ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

গণশিক্ষার নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন কৃষিবিদ ইবাদ আলীর

বিএম ফারুক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গণশিক্ষার নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন কৃষিবিদ ইবাদ আলীর

বি এম ফারুক, যশোর : যশোরে গণশিক্ষার নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন কৃষিবিদ ইবাদ আলী। তার এ পদ্ধতি বিভিন্ন সচেতন মহলে ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলেছে।

যশোর সদর উপজেলাধীন ১২ নং ফতেপুর ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রামে ইবাদ আলীর বাড়ি। তার বয়স এখন ৩০। তিনি স্বপ্ন দেখেন এদেশ একদিন নিরক্ষরমুক্ত হবে। সেই স্বপ্ন বুকে ধারণ করে দেশকে নিরক্ষর ও দারিদ্র্যমুক্ত করার প্রত্যয় নিয়ে নিরলস কাজ করে চলছেন ইবাদ আলী। চালু করেছেন জ্ঞানের মেলা স্কুল।

ইবাদ আলীর স্কুলের নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। নির্ধারিত জায়গাও নেই। ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো বয়সসীমাও নেই। সেই সঙ্গে শিক্ষকদের যোগ্যতারও কোনো মাপকাঠি নেই। আর এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হলো একটি বই।

ইবাদ আলী অক্ষর পরিচয়ের নতুন একটি মডেল উদ্ভাবন করেছেন, নাম গণশিক্ষা উন্নয়ন মডেল। নতুন রকমে একটি বইও লিখেছেন, নাম গণশিক্ষার প্রথম পাঠ। যৌতুক প্রথা, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরিতেও কাজ করেন তিনি। কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের বিরুদ্ধেও প্রচারণা চালাচ্ছেন।

ইবাদ আলী বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খাদ্য প্রকৌশল বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। ২০১১ সালে লেখাপড়া শেষ করে রাজবাড়ি এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ শুরু নেন।

ইবাদ আলী বলেন, ‘কাজ করার সময় দেখেছি যেসব নারী স্বাক্ষর করতে পারেন না, তারাই বেশি গরিব। বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তোলে। আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরে গবেষণা করি।’

জানতে পারি, লেখাপড়ার বিষয়ে কুসংস্কার আছে নারীদের। তাছাড়া তারা গৃহস্থালি কাজে এত ব্যস্ত থাকে যে কোথাও গিয়ে পড়ার মতো সময় তাদের হাতে থাকে না। আমি ভাবতে থাকি, উপায় খুঁজতে থাকি। গণশিক্ষা উন্নয়ন মডেলের সূচনা সেসব দিনেই।

২০১৪ সালে ২৬ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের বড়দাসপাড়া গ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে মডেলটি চালু করি। অল্প সময়ের মধ্যে বড়দাসপাড়াসহ কুমারগাতি, কালিয়ানিকান্দা, দক্ষিণ ভাটপাড়া দিপচর গ্রামের ৮০০ মানুষকে এই মডেলে যুক্ত করি এবং তারা নিরক্ষরতা থেকে রেহাই পায়।

তিনি বলেন, তার উদ্ভাবিত গণশিক্ষা উন্নয়ন মডেলে কাজ করার জন্য প্রথমে একটি গ্রাম বেছে নেওয়া হয়। এরপর একটি পরিবার থেকে একজন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। পরিবারের সদস্যসহ পাঁচজনকে ‘গণশিক্ষার প্রথম পাঠ’ বইটি পড়ান তিনি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যখনই সময় হয় তখনই ক্লাস হয়। পুরো গ্রামে দুজন পর্যবেক্ষক থাকেন। তারা সপ্তাহে সপ্তাহে ইবাদের কাছে রিপোর্ট করেন। প্রতিদিন দুটি অক্ষর পড়া ও লেখা শেখানো হয়। পরীক্ষা হয় প্রতি মাসে। পাঁচ মাস পর সনদ দেওয়া হয়। গ্রামে একটি সেন্টার থাকে। সেখানে শিক্ষকদের ১৫ দিন পর পর একটি সমাবেশ হয়। তাদের সঙ্গে বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথা ইত্যাদি বিষয়ের কুফল সম্পর্কেও আলোচনা করা হয় এবং শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের সে সব বিষয়ে জ্ঞান দান করেন।

তার ছাপা গণশিক্ষার প্রথম পাঠ বইটি যেকোনো নিরক্ষর লোকও পড়তে পারে। বইয়ের বাম পাশের ছবির প্রথম উচ্চারিত ধ্বনিই হচ্ছে ডান পাশের বর্ণ। যেমন- বইটির বাম পাশে যখন কলস ও কলমের ছবি তখন ডানপাশে থাকে ‘ক’ বর্ণটি। নিরক্ষর লোকের তাই শিখতে বেশি কষ্ট হয় না। কলম, কলসের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা সঙ্গে সঙ্গে ‘ক’ দিয়ে কাক, কদবেল, কালি ও কোকিলের মতো শব্দও বানাতে পারেন। এভাবে খরগোশ আর খবরের ছবি দেখে ‘খ’ পড়া, ঘড়ি ও ঘরের ছবি দেখে ‘ঘ’ পড়া হয়ে যায়। ২০ পৃষ্ঠার রঙিন এই বইটি ৯০০ কপি ছেপেছেন ইবাদ। বইটির দাম নির্ধারণ হয়েছে ২০ টাকা। বইয়ের সঙ্গে বিনামূল্যে একটি খাতাও দেওয়া হয়।

                               ইবাদ আলীর পাঠশালায় বিভিন্ন বয়সি শিক্ষার্থীরা

যশোর সদর উপজেলার একটি গ্রাম সীতারামপুর। সেখানকার ঋষিপাড়ার ১০০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে ১৫ জুলাই থেকে ইবাদের গণশিক্ষার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ৬০ জন নারী, ৪০ জন পুরুষ। শিক্ষার্থীদের বয়স ১৮ থেকে ৭০। তাদের কেউ দিনমজুর, কেউবা রিকশাচালক আবার গৃহবধূ থেকে শুরু করে শ্রমিকও আছেন।

ওই গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, ঘরের বারান্দায়, বাঁশবাগানের ছায়ায়, উঠানে, রাস্তার পাশে, স্কুলমাঠে সকাল, দুপুুর, বিকেল বা সন্ধ্যায় ক্লাস চলছে। আকাশ নামের গ্রামের এক কিশোর পড়েছে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত। এখন সে তার রিকশাচালক বাবা রাফায়েল, মা লক্ষ্মীরানী, মামা পলাশ ও দিদি ফুলমালাকে পড়াচ্ছে।

আকাশ জানায়, ‘বাবাকে লেখাপড়া শেখাতে গিয়ে খুব আনন্দ হচ্ছে।’

আকাশের বাবা রাফায়েল বললেন, ‘লেখাপড়া না শিখে ভুল করেছি। এখন ছেলের কাছে লেখাপড়া শিখছি। একটু লজ্জা লাগলেও ভালই লাগছে।’

এই গ্রামেরই বিশ্বাস বাড়ির বউ পুষ্প বিশ্বাস জানান, এখন তার কাছে শ্বশুর, শাশুড়ি আর স্বামী লেখাপড়া শিখছে। এখন বাড়িতে তার বেশ সম্মান।

সীতারামপুর গ্রামের নারী জনপ্রতিনিধি আনোয়ারা রহমান আনুর কাছে ইবাদ আলীর এ গণশিক্ষা উন্নয়ন মডেল সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের এই সীতারামপুর গ্রামটি খুবই অবহেলিত ছিল। এলাকার লোকজন নিরক্ষর। তারা তাদের নাম লিখতে পারত না। কিংবা দেখেও পড়তে পারত না। ইবাদের এই গণশিক্ষা উন্নয়ন মডেলের মাধ্যমে অনেক বয়স্ক লোকও নাম লিখতে পারছে। সঙ্গে সঙ্গে পড়তেও পারছে। তাছাড়া তার এ পদ্ধতিতে বাড়িতে পড়াশোনা করতে কোনো নির্দিষ্ট সময় বাঁধা নেই। যার যখন ইচ্ছা সে তার পড়া সেরে নিতে পারছে। আর শিক্ষক দেখা যাচ্ছে সেই বাড়ির ছেলে-মেয়ে কিংবা তাদেরই বৌমারা। যার ফলে অভিভাবকরা তাদের সর্বস্ব মেধা খাটিয়ে পড়া প্রস্তুত করতে চেষ্টা করছে। আমরা এতদিন দেখেছি বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের পড়িয়েছে। কিন্তু এখন সন্তানেরা তাদের বাবা-মাকে পড়াচ্ছে। এ পদ্ধতিতে গ্রামের অনেক লোক আজ নিরক্ষরমুক্ত হতে চলেছে। ইবাদ আলীর এই কর্মকা- আমার খুব ভালো লেগেছে। আমি প্রায়ই গ্রামের ওই সব বাড়িতে গিয়ে গিয়ে তাদের পড়াশোনার খোঁজ-খবর নিই। আমি আশা করি ইবাদ তার এই কর্মে নিশ্চয়ই একদিন সফল হবে।’

ইবাদের বাবা ছিলেন দিনমজুর। সংসারে খুব টানাটানি ছিল। নিজেও বাবার সঙ্গে দিনমজুরি করতেন। কিন্তু লেখাপড়ার আগ্রহ ছিল বলে ১২ বছর বয়সকালে ব্র্যাক স্কুলে গিয়ে ভর্তি হন। তারপর পড়াশোনার পাশাপাশি কাজও চালিয়ে গেছেন। এখন যশোরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। তার গণশিক্ষা উন্নয়ন মডেল এগিয়ে নিতে বন্ধুরা ৪৪ হাজার টাকা দিয়েছেন কয়েক দফায়।

ইবাদ বলেন, আমার মডেলে প্রতি ১০০ জন ছাত্রের নিরক্ষরতা দূর করার জন্য ৩০ হাজার টাকার প্রয়োজন। তাছাড়া এই মডেলের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে পুরো দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করা যাবে। সঙ্গে বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থান এবং অসহায় দরিদ্রদের অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।

তার নিজ গ্রাম ফতেপুরে কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করছেন কিনা- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, ফতেপুরে ৬০০-এর অধিক নিরক্ষর লোক আছে। তার গ্রামে এ কার্যক্রম পরিচালনা করতে প্রায় দুই লক্ষাধিক টাকার প্রয়োজন। এ বৃহৎ অংকের টাকা তার কাছে না থাকায় তিনি এ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। তবে তিনি হাল ছাড়ছেন না। তিনি তার স্বপ্ন পূরণের জন্য কাজ চালিয়ে যাবেন বলে আশা করেন। তিনি তার কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য বন্ধুদের পাশাপাশি সরকারি সহযোগিতা কামনা করেন।

তা ছাড়া বাংলাদেশকে নিরক্ষরমুক্ত করতে ইবাদ আলীর এই গণশিক্ষার নতুন পদ্ধতির কার্যক্রমকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগ নেবে সরকার এমনটাই প্রত্যাশা করছেন সবাই।



রাইজিংবিডি/যশোর/১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬/বিএম ফারুক/মুশফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়