ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

উ প কূ লে র প থে

বাঁকখালী নদী কেন্দ্রিক বাণিজ্য এখন অতীত

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১০, ২৫ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাঁকখালী নদী কেন্দ্রিক বাণিজ্য এখন অতীত

রফিকুল ইসলাম মন্টু, কক্সবাজারের বাঁকখালী নদী তীর ঘুরে : বাঁকখালী নদী কেন্দ্রিক বাণিজ্য এখন অতীত। যে নদী এক সময় কক্সবাজারের বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল, সেই নদীর বুক ক্ষত-বিক্ষত। দখল-দূষণে বিপন্ন। নদীর বুকে বসছে পিলার। ঠিক করা হচ্ছে বাড়ির নিশানা। কোথাও উঠছে পাকা ভবন। আবার কোথাও ময়লা-আবর্জনা ফেলে পানি প্রবাহ আটকে দেওয়া হচ্ছে।

 

এইসব দৃশ্য দেখে বোঝার উপায় নেই এককালে এখানে খরস্রোতা নদী ছিল। এই নদী ঘিরে এক সময়ের জমজমাট কস্তুরাঘাট এখন ফাঁকা। অথচ এখানে ছিল ব্যবসার কেন্দ্র। সওদাগরদের নৌকা ভিড়ত।

 

পাহাড় থেকে আসা বাঁকখালী নদী পর্যটন নগরী কক্সবাজার শহরের গা ঘেঁষে সমুদ্রে গিয়ে মিলেছে। এই নদী তীরের বাণিজ্যকেন্দ্র কস্তুরাঘাট ছিল জমজমাট। সেখানে ট্রলার ভিড়ত, মালামাল উঠানামা করত, বহু শ্রমিক সেখানে কাজ করতেন। ব্যবসা-বাণিজ্য করে দিন চলত বহু মানুষের।

 

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বাঁকখালী নদী মরতে বসলেও বন্দরের কাজে নিয়োজিত বিআইডাব্লিউটিএ ভবন দাঁড়িয়ে আছে তীরে। সেখানে লোকজনের দেখা মিলল না। প্রায় শুকিয়ে যাওয়া নদীর কিনারে পড়ে আছে পুরনো ট্রলার, স্পিডবোট। বদর মোকামের কস্তুরাঘাট থেকে দুই কিলোমিটার ঘুরে দেখা যায়, স্থানীয়রা বাঁকখালী নদীর তীর দখলে নিয়ে ভরাটের আয়োজন সম্পন্ন করেছেন। কেউ বাঁধ দিয়েছেন। কেউ ভরাট করেছেন।

 

বাঁকখালী নদীর তীরে দীর্ঘদিন বসবাস করা ৬৫ বছর বয়সী মোজাম্মেল হক বলেন, নদী ছিল বলে বদর মোকামে জমজমাট ব্যবসা ছিল। বাঁকখালী নদী দিয়ে জাহাজ চলেছে। দূর-দূরান্ত থেকে এসে ট্রলার ভিড়েছে এই ঘাটে। এখন সেই দিন নেই। ব্যবসায় ভাটা। দিন কাটছে কষ্টে। নদী খনন করে পানির প্রবাহ ফেরাতে পারলে বহু মানুষ জীবিকার পথ খুঁজে পাবে।

 

একই দাবি আবদুল মালেকের। তার বয়স ৫৫ বছর। বললেন, কস্তুরাঘাট থেকে ট্রলারে করে সরাসরি কুতুবদিয়া যেতে পারতেন। এখন নদীর তীর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে শহরের ৬ নম্বর ঘাটে গিয়ে ট্রলারে উঠতে হয়। নদীর তীর দখল করে বাড়িঘর উঠেছে। ঝাউবন কেটে বাড়ি করা হয়েছে। এখন জীবিকার পথ বন্ধ। নদীকে বাঁচিয়ে রাখলে বহু মানুষ বেঁচে থাকতে পারতেন। 

 

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, এককালের জমজমাট কস্তুরাঘাট মরে গিয়ে জেগে উঠেছে ফিশারী ঘাট। এটি এখন জেলার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র বলে পরিচিত। এই ঘাটের আশপাশের এলাকাও এখন দখলের কবলে। ঘাট থেকে এক কিলোমিটার জুড়ে ২০টির বেশি বরফ কল রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, খাস জমিতে এইসব বরফ কল গড়ে উঠেছে। এখানে দখলের রয়েছে ভিন্ন কৌশল। বরফ কলের জেটিঘাটের পাশ দিয়ে প্রথমে ইট ফেলা হয়। পরে অবস্থা বুঝে বাউন্ডারি দিয়ে দখলে নেওয়া হয়।  বাঁকখালীর তীর দখল করে ১০টির বেশি পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।

 

 

কস্তুরাঘাটে দাঁড়ালে বহু মানুষের দুর্ভোগের চিত্র চোখে পড়ে। এক সময়ে এখানে ঘাট ছিল। এখান থেকে যাত্রীরা ট্রলারে উঠত বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে। এখন এই ঘাট থেকে একটি রাস্তা নির্মিত হয়েছে। রাস্তা থেকে ঘাট পর্যন্ত চলে গেছে কাঠের জেটি। মালামাল বহনকারী হোক, অসুস্থ যাত্রী হোক- সবাইকে এই জেটি দিয়ে পায়ে হেঁটে গিয়ে নৌযানে উঠতে হয়। যা ঝুঁকিপূর্ণ।

 

জেলা স্পিডবোট মালিক সমিতির সভাপতি মাওলানা রফিউদ্দিন বলেন, গত ২০-২৫ বছরে বাঁকখালী নদীতে ড্রেজিং হতে দেখেননি। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে অব্যাহত দখল। দূষণে-দখলে মরছে বাঁকখালী। নদী ভরাট হওয়ায় ঘাট অন্তত আড়াই কিলোমিটার দূরে সরে গেছে। যেখানে জাহাজ চলত, সেখানে এখন মানুষের হাঁটার পথ।

 

সূত্র বলছে, বাঁকখালী নদী রামু উপজেলার গর্জনিয়া ইউনিয়ন থেকে বাংলাবাজার ব্রিজ হয়ে বদর মোকামের মোহনা পর্যন্ত ভরাট হয়ে গেছে। ড্রেজিং করে এই স্থানটুকু সচল করে দিলে নদী আবার প্রাণ ফিরে পেতে পারে। ড্রেজিংয়ের আগে দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে।

 

বাঁকখালী তীরের অবৈধ দখলদারদের তালিকা প্রশাসনের হাতে রয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশে খতিয়ান, দাগ ও জমির পরিমাণ উল্লেখ করে তৈরি হয়েছে ৬৭ জন দখলদারের তালিকা। কিন্তু উচ্ছেদের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ নেই প্রশাসনে। ফলে অভিযান চালাতে এই ধীর গতি। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো উচ্ছেদ অভিযান জোরদারের দাবি তুলেছে। বাঁকখালীর তীরে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে তারা। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, বাঁকখালীর তীরে অনেক বড় বড় স্থাপনা নির্মাণ হয়েছে। এগুলো উচ্ছেদ সহজ নয়। এ জন্য অর্থের প্রয়োজন। অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি হয়েছে আগেই। বিভিন্ন সময়ে উচ্ছেদ অভিযানও চলছে।

 

 

পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্য নেচার অব বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান এ এন এম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের অফিসে সিদ্ধান্ত হয় বাঁকখালী নদীর তীরের দখলদারদের উচ্ছেদের। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। পৌর কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে নদী তীরে ময়লা-আবর্জনা ফেলে ভরাট করছে। উচ্ছেদে গড়িমসি কেন তারা বুঝতে পারছেন না।’

 

তিনি বলেন, কক্সবাজার শহররক্ষা বাঁধ নেই। বাংলাবাজারের ছমুদা ব্রিজ থেকে বাঁকখালী নদীর মোহনা নাজিরের টেক পর্যন্ত শহররক্ষা বাঁধের দাবি দীর্ঘদিনের। শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণ, বাঁকখালী নদীর তীরের দখলদার উচ্ছেদ এবং এ নদী ড্রেজিং করে কেবল কক্সবাজারকে বাঁচানো সম্ভব। বাঁকখালী সচল করার মধ্য দিয়ে এখানকার বাণিজ্যিক ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব। 

 

 

রাইজিংবিডি/কক্সাবাজার/২৫ নভেম্বর ২০১৬/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়