ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

বাংলাদেশের প্রথম বই

মনি হায়দার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৪, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলাদেশের প্রথম বই

বইটির প্রচ্ছদ

মনি হায়দার : বাংলাদেশ। অমৃত সমান বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ অশুভ ও পাশবিক শক্তি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করে। খুব সহজে লিখলাম `বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে`। কিন্তু এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কত মানুষ কতভাবে যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, কতভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন হিসাব কোনো দিন পাওয়া যাবে না। হিসাবের মধ্যে একজন মানুষ চিত্তরঞ্জন সাহা।

 

চিত্তরঞ্জন সাহা পাকিস্তান বর্বর আর্মির আক্রমণে লাখ লাখ বাঙালির মতো ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি বসে থাকার মানুষ ছিলেন না। কাজের মানুষ। বাংলাদেশ ত্যাগ করার আগেই তিনি নোয়াখালীর চৌমুহুনিতে বইয়ের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। কলকাতায় গিয়েও করোটির ভেতরে বইয়ের পাতা ডানা ঝাপটাতে থাকে। তিনি ভারতে প্রবাসী লেখকদের নিয়ে বসলেন, বাংলাদেশের জটিল পরিস্থিতি নিয়ে একটি বই প্রকাশ করতে চান।

 

বইটির নাম ‘রক্তাক্ত বাংলা’। ১৯ জন লেখকের ১৯টি লেখা নিয়ে বইটি প্রকাশিত হয় আগস্ট, ১৯৭১ এ। বইটি বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। লেখক ও লেখার দিকে তাকালে সেটাই প্রতীতি হয়। কারা লিখেছিলেন? কী বিষয়ে লিখেছিলেন? স্বাধীনতার প্রায় ৪৫ বছর পার হয়ে ফিরে তাকালে এক তীব্র অনুভব আর সাহস কাজ করে বোধের ভেতরে।

 

লেখা ও লেখক তালিকার দিতে চোখ রাখি, বঙ্গবন্ধু ও রক্তাক্ত বাংলা, ছদ্য নাম রঞ্জন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের সঙ্গে কয়েক দিন আগে কথা বলে জানা গেছে আসল রঞ্জনের নাম। তিনি অচ্যুত আনন্দ সাহা। থাকতের চিত্তরঞ্জন সাহার সঙ্গে।

 

দ্বিতীয় লেখা, আমাদের বাচার দাবি ছয় দফা কর্মসূচি- শেখ মুজিবুর রহমান। একের পর এক লেখা ও লেখক : পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের গতি প্রকৃতি- রণেশ দাশগুপ্ত, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ- জহির রায়হান, রাষ্ট্রভাষা ও প্রাসঙ্গিক বিতর্ক- আনিসুজ্জামান, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক আন্দোলন- শওকত ওসমান, বাংলাদেশ স্বীকৃতি চায়- রামেন্দু মজুমদার, বাংলাদেশ পরিস্থিতি : একটি সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ- বুলবন ওসমান, মুক্তিযুদ্ধের প্রচ্ছদপট: সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সংগ্রাম- সন্তোষ গুপ্ত, বাংলাদেশ : অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত- মতিলাল পাল, ওদের ফেলে চলে এলাম- সত্যেন সেন, বাংলাদেশ সংগ্রামের সামাজিক পটভূমি- অনুপম সেন, দ্বি-জাতি তত্ত্বের অপঘাত-মৃত্যু- আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, পাকিস্তানের শিক্ষানীতি- আহমদ ছফা, সংস্কৃতির বিকাশধারা- আসাদ চৌধুরী, বাঙালির আত্ম অনুসন্ধান ও লোক ঐতিহ্যের চর্চা : আবদুল হাফিজ, বাংলাদেশ আন্দোলন : সাহিত্যে ও সংস্কৃতির ক্ষেত্র- সৈয়দ আলী আহসান, বাংলাদেশে গণহত্যা : জাফর সাদেক।

 

মূল লেখার পরে ফেরদৌসি মজুমদার পরিশিষ্ট পর্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনাবলি দিন, তারিখ দিয়ে চমৎকারভাবে লিখেছেন এবং ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে গঠিত মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রয়েছে একেবারে শেষের দিকে। আর বইটি প্রকাশ করেছে মুক্তধারা।

 

লেখার শিরোনাম ও লেখকদের নাম পাঠ করার পর ‘রক্তাক্ত বাংলা’ বইটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সর্ম্পকে আর কোনো দ্বিধা থাকে না। খুব পরিকল্পিতভাবে, নিষ্ঠা ও আবেগ দিয়ে মুক্তধারা বইটি প্রকাশ করেছিলে। আরো চমকপ্রদ তথ্য- বইটির অসাধারণ প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন কামরুল হাসান।

 

‘রক্তাক্ত বাংলা’ বইয়ের প্রত্যেকটি লেখা ১৯৭১ সালে বাঙালির চেতনার দুয়ার নতুন ধারণায় উন্মোচন করার প্রয়াস নিয়েছে। আর লেখকদের প্রত্যেকে বাঙালি স্বাতন্ত্র্য সত্তার বলিষ্ঠ সমার্থক। ফলে, ‘রক্তাত্ত বাংলা’ বইটি বাঙালির মানস মানচিত্রের অনবদ্য দলিল হয়ে উঠেছে। বইটির মোট পৃষ্ঠা ৪২২। স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক বইটি প্রকাশিত হয় ৯ অ্যান্টনি বাগান লেন, কলকাতা ৯ থেকে।

 

বইটির উৎসর্গমন্ত্র এখনো, এত বছর পরও বাঙালির মনে উদ্দীপনা জাগায়। উৎসর্গে লেখা হয়েছে- ‘পঁচিশে মার্চের কাল রাত্রিতে যারা আত্মহুতি দিয়েছেন, পঁচিশে মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত যারা রক্তাক্ত বাংলার ইতিহাস রচনায় বুকের রক্ত ঢেলেছেন, ভবিষ্যতেও ঢালবেন, যে লক্ষ লক্ষ বাঙালি শহীদ হয়েছেন হানাদারদের কাপুরুষোচিত আক্রমণে, তাঁদের পূণ্যস্মৃতি স্মরণে রেখে, শিশুঘাতী নারীঘাতী বর্বরতাকে সমবেত কণ্ঠে তীব্র ধিক্কার জানিয়ে এই গ্রন্থ উৎসর্গীকৃত হলো স্বাধীন বাংলার সম্ভাবনায় বিশ্বাসী সৈনিকদের নামে।’

 

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে বাঙালি কতটা ঐক্যবদ্ধ ছিল, কতটা ইস্পাত দৃঢ়তায় লড়াই করেছিল, বইটির অসাধারণ ও সাহসী উৎসর্গই প্রমাণ।

 

‘রক্তাক্ত বাংলা’ বইটির মুখবন্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আজিজুর রহমান মল্লিক লিখেছেন- ‘বাংলাদেশের ঘটনা আজ সারা পৃথিবীকে আলোড়িত করেছে। হতবাক হয়ে বিশ্ববাসী দেখছে এক বর্বর শক্তির নিষ্ঠুর আক্রমণ আর সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবনপণ প্রতিরোধ। লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়েছে। ছিন্নমূল হয়েছে প্রায় এক কোটি লোক, ত্রাসের রাজত্বে বাস করছে আরো কয়েক কোটি। বাংলাদেশ আজ রক্তাপ্লুত, তবু তার স্বাধীনতা সংগ্রামের গতি দুর্বার। বাঙালি লড়ছে মুক্তির জন্য, ন্যায়ের জন্য, মূল্যেবোধের জন্য- যা কিছু মানুষের চিরপ্রিয়, তার জন্য। লড়ছে আত্মবিশ্বাস নিয়ে, জয়লাভের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে।’

 

‘রক্তাক্ত বাংলা’ সংকলনে দেশের একটা সামগ্রিক পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা  করেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখকেরা। দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সমাজতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমির যে আলোচনা এতে সন্নিবেশিত হয়েছে, তা মূল্যবান। মুক্তিযুদ্ধের ও যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের যে বিবরণ এতে দেওয়া হয়েছে, তা চিত্তস্পর্শী। শুধু ঘটনার বর্ণনা নয়, তার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করেছেন লেখকেরা। যে বিশ্লেষণ পাঠককে বাংলাদেশের  মুক্তিযুদ্ধকে বুঝতে সাহায্য করবে।

 

‘রক্তাক্ত বাংলা’ সংকলন গ্রন্থ প্রকাশের আয়োজনকে আমি অভিনন্দন জানাই। ইতিহাস কথা কয়। সত্যি, স্বাধীনতার এত বছর পার হওয়ার পরও বাংলাদেশের প্রথম পুস্তক হিসেবে ‘রক্তাক্ত বাংলা’, মুক্তধারা এবং চিত্তরঞ্জন সাহা ইতিহাসের অনিবার্য অধ্যায় হয়ে রইলেন। ‘রক্তাক্ত বাংলা’ বইটি নতুন করে নতুন প্রজন্মের পাঠকদের কাছে পৌঁছানো জরুরি।

 

কেউ কি উদ্যোগ নেবেন?

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/সাইফুল/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়