা। কৃষকের হাজার হাজার একর ফসলের ক্ষতি। বর্ষা নিয়ে আবহমান বাংলায় যত জীবনোপাখ্যান রচিত হয়েছে, যুগে যুগে হবে- সেখানে রোমাঞ্চের অনুভূতি বেশি থাকে না, সে উপাখ্যান নির্মম বাস্তবতার।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ জুন ২০১৫/বকুল/এএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়