ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বিখ্যাত বইয়ের উৎসর্গের খোঁজে

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৯, ২৫ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিখ্যাত বইয়ের উৎসর্গের খোঁজে

ওপরে বাঁ থেকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, হুমায়ূন আহমেদ। নিচে বাঁ থেকে গোর্কি, হেমিংওয়ে এবং টলস্টয়

মুম রহমান

বই ও লেখকের নাম, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নাম-ধামের (প্রিন্টার্স লাইন) পরেই বই-এ উৎসর্গ পাতা থাকে। সেই পাতায় লেখক সাধারণত প্রিয়জন, প্রিয় স্মৃতি, প্রিয় বিষয়ের কথা উল্লেখ করে বইটি উৎসর্গ করেন। লেখক অনেক পরিশ্রমের পর পাঠকের সামনে একটি বই তুলে ধরেন। সেই বইটি তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশেষ কারো জন্য উৎসর্গ করেন। এই উৎসর্গপত্রটি লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত। তবে এই উৎসর্গ দিয়েও অনেক সময় লেখককে চেনা যায়। বই পড়ার আগেই লেখকের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় সূত্র এবং সর্বোপরি সাধারণের সামনে লেখকের সঙ্গে বিশেষ কারো সম্পর্কের পরিচয় ঘটে উৎসর্গপত্রের মাধ্যমেই।

সমকালের বিখ্যাত তারকা লেখিকা জে কে রাউলিং হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য চেম্বার অব সিক্রেটস  বইটি উৎসর্গ করেছেন  বন্ধু শনকে। তিনি লিখেছেন, ‘শন পিফ হ্যারিস, হারিয়ে যাবার চালক ও বাজে আবহাওয়ার বন্ধু।’ উল্লেখ করা দরকার শনের কাছে জে কে রাউলিং গাড়ি চালানো শিখেছেন এবং একাধিক বাজে আবহাওয়ায় তারা একসঙ্গে ঘুরেছেন। এ সময় তিনি বন্ধুর সঙ্গে হ্যারি পটার নিয়ে আলোচনা করেছেন। শন পিফ হ্যারিস তাকে সব সময় লেখক হতে উৎসাহ দিয়েছেন। হ্যারিস নাম থেকেই ‘হ্যারি’ এসেছে কি না, এ প্রশ্নের উত্তর জানা না গেলেও অনেক পাঠকই এই দুয়ের মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পান।

উৎসর্গ যে সব সময় লেখকের আনন্দের ফসল, তা কিন্তু নয়। রোমান কবি ভার্জিল এবং নাট্যকার-কবি হোরাস দুজনেই তাদের লেখা উৎসর্গ করেছেন মেইসেনাসকে। কারণ, মেইসেনাস ছিলেন ধনী ব্যক্তি। তিনি তাদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ধ্রুপদী সাহিত্যের সেরা এই দুই লেখক তাদের বই যে মনের আনন্দে নয়, দায়ে পড়ে উৎসর্গ করেছেন সেটা বোঝা যায়। ব্রিটিশ লেখিকা জেন অস্টেন এমা উপন্যাসটি উৎসর্গ করেছেন প্রিন্স রিজেন্টকে। তিনি এ কাজটি বাধ্য হয়ে করেছিলেন! কেননা প্রিন্সের সভাসদরা জেনকে তেমনই আদেশ দিয়েছিল।

জেন অস্টেনের এই ঘটনায় পাঠক ভাববেন না, উৎসর্গপত্রে লেখকের দায়বদ্ধতা আছে। হ্যাঁ, কিছু ক্ষেত্রে হয়তো এমন ঘটে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেখক, কবি ভালোবেসেই বই উৎসর্গ করেন। তবে সত্যিকারের ভালোবাসার উৎসর্গপত্র কখনো কখনো বিপদও ডেকে আনতে পারে। স্ত্রী খেপে যেতে পারে, প্রেমিকাও খেপে যেতে পারে। অনেক সময় তো মা না বাবা- কাকে উৎসর্গ করা যায়; নাকি দুজনকেই- এ নিয়ে লেখক রীতিমতো চিন্তায় পড়ে যান। কোনো কোনো লেখকের কাছে উৎসর্গপত্র এ জন্য কঠিন কাজ! আবার আগাথা ক্রিস্টি বা হুমায়ূন আহমেদের মতো লেখক যারা অনেক বই লিখেছেন, তারা অনেক উৎসর্গপত্র লেখার সুযোগও পেয়েছেন। আগাথা ক্রিস্টি মাকে প্রথম বইটি উৎসর্গ করেছেন। তারপর তিনি যারা একঘেয়ে জীবন কাটান কিংবা সেই সব বন্ধুদের কাছেও ক্ষমা চেয়ে উৎসর্গপত্র লিখেছেন, যারা সুইমিংপুলকে মৃত্যু দৃশ্যের বর্ণনায় ব্যবহার করেছেন।

অনেকে আবার উৎসর্গপত্র রহস্যময় করে রাখেন। রহস্যময় উৎসর্গপত্রের উদাহরণ হলো : ‘যাকে দেখেছিলাম একদিন ভোরের আলোয়’, ‘নাম না জানা সেই মেয়েটি’, ‘কথা দিয়েছিল তবু তো পাশে রইলে না’ ইত্যাদি। এগুলো কিন্তু লেখকের গোপন প্রেমের সাক্ষ্য হয়ে থাকে।

যাই হোক, উৎসর্গপত্র চিরকালীন নয়। উৎসর্গপত্রের বদল হয়। সালমান রুশদির বিতর্কিত বই স্যাটানিক ভার্সেস প্রথমে উৎসর্গ করা হয়েছিল তার স্ত্রী ‘মারিয়ানা’কে। পরে রুশদি পলাতক হন। তাদের বিয়ে ভেঙে যায়। রুশদির উৎসর্গও বদলে যায়। তিনি নতুন করে লেখেন, ‘সেই সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে যারা এই প্রকাশনায় সহায়তা করেছে।’ গ্রাহাম গ্রিনের দি অ্যান্ড অব দি এফেয়ার  বইয়ের ব্রিটিশ সংস্করণে উৎসর্গপত্রে বড় হাতের অক্ষরে ‘সি’ লেখা। কিন্তু আমেরিকার সংস্করণে লেখা আছে ‘ক্যাথারিন’। অশ্লীলতার দায়ে নিষিদ্ধ উপন্যাস লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার  আদালতে মুক্তি পাওয়ার পর ডি এইচ লরেন্স উৎসর্গে লেখেন, ‘১২ জন জুরি, তিন নারী এবং নয় পুরুষ, যারা বিনা দোষী বলে বিচার রায়ে সাহায্য করেছেন।’

সি এস লুইস তার দ্য লায়ন, দি উইচ অ্যান্ড দি ওয়ার্ড   নামের শিশুতোষ উপন্যাসের উৎসর্গে একটা চিঠি লেখেন-  ‘প্রিয় লুসি, আমি তোমার জন্যই এই গল্পটা লিখেছি, কিন্তু যখন আমি এটা লেখা শুরু করলাম তখন বুঝতে পারিনি মেয়েরা বইয়ের চেয়ে দ্রুত বাড়ে। যার ফলাফল তুমি রূপকথার গল্প শোনার জন্য বেশি বয়স্ক হয়ে গেছ এখন এবং যে সময় নিয়ে এটি ছাপা ও বাঁধাই হবে সেই সময়ে তুমি আরো বড় হয়ে যাবে। কিন্তু কোনো একদিন তুমি হয়তো যথেষ্ট বয়স্ক হবে যে আবার রূপকথার গল্প পড়া শুরু করবে। তখন তুমি একটা বইয়ের তাকের ওপর থেকে এটা নামাবে, ঝাড়মোছ করবে এবং আমাকে জানাবে তুমি এটা নিয়ে কী ভাবছ? আমি হয়তো তখন এতই বধির হয়ে যাব যে তখন হয়তো তোমার একটি কথাও শোনার বা বোঝার অবস্থায় থাকব না। কিন্তু তখনও আমি তোমার প্রিয় পিতামহ রয়ে যাব।’ এই উৎসর্গের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘দেখা না দেখার’ মিল আছে কোথায় যেন!

মার্কিন কথাসাহিত্যের কর্ণধার জন স্ট্যাইনবাক তার ইস্ট অব ইডেন-এর উৎসর্গটিও লিখেছেন চিঠির আকারে। ‘প্রিয় প্যাট, তুমি আমার কাছে এলে এবং কাঠ থেকে কিছু ছোট্ট পুতুল তৈরির চেষ্টা করলে এবং আমাকে বললে, ‘আমার জন্য তুমি একটা কিছু বানাও না কেন?’
আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করলাম ‘তুমি কী চাও?’ এবং তুমি বললে, ‘একটি বাক্স।’
‘কেন?’
‘জিনিসপত্র রাখার জন্য’
‘কী ধরনের জিনিস?’
‘যা কিছু তোমার আছে’ তুমি বললে।
‘বেশ, এই হলো সেই বাক্স। আমার যা কিছু আছে তার প্রায় সবই এর মধ্যে আছে এবং এটি এখনো পরিপূর্ণ নয়। বেদনা ও উত্তেজনা এর মধ্যে আছে, ভালো ও খারাপ অনুভূতি আছে এবং দুষ্ট ও শিষ্ট ভাবনাও আছে- নকশা তৈরির আনন্দ এবং দুর্দশা ও ভয়াবহ সৃষ্টির আনন্দও আছে। এবং সবার ওপরে তোমার জন্য আমার যত কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা তা-ও আছে। তবুও এই বাক্সটি পরিপূর্ণ নয়।’
এমন বিস্ময় পরিপূর্ণ উৎসর্গপত্র সত্যিই দুর্লভ মনে হয়।

চিলির কবি পাবলো নেরুদা বউকে নিয়ে শুধু কবিতাই লেখেননি, অনেক বই-ও বউকে উৎসর্গ করেছেন। বিখ্যাত লেখকরা অনেকেই তাদের স্ত্রীর নামে বই উৎসর্গ করেছেন। কার্ল সাগানের বিখ্যাত বই কসমস, যা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ে লেখা একটি মহৎ কাজ। বউকে নিয়ে লেখা উৎসর্গপত্রের মধ্যে এটি উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেন- ‘এই বিশাল মহাশূন্য আর অসীম সময়ের মধ্যে এই পৃথিবী নামের গ্রহে এনির সঙ্গে সময় কাটিয়েছি এ আমার আনন্দ।’

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়