বিদ্রোহী নজরুলের প্রেমিকসত্তা || মারুফ রায়হান
মারুফ রায়হান || রাইজিংবিডি.কম
কবির পাশে উপরে বাঁ থেকে নার্গিস এবং প্রমিলা, নিচে ফজিলাতুন্নেসা
বিদ্রোহী কবিতার কারণে কবি কাজী নজরুল ইসলাম আখ্যায়িত হয়েছেন ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে- এ বিবেচনা কি পুরোপুরি ঠিক? তবে ওই বিবেচনার আংশিক বস্তুনিষ্ঠতা নিশ্চয়ই রয়েছে। নজরুলের কবিতার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে দ্রোহী চেতনা, প্রতিবাদী স্বর। প্রেমিক না হলে কি আর বিদ্রোহী হওয়া যায়? যায় না। যে কবি যত বড় মানবপ্রেমিক, সে কবি তত বড় বিদ্রোহী। মানবতার অবমাননা ‘দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া’ যাওয়া তাঁর পক্ষেই সম্ভব। দেশপ্রেম এবং মানবপ্রেম- সাচ্চা কবিমনের দুই বৈশিষ্ট্য তুলনামূলকভাবে নজরুলের মধ্যে ছিল যথেষ্ট।
অবশ্য এক কথায় ‘প্রেমিক’ বলতে আমরা যা বুঝি, তা নজরুলের চাইতে বাংলার আর কোন কবির ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য? তাঁর আগে ও পরে যত কবি এসেছেন, তাঁর মতো প্রাণবন্ত মহাপ্রেমিক দ্বিতীয়টি আর কে আছেন! অবশ্য নজরুলের প্রেমিক-কবি পরিচয়টি ম্লান হয়ে পড়ে প্রেমের সংগীত প্রতিভার বহুমাত্রিকতার কারণে। কিংবা কথাটি আমরা এ ভাবেও বলতে পারি, বাঙালির কাছে অতি সহজে ও ব্যাপকভাবে তাঁর প্রেমের গান পৌঁছে যায়। তাঁর প্রেমের সংগীত-সুধা পানের জন্য বিদগ্ধ শ্রোতা হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। হওয়া লাগে না প্রেমবিশারদ। এমনকি বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাজ্ঞান না থাকলেও তাঁর আরবি-ফার্সি শব্দ-সংবলিত গানের গরিমা অনুধাবনে একটুকুও সময় লাগে না।
‘আলগা কর গো খোঁপার বাঁধন দিল ওহি মেরা ফাস গেয়ি’ চরণের গূঢ় ব্যঞ্জনা সহজেই পৌঁছে যায় শ্রেণিপেশা নির্বিশেষে মানুষের অন্তরে। সে তুলনায় নজরুলের প্রেমের কবিতা পঠিত হয়েছে অনেক কম। গান ও কবিতা- দুটি মিলিয়েই তাঁর প্রেমিকসত্তা। একদিকে রক্ত-মাংসের প্রেমিক সত্তার প্রবল উপস্থিতি, অন্যদিকে শারীরিক সান্নিধ্য থেকে মেরুদূর অবস্থানকারী এক অন্যতর প্রেমিকের জাগরণ কাব্যপ্রেমিকদের পুলকিত করে। এমনকি নজরুলের প্রবল পরাক্রম বিদ্রোহের কবিতা ‘বিদ্রোহী’র অভ্যন্তরেও তাঁর প্রেমিক সত্তাটি বেজে বেজে উঠেছে মহামানবিক ছন্দে। প্রণয় বিষয়টি কী মনোহর রূপেই না বিদ্রোহীর অস্তিত্বে প্রস্ফুটিত হয়েছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রেমে এফোঁড়-ওফোঁড় হওয়া মানুষমাত্রেই আন্দোলিত হবেন নিচের চরণগুলোর গভীরতা অনুভব করলে। কবি লিখেছেন-
‘আমি অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিত- চুম্বন-চোর কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর!
আমি গোপন হিয়ার চকিত চাহনি, ছল করে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তার কাঁকন চুড়ির কন্-কন্।
বিদ্রোহী পরিচয় নিয়ে তার নিজের মনেই হয়তো কিছুটা অস্বস্তি ছিল। তা না হলে কেন তিনি বলবেন: ‘আমাকে বিদ্রোহী বলে খামখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এ নিরীহ জাতটাকে আঁচড়ে-কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই।’ ১৯৪১ সালের ৬ এপ্রিল মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র রজত জয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠানে সভাপতি রূপে নজরুল অভিভাষণ দান করেন। দুরারোগ্য ব্যাধিতে চিরজীবনের জন্য বাক্রুদ্ধ হয়ে যাবার পূর্বে এই ছিল তাঁর সর্বশেষ বক্তৃতা। যাঁরা সম্যকরূপে নজরুলকে চিনতে চান, তাঁদের জন্য এই বক্তৃতার চেয়ে উত্তম কিছুই হতে পারে না। নজরুলের প্রেমিক সত্তার কী অপূর্ব বয়ানই না পাই এই বক্তব্যে: ‘যদি আর বাঁশী না বাজে, আমি কবি বলে বলছি নে, আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম, সেই অধিকারে বলছি, আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন। আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসিনি। আমি নেতা হতে আসিনি। আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী হতে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’
নারীর প্রতি কবির দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে একটি কবিতাই যথেষ্ট। নারী-পুরুষে কোনো ভেদাভেদ করেননি কবি। সমানাধিকার ও সমঅবদানের বিষয়টি তাঁর মতো এত স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে আর কে বলেছেন! ‘নারী’ কবিতায় বলছেন :
সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়েছে নারী, অর্ধেক তার নর।
নজরুল গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ চমৎকার বলেছেন এ কবিতাটি সম্পর্কে। বলছেন ‘মাইকেলের বীরাঙ্গনা, রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা নাট্যরসে নিষিক্ত, শেষ বিচারে কিন্তু কবিতা হিসেবে এই দুটির উত্তরাধিকারী নজরুলের ‘নারী’ কবিতাটি। বাংলার নবজাগরণের একটি চরিত্রলক্ষণ নারীর অধিকার রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বেগম রোকেয়া, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী এবং আরো অনেকের ইতিহাস চেতনা বহন করে আরো এগিয়ে গিয়েছিলেন নজরুল। আরো কেলাসিত। যেন শুধু তার বক্তব্যের সারাৎসার একটি অভঙ্গুর শিশিতে ভরে বাঙালি পাঠককে উপহার দিলেন তিনি।’
নজরুলের প্রেমের কবিতাগুলো পাঠ করলে আমরা দেখব কীভাবে প্রেম তার কাছে প্রতীক হয়ে উঠেছে। নিজের কবিসত্তার জন্য সবটুকু কৃতিত্ব তিনি নারীকেই দিয়েছেন। ‘কবি-রানী’ কবিতাটি আরম্ভই হচ্ছে এভাবে-
তুমি আমায় ভালোবাসো তাই তো আমি কবি
আমার এ রূপ- সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি।
এরপর কবি তার রানীকে আরো কৃতিত্ব দিয়ে বলছেন-
তুমিই আমার মাঝে আসি
অসিতে মোর বাজাও বাঁশি।
নজরুলের প্রেমের কবিতায় যেসব নারীর সাক্ষাত পাই আমরা, তারা কবিকে ঐশ্বর্য দান করেছেন। কবি বিলক্ষণ জানেন- প্রেমের ভাণ্ড আছে প্রেমিকার কাছেই । সেখান থেকে আকণ্ঠ প্রেম পান করেও কবি অতৃপ্ত। প্রেম তার কাছে একইসঙ্গে জাগতিক এবং অপার্থিব। ‘অ-নামিকা’ কবিতায় তার প্রবাদতুল্য উচ্চারণ:
প্রেম এক, প্রেমিকা সে বহু
বহু পাত্রে ঢেলে পিব সেই প্রেম
সে শরাব লোহু।
তোমারে করিব পান, অ-নামিকা, শত কামনায়
ভৃঙ্গারে, গেলাসে কভু, কভু পেয়ালায়!
নজরুলের কবিসত্তার সমান্তরাল অবস্থানেও প্রেমিকসত্তা থাকে বহমান। প্রেমরসে আপন সত্তাকে সিক্ত করার জন্য প্রেমাষ্পদের কল্পনাটিও তার কাছে সমগুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক সান্নিধ্যই যে কবির কাব্যপ্রেরণার জন্য জরুরি এমন নয়। এর প্রমাণ তিনি বারবার রেখে গেছেন। তাই বহু পাত্রে ঢেলে প্রেম পান করার বিষয়টিকে ভুল ব্যাখ্যার কোনো অবকাশই নেই। সিন্ধু-হিল্লোল কাব্যের ‘গোপন-প্রিয়া’ কবিতাটি কবির প্রেমদর্শন বুঝতে আমাদের আরেকটু সাহায্য করে। প্রথম চরণটিই চমকে দেয় পাঠককে- ‘পাইনি বলে আজো তোমায় বাসছি ভালো, রানী।’
প্রশ্ন জাগে পাওয়ার পরে কি ভালোবাসাবাসির যবনিকা! আসলে তা নয়, এটি কবির ভালোবাসা প্রকাশেরও এক অভিনব ধরন। ভালোবাসার আনন্দে বিভোর থাকাতেই যেন তাঁর সুখ। চোখের সম্মুখে তাকে টেনে আনার কী দরকার যে ঘুমঘোরের মতো চোখেই বাস করে! ‘নাই বা পেলাম, চেয়ে গেলাম, গেয়ে গেলাম গান।’ এই উপসংহারই আমাদের বলে দেয় কাব্য ও সংগীত তথা শিল্পসৃষ্টির এক অনিঃশেষ প্রেরণা হলো প্রেম। এখানেই নজরুলের প্রেমকাব্যের স্বকীয়তা।
চক্রবাক কাব্যে ‘এ মোর অহঙ্কার’ কবিতাটি তাঁর এই স্বকীয়তা বুঝতে আমাদের আরেকটু সাহায্য করবে। কবির কাঙ্ক্ষিতার গন্তব্য বা অবস্থান যেটাই হোক (যার আশাতেই সে নারী গাঁথুক ফুল-হার), কবির প্রেমিকসত্তার কাছে সেটি বড় বিবেচ্য নয়। দয়িতার গলার হার আপন কণ্ঠে শোভা পাক কি না পাক সেটা যেন গৌণ। মুখ্য হলো কবি নিজেই তার জন্য মালা গাঁথবেন, এবং সেটাই কবির অহঙ্কার! এমন প্রেমিক নজরুলকে এখনও আমাদের চিনে ওঠা বাকি।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ আগস্ট ২০১৫/তাপস রায়
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন