ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বিজয় দিবসে আমার কিছু কথা || অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক

অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২৬, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিজয় দিবসে আমার কিছু কথা || অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

চুয়াল্লিশ বছর আগে এই দিনে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমরা জয়লাভ করেছিলাম এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে হানাদার বাহিনীর দখল থেকে মুক্ত করেছিলাম। এই যুদ্ধের পেছনে ছিল আমাদের পাকিস্তান আমলের তেইশ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম। ব্রিটিশ-শাসনামলে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের (১৯০৫-১১) মধ্য দিয়ে সূচিত হয়েছিল গণজাগরণ। সেই গণজাগরণের নিরন্তন বিকাশের ধারায় সংঘটিত হয়েছে আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ ইত্যাদি। আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা কোনো আকস্মিক ব্যাপার ছিল না, কোনো এক ব্যক্তির এনে দেওয়া ব্যাপারও ছিল না। যে কোনো কিছু অর্জন করতে হলে তার জন্য মূল্য দিতে হয়। স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য আমাদেরকেও জানে-মালে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। এই মূল্যদান কেবল আমাদের জাতির ব্যাপার নয়- সব জাতিরই ব্যাপার। মূল্য না দিয়ে কিছু পাওয়া যায় না।

 

সেই রামমোহনের (১৭৭২-১৮৩৩) কাল থেকেই বাংলাদেশের ভূ-ভাগে দেখা দিয়েছিল রেনেসাঁস বা বৌদ্ধিক জাগরণ। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন থেকে ’৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত পুরো সময়টাতেই ক্রিয়াশীল ছিল রেনেসাঁসের স্পিরিট।

 

এক দিকে বৌদ্ধিক জাগরণ, তারই ধারাবাহিকতায় গণজাগরণ- এরই মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা। এর মধ্যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেমন ছিল, তেমনি ছিল বৌদ্ধিক নেতৃত্ব।

 

স্বাধীনতা যুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটিকে এই ঐতিহাসিক বাস্তবতার মধ্যে উপলব্ধি করতে হবে। কিন্তু আজকাল অনেকে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটিকে কেবল অস্ত্রসস্ত্রের দ্বারা যুদ্ধ করে অর্জনের ব্যাপার মনে করেন। অনেকেই আবার যুদ্ধের নয় মাসের সরকারের কথাও বিবেচনায় ধরতে নারাজ! ১৭ই এপ্রিল বাংলাদেশে যথোচিত মর্যাদার সাথে উদযাপিত হয় না।

 

আমাদের স্বাধীনতা-য্দ্ধু ও স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসে সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতির দিকও আছে। সে দিকটাকেও অবশ্যই হিসেবের মধ্যে রাখতে হবে। তা করা না হলে ইতিহাস বিকৃত হয়ে যায়। কোনো জাতির ইতিহাস বিকৃত করা হলে সেই জাতির আত্মাকেই বিকৃত করা হয়।

 

আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে, পূর্বোক্ত রেনেসাঁস ও গণজাগরণ হিন্দু-মুসলমান বিরোধের দ্বারা বিভক্ত ছিল। তার রেশ নানাভাবে- বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পরিচালনার মধ্য দিয়ে আজও ক্রিয়াশীল আছে। এসব থেকে মুক্ত হতে হলে ইতিহাসকে বিকৃত না করে, মিথ্যার আশ্রয় না নিয়ে সততার সাথে কাজ করতে হবে। শুভ বুদ্ধি ও অশুভ বু্দ্ধির বিরোধের মধ্যে নিজের ভেতর ও সকলের ভেতর শুভ বুদ্ধি জাগাতে ও জয়ী করতে হবে। শুভ বুদ্ধি কেবল কোনো এক পক্ষের মধ্যে বিরাজ করছে, তা নয়; সকল পক্ষের মধ্যেই আছে। আর অশুভ বু্দ্ধিও কেবল কোনো এক পক্ষের মধ্যে নয়, সকল পক্ষের মধ্যেই রয়েছে। এই বাস্তবতার মধ্যে শুভ বুদ্ধিকে জাগ্রত ও জয়ী করতে হবে। তার জন্য যা কিছু করা দরকার সবই করতে হবে।

 

যারা দলীয় স্বার্থে জাতীকে বিভক্ত করে, ন্যায়-অন্যায় ও উচিত-অনুচিত বিবেচনা করে না, মিথ্যাকথা বলে এবং কেবল অন্যদের ওপর দোষ চাপায়, আত্মসমালোচনা করে না তারা অশুভ শক্তির পরিচয় দেয় এবং প্রতিপক্ষরূপে অশুভ শক্তিকে জাগিয়ে তোলে, গড়ে তোলে। প্রচার মাধ্যমের ঈশ্বরপ্রতীম শক্তির এই কালে প্রত্যেক জাতির এবং মানবজাতির প্রগতি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক অনেক কঠিন হয়েছে। কঠিন হওয়ার অর্থ কিন্তু অসম্ভব হওয়া নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি যদি সৃষ্টিশীলতা ও প্রগতির জন্য চিন্তা ও চেষ্টা চালিয়ে যায়, থেমে না যায়, আশা না ছাড়ে, তা হলে বিজয় অবশ্যম্ভাবী। প্রত্যেক জাতির ইতিহাসেই দুঃসময় কখনো কখনো দেখা দিয়েছে। জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে চেষ্টার মাধ্যমে দুঃসময় অতিক্রম করেছে এবং সুসময় প্রতিষ্ঠা করেছে।

 

আজ বিজয় দিবস। আমার পুত্র ফয়সল দীপন, তাকে আমি প্রাণাধিক প্রিয়রূপে অনুভব করতাম, আজ নেই। মনে হয়েছিল সবকিছু বুঝি থেমে গেল! আমি, আমরা থেমে গেলাম! কিন্তু কিছুই তো থামে নি। সব কিছু চলছে। আমি, আমরাও চলছি। কেবল থেমে থেমে আমার, আমাদের চোখ থেকে পানি পড়ছে।

 

এখন দীপন কেমন আছে? দীপন কি কষ্ট পাচ্ছে? দীপন কি শান্তিতে আছে? সবাইতো আমরা চলে যাবো! সবাই চলে যায়। মৃত্যু রোধ করার  কোনো উপায় কি মানুষ বের করতে পারবে না? শুভ বুদ্ধির জাগরণ ও বিজয় ঘটলে মানুষ পারবে। সব পারবে। অমানুষদের উপর মানুষদের জয় হবে।

 

 

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ডিসেম্বর ২০১৫/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়