ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

বানান নিয়ে নানান রঙ্গ

রফিক মুয়াজ্জিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৪, ২৯ মে ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বানান নিয়ে নানান রঙ্গ

রফিক মুয়াজ্জিন

রফিক মুয়াজ্জিন : ‘বিডিনিউজ লেখে `কাম্প নউ`/ `চাভি এর্নান্দেজ`/ `ইউভেন্তুস`; প্রথম আলো `ক্যাম্প ন্যু`/ `জাভি হার্নান্দেজ`/ `জুভেন্টাস`। আবার, যুগান্তর লেখে `আন্সেলোত্তি`; সমকাল `অ্যানচেলত্তি`; প্রথম আলো `আনচেলত্তি`!’ (ঈষৎ সংক্ষেপিত)।

 

উল্লিখিত অংশটুকু কবি সজল সমুদ্রর ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে নেওয়া।

 

এ লেখার উদ্দেশ্য- কোনো গণমাধ্যম বা গণমাধ্যমকর্মীকে হেয় করা নয়, বরং বানানের ক্ষেত্রে আমাদের স্বেচ্ছাচারী প্রবণতার দু-একটি নজির তুলে ধরা। ওপরে যে চারটি সংবাদমাধ্যমের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, ব্যাপারটি শুধু তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। আরো অনেকে যেমন ইচ্ছে, লিখছেন।

 

এই যে যেমন ইচ্ছে তেমন লেখার প্রবণতা, এটা যে শুধু বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে, তা নয়। অনেক বাংলা শব্দও ইচ্ছেমতো বানানে লেখা হয়। 

 

গ্রেফতার এবং গ্রেপ্তার। একই শব্দ, ভিন্ন বানান। বলা হয়ে থাকে- দুটি বানানই শুদ্ধ। তাই, কেউ গ্রেফতার লেখেন, আর কেউ লেখেন গ্রেপ্তার।

 

একই অবস্থা আরো কিছু শব্দের বানানে, যেমন : দফতর/দপ্তর, রফতানি/রপ্তানি, পরিবহন/পরিবহণ, কৃকেট/ক্রিকেট, ব্রিটিশ/বৃটিশ প্রভৃতি। এ রকম আরো শত শত শব্দ আছে, যা একাধিক বানানে লেখা হয়।

 

গ্রেফতার বা গ্রেপ্তার, যেভাবেই লিখি না কেন, অর্থের হেরফের হবে না। কিন্তু এক ধরনের শৃঙ্খলা তো থাকা উচিত। সবাই যদি ইচ্ছেমতো বানানে লিখতে থাকেন, তাহলে একধরনের অরাজকতা সৃষ্টি হবে। এই প্রবণতা অন্যান্য শব্দের বানানের ক্ষেত্রেও হতে পারে। 

 

এগুলো শুধু যে সংবাদ মাধ্যমে হয়, তা নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সাহিত্য, দাপ্তরিক কাজেও এ ধরনের অজস্র নজির আছে।

 

অনেকের স্বেচ্ছাচারিতা তো আরো ভয়াবহ। তারা লেখেন- গ্যালো, ক্যানো প্রভৃতি। তাদের বক্তব্য- উচ্চারণ অনুযায়ী বানান লেখা উচিত। কারণ, ‘কেন’ লিখলেও আমরা উচ্চারণ করি ‘ক্যানো’। ‘গেল’ শব্দটিকে উচ্চারণ করি ‘গ্যালো’।

 

উচ্চারণ অনুযায়ী বানান লেখার চেষ্টা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে কোনো ভাষাতেই উচ্চারণ অনুযায়ী বানান লেখা সম্ভব নয়।

 

কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আমি বাড়ি যাব, এ বাক্যটি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্নভাবে বলা হয়। গাইবান্ধায়- মুই বাড়ি যাম; কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুরের কিয়দংশে- মুই বাড়ি যাইম; চাঁদপুরে- আঁই বাড়ি যামু।

 

বেগুনকে ‘বাইগন’ বলা হয় বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ‘গেছে’ বোঝাতে বলে ‘গিলছে’। তাহলে কি রংপুরবাসীরা ‘বাইগন’ আর রাজশাহীর লোকজন ‘গিলছে’ বানান লিখবে?

 

এমনকি রংপুর অঞ্চলের লোকজন ‘র’ ধ্বনির স্থলে ‘অ’ বলে। অশিক্ষিত মানুষ তো বটেই, প্রতিবেশী অনেক শিক্ষিত লোকও আমাকে ‘অফিক’ বলে ডাকেন। তাই বলে তো তারা আমার নামের বানান ‘রফিক’ এর বদলে ‘অফিক’ লিখতে পারি না, তাই না? 

 

ভাষাবিজ্ঞানীরা বলেন, প্রতি তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার অন্তর উচ্চারণে সুক্ষ্ণ পরিবর্তন হয়। এ কারণেই, গাইবান্ধায় যেটা ‘যাম’ সেটা কুড়িগ্রামে এসে হয়ে যায় ‘যাইম’। এভাবেই অনেক শব্দ অঞ্চলভেদে ভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়। এ কারণে শুধু উচ্চারণের দোহাই দিয়ে ‘গেল’-এর বানান ‘গ্যালো’ লেখা উচিত নয়।

 

কাউকে বানান শেখানো আমার লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমি ভাষাবিজ্ঞানী বা ব্যাকরণবিদ নই, একজন নবীন সংবাদকর্মী। এর চেয়ে বড় পরিচয় আমি একজন পাঠক। সংবাদ বা সাহিত্য পাঠ করতে গিয়ে যখন একই শব্দের একাধিক বানান দেখি, তখন খুব বিরক্তি অনুভব করি। আমার মনে হয়, এই আমার মতো আরো অনেকেই এতে বিরক্ত এবং বিব্রত। তাই, শুধু এটুকু বলতে চাই- ভাষায় বানানসমতা আনার জন্য স্বেচ্ছাচারী মনোভাব পরিহার করুন। সেটা ভাষার জন্য ভালো হবে।

 

ইচ্ছেমতো বানান লেখার প্রবণতা জিইয়ে রাখলে ভবিষ্যতে আরো বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেটা কখনোই সুখকর হবে না।

 

লেখক : সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী।


 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ মে ২০১৫/রফিক/নওশের

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়