ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বাংলাদেশি পাঠক ধর্মনিরপেক্ষ পশ্চিমবঙ্গের পাঠক মৌলবাদী: সমরেশ মজুমদার

জব্বার আল নাঈম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৮ জুন ২০১৬   আপডেট: ১২:০১, ৯ মে ২০২৩
বাংলাদেশি পাঠক ধর্মনিরপেক্ষ পশ্চিমবঙ্গের পাঠক মৌলবাদী: সমরেশ মজুমদার

সমরেশ মজুমদার সমকালীন বাংলা সাহিত্যের পাঠকপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। জন্ম ১৯৪২ সালের ১০ মার্চ, পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি। একে একে লিখেছেন দৌড়, এই আমি রেণু, উত্তরাধিকার, বন্দীনিবাস, বড় পাপ হে, বাসভূমি, গর্ভধারিণী, উনিশ বিশ, কালবেলা এবং কালপুরুষ-এর মতো উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন, ইতিহাস ও ঐতিহ্য আয়ত্ত্ব করে সাহিত্যে তিনি সহজাত প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। বরেণ্য এই ঔপন্যাসিক ২১ আগস্ট, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সে সময় তরুণ কবি জব্বার আল নাঈম সাক্ষাৎকারটি নেন।  

জব্বার আল নাঈম : প্রতিবারের ন্যায় এই সফরের সঙ্গে আপনার অন্য সফরের কোনো পার্থক্য বা উদ্দেশ্য আছে কি?

সমরেশ মজুমদার : হ্যাঁ, অন্যান্য বারের চেয়ে এবারের আসাটা ভিন্ন কারণে। এবার এসেছি প্রিয় বন্ধু এবং দুই বাংলার দুই আলোচিত ও বরেণ্য লেখক হুমায়ূন আহমেদ এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মরণ সভা অনুষ্ঠানে। এ ছাড়াও পরিচিত প্রকাশক এবং দেশটাকে আরেকটু ঘুরেফিরে দেখার ইচ্ছেটা তো আছেই। (হাসতে হাসতে) বাংলাদেশে না এসে উপায় আছে? এখানে আমার পাঠক এবং প্রকাশকরা থাকেন।

জব্বার আল নাঈম : হুমায়ূন এবং সুনীলের কথা যেহেতু এলো, সেহেতু জানতে চাই, তাদের শূন্যস্থান পূরণ করার মতো কাউকে আপনার চোখে পড়েছে?

সমরেশ মজুমদার : এই মুহূর্তে না। কারও নামও সেভাবে শুনছি না। হুমায়ূন বা সুনীলরা বারবার আসে না। ওরা যখন আসে তখন সব কিছু ওদের দখলে নিয়ে নেয়। ওদের মতো পাঠকপ্রিয় সাহিত্যিক থাকলে সাহিত্যের লাভ। অন্য লেখকদেরও লাভ। আর ওদের লেখার মানের কথা অনেকে বলে থাকে। আমি সেখানে দ্বিমত পোষণ করি। কারণ কঠিন কাজটা অনেকে করতে পারলেও সহজ কাজটা অনেকে সহজভাবে করতে পারে না। এটাই তাদের শক্তিমত্তার দিক।

জব্বার আল নাঈম : জীবনের এ প্রান্তে এসে শৈশব আপনাকে কতটুকু ভাবায়?  

সমরেশ মজুমদার : হ্যাঁ, আমার জন্মস্থান সেই ডুয়ার্সের চা বাগান আমাকে ভাবায়। আসলে সবারই ছোটবেলা আনন্দে কাটে। সেই শৈশব, বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবই আমার মনে পড়ে। কিন্তু আমি তো কালের যাত্রী, পথের যাত্রী (হা হা হা)।

জব্বার আল নাঈম : ১৯৬৭ সালে দেশ পত্রিকায় আপনার গল্প, ১৯৭৫ সালে সেখানেই উপন্যাস প্রকাশিত হয়। ওই সময়ের অনুভূতি কেমন ছিল?

সমরেশ মজুমদার : সেই সময়ের অনুভূতি এখনো আমার কাছে স্পষ্ট। আমি তখন আনন্দে আত্মহারার মতো ছিলাম। কালের পরিক্রমায় দেশ-এর সেই জৌলুস ভাব অনেকটাই কমে গেছে। সেই সময়ের সাগরময় ঘোষের দেশ পত্রিকার সঙ্গে আজকের দেশ-এর তফাত লক্ষণীয়। এটা সত্য উচ্চারণ। এ কথা বলতে অনেক সাহসের প্রয়োজন হয় না। ওই সময় দেশ পত্রিকায় লেখা প্রকাশ মানে লেখকের স্বীকৃতি পেয়ে যাওয়া। আর সাগরদা তো লেখক তৈরি করতে গিয়ে গোটা লেখক জীবনটাই বিসর্জন দিয়েছেন।

জব্বার আল নাঈম : কালবেলায় আমরা দেখি উত্তরবঙ্গ থেকে উঠে আসা অনিমেষ কলকাতার রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হলে তার জীবনের মোড় ঘুরতে শুরু করে। সে আশ্রয় নেয় কমিউনিস্ট পার্টির পতাকাতলে। কথা হলো, মাধবীলতা তো কমিউনিস্ট না? তাহলে অনিমেষের আশ্রয়?

সমরেশ মজুমদার : আমি মনে করি পলিটিক্সের চেয়ে ধর্ম অনেক শক্তিশালী। আবার ধর্ম থেকে হৃদয়বান আরো বেশি শক্তিশালী। আমরা যদি একই ধর্মের মানুষ হই তবেই আমরা একত্র হব। তখন আমরা পলিটিক্যালি যাব না। একই ধর্ম বলতে একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারা। আবার যদি শত্রু হই, বা দুই ধর্মের হলে মারামারিও করতে পারি। তেমনি আপনি যখন একজন মেয়েকে ভালোবাসেন, তার ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হবেন। তার ধর্মকে বিশ্বাস করতে থাকবেন। বাংলাদেশ থেকে আসা মাধবীলতা কমিউনিজম বিশ্বাস করে না সত্য কিন্তু রাজনৈতিক একটা ধর্ম তারও ছিল এবং আছে। মাধবীলতার মধ্য দিয়ে হয়তো সেই দর্শনের ভেতরে হাঁটা।

জব্বার আল নাঈম : কালপুরুষ নিয়ে চলচ্চিত্র হয়েছে। এটি টরেন্টো ফিল্ম ফেস্টে প্রদর্শিত এবং ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড জিতেছিল। শুনেছি ছবির পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আপনাকে অভিনয়ের অফার দিয়েছিলেন?

সমরেশ মজুমদার : হা হা হা... যে কালপুরুষ চলচ্চিত্র হয়েছে সেই কালপুরুষ আমার না। নামটা ছিল আমার। আর আমাকে কল করেছিল ক্ষমা চাওয়ার জন্য। তারা এই নামটা আমাকে না জানিয়ে নিয়েছিল। আর আমার অভিনয় করার তো প্রশ্নই আসে না। আমি কি অভিনয় জগতের কেউ?

জব্বার আল নাঈম : কখনো অনিমেষ হতে চেয়েছিলেন?

সমরেশ মজুমদার : (ধূমপানের পর কাশি) এই সমাজের ভেতরে অনিমেষরা বাস করে। তাহলে অনিমেষরা সমাজ। আমি তো সমাজবদ্ধ জীব। আমি তো অনিমেষ হতেই পারি। তবে অনিমেষ চরিত্রটি আমার কাছে অন্য রকম লাগে। মাঝেমধ্যে বিষয়টি নিয়ে আমি একা একা অনেক ভেবেছি।

জব্বার আল নাঈম : আপনার উপন্যাস মেয়েরা যেমন হয়-এ বলেছিলেন, মেয়েরা প্রথমবার প্রেমে পড়ে তাকে ঘৃণা করলেও ভুলে যেতে পারে না, পরিষ্কার জল কাগজে পড়লে শুকিয়ে যাওয়ার পরও দাগ রেখে যায়?

সমরেশ মজুমদার : প্রত্যেক মানুষই জীবনের প্রথম কিছু ভুলতে পারে না। জীবনের প্রথম চাওয়াতে এক ধরনের ইমোশন কাজ করে। সেখানে অনেক স্বপ্নের প্রসারতাও থাকে, তাই ভোলা সম্ভব হয় না। যারা বলে ভুলতে পারে তারা অভিনয় করে মাত্র। মেয়েরা কি তার ব্যতিক্রম! দুটি পদার্থ ধাক্কা খেলে একটি দাগ থাকা স্বাভাবিক।

জব্বার আল নাঈম : গর্ভধারিণী উপন্যাসে সুদীপ বলেছিল ‘পেতে হলে কিছু দিতে হয়। ত্যাগ করতে না চাইলে পাওয়ার আশা অর্থহীন।’ বাঙালি মলমূত্র এবং বীর্য ছাড়া কিছুই ত্যাগ করতে জানে না। এটা কতটুকু সত্য?

সমরেশ মজুমদার : কাহিনি এবং আলোচনার প্রারম্ভে অনেক কথা চলে আসে। বাঙালি বিশ্বে স্যাক্রিফাইস জাতি। বাঙালির অতিথি বরণ গোটা বিশ্বে অনন্য। তারা কম রোজগারে সন্তুষ্ট, অল্পতে আরাম-আয়েশ করে, দেশপ্রেমেও বিরল। তারা প্রয়োজনের তাগিদে রক্ত কেন জীবন স্যাক্রিফাইস করতেও জানে। যার প্রমাণ ছিল ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলনে, ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে। আমি তো এই বীরের জাতিকে স্যালুট করি। এ দেশে ফিরে এসে আমি প্রাণ পাই, শক্তি এবং সাহস পাই। উজ্জীবিত হই।

সমরেশ মজুমদার, ইনসেটে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী কবি জব্বার আল নাঈম

জব্বার আল নাঈম : কলকাতার লেখকদের বই বাঙালি পাঠক বেশি ক্রয় করে। কিন্তু ঢাকার লেখকদের বই কলকাতায় কম বিক্রির কারণ কী বলে মনে হয়? এটা কি লেখার মান-গুণ না ধর্মান্ধতা?

সমরেশ মজুমদার : বাংলাদেশের বাঙালি পাঠক ধর্মনিরপেক্ষ। তারা হিন্দু-বৌদ্ধ বা মুসলমান সবার বই পড়ে অভ্যস্ত। সেখানে কলকাতার হিন্দু পাঠকরা কট্টরপন্থী, তারা ধর্মনিরপেক্ষতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না। বাঙালি মুসলমান পাঠক রাম-লক্ষ্মণ-সীতা, হরে কৃষ্ণ-কীর্তন এগুলোতে অভ্যস্ত। কিন্তু কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গরা নিজেকে উঁচু বংশের ভাবতে গিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে। বাঙালি চরিত্রে নামাজ, রোজা, আপা-দুলাভাই, আব্বা, ভাই, বোন, আম্মা এগুলোর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এখনো নিজেকে মিলাতে পারছে না। এখানেই মৌলবাদ, এখানে ধর্ম। বাংলাদেশি পাঠকরা অনেক ধর্মনিরপেক্ষ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পাঠক অনেক বেশি মৌলবাদী। বই কম বেচাকেনার এটাই অন্যতম কারণ।

জব্বার আল নাঈম : এর আগে আপনি যখন বাংলাদেশে আসেন, প্রেসক্লাবের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘বাঙালি পাঠক আমাদের পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য জীবিত রাখতে পারে’। কারণ সাহিত্যের রাজধানী কলকাতা নয়, বাংলার ঢাকায়। এর কারণ ব্যাখ্যা করবেন?

সমরেশ মজুমদার : এটা শুধু ওই অনুষ্ঠানে কেন, প্রায় অনুষ্ঠানে আমি বলি। পশ্চিমবঙ্গে যেখানে ভাষাকে সর্বগ্রাসী থেকে রক্ষা করতে পারছে না; সাহিত্য তো পরের কথা। বাংলা সাহিত্যের রাজধানী ঢাকা অনেক আগে থেকেই। কলকাতার এই জেনারেশন ইংরেজির প্রতি বেশ দুর্বল। ইংরেজি মানে অতি উচ্চমার্গীয়। ওরা জানে না নিজের সর্বনাশ করে অন্যকে উদ্ধার করাটা কতটা অযৌক্তিক। ভাষা না থাকলে জাতি থাকে না।

জব্বার আল নাঈম : আপনি বললেন, বাংলাদেশের পাঠক ধর্মনিরপেক্ষ, পশ্চিমবঙ্গের পাঠক মৌলবাদী- বিষয়টি ওভারকাম কীভাবে সম্ভব?

সমরেশ মজুমদার : এটা তো পশ্চিমবঙ্গ তথা হিন্দু সম্প্রদায়ের রক্তে মিশে আছে। তবে এখনকার কলকাতার ইয়াং জেনারেশন এই কট্টরপন্থী মনোভাব থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে। যখন কলকাতার বাইরে যাই, অস্ট্রেলিয়া বলুন আমেরিকা বলুন তারা কিন্তু ধর্ম বিচার করে না। সাহিত্য বিচারে, সাহিত্য পর্যালোচনা করে। আমার বিশ্বাস একসময় তাদের এই মৌলবাদী ধারণা থাকবে না।

জব্বার আল নাঈম : বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ হচ্ছে না। এটা কতটা জরুরি?

সমরেশ মজুমদার : অনুবাদের বিকল্প হতে পারে না। অনুবাদ ছাড়া সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। আবার অনুবাদের জন্য প্রয়োজন দক্ষ অনুবাদক। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ তে নোবেল পাওয়ার অন্যতম কারণ এই অনুবাদ। না হলে বিশ্বসাহিত্য রবীন্দ্রনাথের মতো হীরক খণ্ডটি চিনতে পারত না। আমাদের সাহিত্যে নোবেলের যোগ্য অনেকে আছে।

জব্বার আল নাঈম : আপনার ধারণা কারা পেতে পারে? বা নোবেল পেতে পারত?

সমরেশ মজুমদার : রবীন্দ্রনাথের পর থেকে এই সংখ্যা তো অনেক! যাদের অনেকেই বাংলা সাহিত্যে জীবিত নেই, দু-একজন ছাড়া।

জব্বার আল নাঈম : সম্পাদক সাগরময় ঘোষ সম্পর্কে কিছু বলবেন?

সমরেশ মজুমদার : বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। এই রকম স্বার্থহীন সম্পাদক বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় কাউকে আমার জীবদ্দশায় দেখিনি। সাগরদার ভালো গুণ ছিল সে লেখা বের করতে পারত। এবং কাউকে টার্গেট করলে তাকে লেখক বানিয়ে ছেড়েছে, এই রকম উদাহরণ অসংখ্য। সুনীলদা কে দিয়ে উপন্যাস লেখিয়েছে। এবং একজন ঔপন্যাসিক বানিয়ে ছেড়েছে। অন্যের সাহিত্য প্রতিভা বিকাশ তথা উপকার করতে গিয়ে নিজ সাহিত্যের আত্মাহুতি দিয়েছেন সাগরদা।

জব্বার আল নাঈম : আপনি বলেছেন, এরশাদ সরকারের শাসনামল ভালো ছিল। আসলে কোন দিক দিয়ে ভালো ছিল?

সমরেশ মজুমদার : অনুন্নত সব রাস্তাঘাট যোগাযোগ উপযোগী করেছিলেন এরশাদ সাহেব। তার আমলে রাস্তাঘাটের চেহারা বদলে গেল। এরশাদ সাহেব কবিতা লিখতেন, তিনি অনেক ভালো মনের মানুষ। যখন বন্যায় প্লাবিত ছিল সমগ্র বাংলা তখন তিনি গাম্বুট পরে ত্রাণ বিতরণ করতেন। এ দেশের মানুষ তার বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে আসে তার শাসনামলের শেষ দিকে। তবে এ কথাও সত্য তার শাসনামলে এ দেশের উন্নয়নের রূপরেখা হয়।

জব্বার আল নাঈম : দৌড়, এই আমি রেণু, উত্তরাধিকার, বন্দীনিবাস, বড় পাপ হে, বাসভূমি, গর্ভধারিণী, উনিশ বিশ, কালবেলা এবং কালপুরুষ আপনার অমরত্বের জন্য কি যথেষ্ট?

সমরেশ মজুমদার : সময় একটা ফ্যাক্টর বটে। সময়ই সময়কে উদ্ধার করে। আমার চেয়ে অনেক বড় ঔপন্যাসিকরা আজ আলোচনায় নেই। আবার একটা দুইটা লেখা লিখে অনেকে শত শত বছর অমরত্ব পান। কাফকা’রা মৃত্যুর অনেক বছর পরও আলোচনায় আসে। আমার বোধগম্য নয় যে অমরত্বের জন্য আমার অনেক কিছু করা হয়ে গেছে। তবে যতটুকু আছে তা সবার সামনে। আরো কিছু লিখব ভাবছি, জানি না কতটুকু সফল হতে পারব।

জব্বার আল নাঈম : আপনার সময়ের অনেকে মৃত্যুপথে অভিনন্দন পাচ্ছে, আপনার ভেতরে এ রকম ভাবনা কাজ করে কি?

সমরেশ মজুমদার : মৃত্যু ভাবনা আসাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে তার জন্য আমি ভীত নই। বার্ধক্যের কারণে শারীরিক শক্তি কমেছে। সুনীল, হুমায়ূনরা চলে গেছে, আমাকেও চলে যেতে হবে। তবে মৃত্যুভয় নয়, মৃত্যুচিন্তা মাঝেমধ্যে কাজ করে। সব থাকবে, শুধু আমিই থাকব না- এটা আমাকে ভীষণ ভাবায়।

জব্বার আল নাঈম : আপনার কথা এবং আলোচনার ফাঁকে হুমায়ূন এবং সুনীল বারবার উপস্থিত হয়। এই উপস্থিতির কোনো প্রভাব আছে?

সমরেশ মজুমদার : না থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। সাহিত্যজীবনে অনেক দিন একসঙ্গে কাটিয়েছি। একবার ’৯০-এর পর হুমায়ূন আমাকে দাওয়াত দিয়েছিল। আমিও চলে এলাম। এয়ারপোর্টে ভিআইপি লাউঞ্জে দাঁড়িয়ে আমি হুমায়ূনকে ফোন দিই। হুমায়ূন বলে আপনি রাষ্ট্রীয় অতিথি রুমে গিয়ে বসেন। আমি তাই করলাম। এরপর আবার কল করি হুমায়ূন বলে, নো টেনশন, আপনি ৩ নম্বর গেটে আসেন, আমি আছি। সেখানে গিয়ে পুলিশকে জিজ্ঞাসা করি হুমায়ূন কোথায়? ওরা জানতে চায় কোন থানার ওসি। (হাসতে হাসতে) বললাম, তোমাদের লেখক ওসি হুমায়ূন। তারা বলল, চিনি না। পরে হুমায়ূন এলো। আসলে সে এক নম্বর গেটে ছিল। তার উদ্দেশ্য ছিল আমাকে নিয়ে মজা করা। এরপর সোজা নুহাশপল্লী চলে যাই। সেখানে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনেক পাঠক ছিল। কিন্তু কারো কাছে বলা হয় নি আমার উপস্থিতি। হুমায়ূন যখন সবার সামনে আমার নাম ঘোষণা করে, অনুষ্ঠানের লোকগুলো যে রকম অবাক হয়েছিল, সত্যি বলছি আমি তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছি। হুমায়ূন সত্যি খুব মজার মানুষ ছিল। আর সুনীল দার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় ১৯৮৬ সালে। তার সঙ্গে তো আরো বেশি স্মৃতি। তবে কলকাতায় আমাদের দেখা হতো তুলনামূলক কম। হঠাৎ দেখা হয়ে যেত নিউইয়র্কে, বার্লিনে, সিডনি কিংবা জাপানে। সুনীলদা চিৎকার করে উঠত- ‘এই সমরেশ, এই সমরেশ’ বলে। আসল কথা তাদের ভোলা সম্ভব নয়।

জব্বার আল নাঈম : আপনি বলেছেন লেখক হতে হলে পড়তে হবে। পড়ার বিকল্প কিছু নাই। শুধু কি পড়লেই হবে?

সমরেশ মজুমদার : লেখক হতে হলে প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিভা দরকার হয়। প্রকৃতিপ্রদত্ত জাতটা না থাকলে লেখক হওয়া কষ্টকর। পড়ার কথাটা এ জন্য বলা, পড়লে জ্ঞানের পরিধি বাড়ে। লেখালেখির কৌশলটা আয়ত্ত হয়। অন্য লেখককে বোঝা যায়। এ ছাড়া প্রকৃতি বুঝতে হবে, সমাজ-সংসার এবং বাস্তবতা বুঝতে হবে। ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের তলা দেখতে হবে। অন্তর চক্ষু খোলা রাখলে অনেক কিছু জানা এবং বোঝা সম্ভব হয়। আর জানা সহজ হলে লেখাটাও সহজ হয়। যেমন পড়াতে হবে, প্রকৃতি সম্পর্কে অনুসন্ধানী হতে হবে, ভ্রমণ করতে হবে। মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কেও জানতে হবে। স্বাভাবিকভাবে একজন লেখককে অন্য দশজন জ্ঞানী ব্যক্তির চেয়ে বেশি জানা উচিত বলে আমি মনে করি। আরেকটি কথা বড় লেখক হতে গেলে লিখে লিখে কাগজ বেশি অপচয় করতে হবে।

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুন ২০১৭/এএন

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়