ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বিদ্রূপাত্মক রচনায় জুড়ি ছিল না যার

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিদ্রূপাত্মক রচনায় জুড়ি ছিল না যার

আবুল মনসুর আহমদের পোর্ট্রেট

শাহ মতিন টিপু : বিদ্রূপাত্মক রচনায় তার জুড়ি ছিল না। তাকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্রূপাত্মক রচয়িতা। অবশ্য আবুল মনসুর আহমদকে অনেক বিশেষণেই ভূষিত করা হয়। উপমহাদেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজ্ঞ ও রাজনীতিবিদ হিসেবে খ্যাতি রয়েছে তার।

 

আবুল মনসুর আহমদ উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদদের মধ্যে এমন একজন যিনি রাজনীতি, সাংবাদিকতা এবং সাহিত্য রচনা- এই তিন জ্ঞানের অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। সর্বজন বরণীয় আবুল মনসুর আহমদের ১১৮তম জন্মবার্ষিকী আজ। জন্ম ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা গ্রামে, ১৮৯৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর।

 

কর্মময় রাজনৈতিক জীবন মনসুরকে রাজনৈতিক বিষয়ে ব্যঙ্গ-রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল প্রবলভাবে। দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজ, রাজনৈতিক নেতাদের চিন্তার অস্বচ্ছতা এবং তথাকথিত সমাজসেবকদের প্রকৃত রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সমাজের ধর্মলগ্নতা বিষয়ে তার নিজস্ব চিন্তা প্রকাশের চেষ্টা করেছেন। ধর্মীয় ফিলোসফি তার রাজনৈতিক চেতনাকেও প্রভাবিত করেছে। তার মুক্তবুদ্ধি, উদারচিন্তা ও সৎসাহস শিক্ষিত বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের আত্মতৃপ্তিকে কিছুটা হলেও নাড়িয়ে দিয়েছে।

 

রাজনীতি ছিল তার মন্ত্র  আর সাহিত্য ছিল অস্ত্র। ‘আয়না’ গ্রন্থটির জন্য কাজী নজরুল ইসলাম ‘আয়নার ফ্রেম’ শিরোনামে ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। ওই ভূমিকার শেষাংশে কাজী নজরুল লেখেন : আবুল মনসুরের ব্যঙ্গের একটা অসাধারণ বৈশিষ্ট্য এই যে, সে ব্যঙ্গ যখন হাসায় তখন হয় সে ব্যঙ্গ কিন্তু কামড়ায় যখন, তখন হয় সে সাপ; আর সে কামড় গিয়ে যার গায়ে বাজে তার মুখের ভাব হয় সাপের মুখের ব্যাঙের মত করুণ। কিন্তু সে হাসির পিছনে যে অশ্রু আছে, সে কামড়ের পিছনে যে দরদ আছে, তা যাঁরা ধরতে পারবেন, আবুল মনসুরের ব্যঙ্গের সত্যিকার রসোপলব্ধি করতে পারবেন তাঁরাই।’

 

‘ফুড কনফারেন্স’ (প্রথম প্রকাশ: ১৯৪৪)-এর রচনাগুলো ১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ সময়কালে রচিত। তৎকালীন শেরে বাংলার মন্ত্রিসভার আমলকে এই গ্রন্থের গল্পগুলোর স্যাটায়ার স্পর্শ করেছিল বলে মনে করা হয়। বিশেষ করে নামগল্পসহ ‘সায়েন্টিফিক বিযিনেস’ ও ‘জনসেবা ইউনিভার্সিটি’ বেশ সাড়া জাগানো কাহিনি। দুঃশাসন, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির প্রতিবাদে প্রবলকণ্ঠ এইসব রচনা।

 

‘ফুড কনফারেন্স’ গল্পের কিছু অংশ:

 

‘দেশে হাহাকার পড়েছে; কারণ নাকি খোরাকির অভাব। সে হাহাকার অবশ্যি ভদ্রলোকেরা শুনতে পাননি; ভাগ্যিস অভুক্ত হতভাগ্যদের গলায় চিৎকার করে কাঁদবার শক্তি নেই।... অভুক্ত কঙ্কারসার আধ-ল্যাংটা হাজার হাজার নর-নারী প্রাসাদশোভিত রাজধানীর রাস্তাঘাটে কাতার করছে। তাতে রাস্তায় সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। এইসব রাস্তায় আগে-আগে গাউন শাড়ি পরা পরীর ভিড় হতো। আর আজ কিনা সেখানে অসুন্দর অসভ্য কুৎসিত অর্ধোলঙ্গ স্ত্রীলোকেরা ভিড় করছে! কি অন্যায়!... গ্র্যান্ডহোটেলে ফুড কমিটির বৈঠক। শেরে-বাংলা মহিষে-বাংলা সিংগীয়ে-বাংলা টাটুয়ে-বাংলা গাধায়ে-বাংলা কুত্তায়ে-বাংলা পাঁঠায়ে-বাংলা বিল্লিয়ে-বাংলা শিয়ালে-বাংলা প্রভৃতি নেতৃস্থানীয় সমস্ত বাঙালিই ফুড কমিটির সদস্য মনোনীত হয়েছেন। মন্ত্রীরা এক্স অফিসিও মেম্বার। তাঁরা অবশ্য কমিটির মেম্বর হিসেবে আর মাইনে পাবেন না; তবে মিটিং-এ হাজির হওয়ার জন্য ফিস্ পাবেন। সদস্যের মধ্যে শেরে-বাংলার ভাগ্নের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু তাতে কারুর আপত্তি করার উপায় নেই; শেরে-বাংলার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে সেই শর্তেই। আর খোদ শেরে-বাংলা বলেন, শেরে বাংলার ভাগ্নে হলে ব্রিলিয়েন্ট হতেই হবে, যথা, শিয়ালে-বাংলা।’

 

আবুল মনসুর আহমদের চিন্তা ও চোখ প্রসারিত ছিল নানান দিকে ও বিচিত্র বাঁকে। গল্প-উপন্যাস ছাড়াও কবিতা এবং নাটক-নির্মাণের দিকে তার বিশেষ ঝোঁক পাঠকের নজর কাড়ে। তিনি কবিতার কাঠামোয় পরিবেশন করেছেন আসমানী পর্দা (প্রথম প্রকাশ: ১৯৫৭)। পুঁথিসাহিত্যের ঢঙে লেখা এই রচনা ছিল সমকালীন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ভণ্ডামির মুখোশে প্রবল আঘাত।

 

বাঙালি হিন্দু সমাজে ছোটদের জন্য সহজ-সরল ভাষায় রামায়ণ-মহাভারত রচিত হলেও মুসলমান সমাজের শিশু-কিশোরদের জন্য তেমন কোনো ধর্মীয় গ্রন্থ ছিল না, যা পড়ে ছোটদের ধর্মীয় অনুভূতি জাগ্রত হতে পারে। তখন তিনি লিখলেন কাসাসুল আম্বিয়া বা পয়গম্বরদের কাহিনি- মুসলমানী কথা (প্রথম প্রকাশ: ১৯২৪), নয়াপড়া (প্রথম প্রকাশ: ১৯৩৪) এবং ছোটদের কাসাসুল আম্বিয়া (প্রথম প্রকাশ: ১৯৫০)।

 

নাটকের আদলে লেখা গালিভারের সফর-নামা (প্রথম প্রকাশ: ১৯৫৯) বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ সংযোজন। এই গ্রন্থের ‘রাজনৈতিক বাল্যশিক্ষা’ ও ‘রাজনৈতিক ব্যাকরণ’ বাঙালির চিন্তাজগতে নতুন-যোজনা হিসেবে পরিচিত হয়ে থাকবে। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছিল জর্জ বার্নাড শ-কে। গ্রন্থটির অন্য তিনটি বৈশিষ্ট্য হলো- গণতান্ত্রিক-স্বৈরতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থার পার্থক্য-নির্দেশ, পাকিস্তানে ইসলামি শিক্ষা-ব্যবস্থা প্রবর্তন-প্রয়াসের বিরূপ সমালোচনা এবং সমস্ত কাহিনীর নাটকীয়তা ও সংলাপে বৃহত্তর ময়মনসিংহ-এলাকার আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ-চাতুর্য।

 

স্কুলের সিলেবাসে থাকার কারণে বাংলাদেশে আবুল মনসুর আহমদের ‘রিলিফ ওয়ার্ক’ গল্পটি বেশ পরিচিত। তার ‘আদুভাই’ তো বাংলাসাহিত্যে খুব জনপ্রিয় এবং সুপরিচিত গল্প। বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা আদুভাইয়ের নাম শোনেনি, এমন নজির বিরল।

 

আবুল মনসুর আহমদের স্যাটায়ার, ক্রিয়েটিভ রচনা ও নিবন্ধে সমকালীন অবিভক্ত বাংলা ও পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সামাজিক প্রতিবেশের বিশেষত, মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশের ক্রমধারার ছবি লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। আর আত্মজৈবনিক বচনে রয়েছে অবিভক্ত ভারত, পূর্ব-পাকিস্তান ও বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংঘাতের পরিচয়। সমাজ-রূপান্তরের ক্রমধারায় তিনি অনন্য এক কারিগর।

 

‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইটি প্রথম প্রকাশ হয় ১৯৬৮ সালে। বইটির নাম আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর হলেও বইটি ষাট বছর কিংবা তারও অধিক সময়ের রাজনৈতিক প্রতিবিম্ব। লেখক আবুল মনসুর আহমদ ব্যক্তি জীবনে রাজনীতির যেসব শাখা প্রশাখায় বিচরণ করেছেন, যেসব ঘটনার সাথে নিজেকে জড়িয়েছেন কিংবা ঘটনাক্রমে জড়িয়ে পড়েছেন সেসব ঘটনার বিষদ বিবরণ নিয়েই মূলত রচিত হয়েছে আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর বইটি।

 

আবুল মনসুর আহমদ ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতিতে, সাংবাদিকতায়, রাজনীতিতে, আইন ব্যবসায় তিনি দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তথা একসময়ের অনগ্রসর বাঙালি মুসলমান সমাজকে অধিকার সচেতন করে তুলতে এবং অধিকার আদায়ে ব্রতী হয়ে পালন করেছেন এক সাহসী পথিকৃৎ মনীষীর ভূমিকা।

 

তিনি ‘কৃষক’ ও ‘নবযুগ’ পত্রিকায় কাজ করেছেন এবং ১৯৪৬-এ অবিভক্ত বাংলার কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘ইত্তেহাদ’ এর সম্পাদক ছিলেন। পাকিস্তানের প্রথম দিকে বিরোধীদলীয় আন্দোলনে তার অবদান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি আওয়ামী লীগের প্রথম দিকের একজন নেতা।

 

চল্লিশের দশকের প্রথম থেকেই তিনি ভাষা বিষয়ে লিখে আসছিলেন এবং ইত্তেহাদের সম্পাদক হিসেবে ভাষা আন্দোলনে তার অবদান রাখেন। তিনি ১৯৫৪র নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মেনিফেস্টো একুশ দফার রচয়িতা, যে নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হয়। একুশ দফা ছিল তদানীন্তন পাকিস্তানের পূর্বাংশের বাঙালিদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দাবির প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপস্থাপন। রাজনৈতিক কারণে আবুল মনসুর আহমদকে পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে ও ষাটের দশকের প্রথম দিকে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে বেশ কয়েকবার কারাবরণ করতে হয়।

 

সফল রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন এবং ১৯৫৭ সালে প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগ সরকারে ছিলেন কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী। পূর্ববাংলার স্বার্থে শক্ত অবস্থান ও নানাবিধ উদ্যোগের জন্য বিশেষ করে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে তার সুনাম রয়েছে।

 

তিনি সাহিত্য স্বীকৃতি হিসাবে বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬০), স্বাধীনতা দিবস পদক (১৯৭৯) ও নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক লাভ করেন।


 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়