ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বিদ্রোহী বেতারের দুঃসাহসিক ইতিহাস।। কামাল লোহানী

কামাল লোহানী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২০, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিদ্রোহী বেতারের দুঃসাহসিক ইতিহাস।। কামাল লোহানী

পাহাড়ে-পর্বতে, বনে-বনান্তরে; পাতালে-মর্ত্যে প্রতিধ্বনি হলো, ইথারে ইথারে বজ্রের সংঘর্ষ হলো আর বিদ্যুৎ বয়ে গেল অযুত মানুষের বন্দিপ্রাণে। কেঁপে উঠল স্বৈরশাসনের অচলায়তন। কবি মোস্তফা আনোয়ারের কণ্ঠে বিদ্রোহী উচ্চারণের জননী জন্মভূমির কাছ থেকে চেয়ে নিল বৈশাখের রুদ্র জামা, প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ঘোষণা করল ‘ওরা মানুষ হত্যা করছে। আসুন, আমরা পশু হত্যা করি।’

আমি বলেছিলাম, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে, সশস্ত্র লড়াইয়ে যে বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের ‘সেকেন্ড ফ্রন্ট’ হিসেবে তার অব্যর্থ ভূমিকা পালন করে অধিকৃত এলাকায় শত্রুর হাতে বন্দি অগণিত বাঙালি নারী-পুরুষ-আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার প্রাণকে সচকিত, উজ্জীবিত ও উচ্চকিত করেছে দুশমনের বিরুদ্ধে লড়ার বিপুল সাহসে, সেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথা।

বাংলার দুরন্ত মানুষের দুর্বার মুক্তির লড়াই চলছে জলে-স্থলে, এমনকি অন্তরীক্ষেও, সেই অমিতবিক্রম মুক্তিবাহিনীর জোয়ানদের নিত্যদিনের বিজয়াভিযানের প্রদীপ্ত সংবাদ এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ছোট স্টুডিওর ঘরে বসে বিক্ষিপ্ত অবিন্যস্ত যন্ত্রপাতিতে রেকর্ড করে স্বল্প ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে পৌঁছে দিত বাংলার ঘরে ঘরে মা-বোনদের আঁচলঘেরা প্রাণে, দুর্জয় সাহসে পিতা-পুত্রকে করে তুলত উদ্বেল। তাই তো শত্রুকবলিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অধিকারে নির্মম নৃশংস হত্যার শিকারে পরিণত হওয়ার সমূহ বিপদের সব ঝুঁকি মাথায় নিয়েও প্রতিটি বাঙালি সেদিনের লড়াইয়ের দিনগুলোতে ঘরের কোণে লেপের ভেতরে কিংবা কাঁথার আড়ালে সাউন্ডটাকে একেবারে কমিয়ে কানের কাছে ট্রানজিস্টারটা নিয়ে বসে থাকত ঠাসাঠাসি করে।

সত্যি কথা বলতে কি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যদি না থাকত, তবে কি মুক্তিযুদ্ধের পরিপূর্ণতা সম্ভব হতো, সার্বিকভাবে? বিভিন্ন রণাঙ্গনের প্রতিদিনকার খবরকে পৌঁছাত বাংলার ঘরে ঘরে? দুরন্তপ্রাণ সৈনিকের অব্যর্থ লক্ষ্য ভেদ করত যখন শত্রুর দুর্বল সিনাটাকে, দুশমনকে হটিয়ে মুক্তিফৌজ যখন দৃপ্তপদভারে স্বদেশকে মুক্ত করত হায়েনার কবল থেকে তার খবর যদি স্বাধীন বাংলা বেতার প্রচার না করত, তবে অধিকৃত এলাকার যন্ত্রণাকাতর মানুষকে কে দিত শত্রুকে চরম আঘাত হানার ডাক? কে শোনাত শেষ যুদ্ধের বাদ্য? কয়েকটি দুরন্ত জীবনপথিক সংগ্রামের যাত্রাপথে একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে যদি এমন দুঃসাহসিক পদক্ষেপ না নিত, তবে কী হতো জানি না। সেদিন থেকে শুরু করে লড়াইয়ের শেষ দিনটি পর্যন্ত যারা শব্দের হাতিয়ার হাতে সৈনিকের ভূমিকা পালন করেছে, এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আজ তারা যে যেখানেই থাকুক না কেন, গোটা জাতির সালাম রইল তাদের জন্য।
 
‘আপনারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতে পাবেন প্রতিদিন সকাল ৯টার পর, বেলা ১টার পর এবং সন্ধ্যা ৭টার পর যেকোন সময়ে’ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এই ঘোষণা দিয়ে আমাদের সর্বক্ষণ উন্মুখ করে রাখত। অবশ্য পরে নিজে যখন এই বেতারে যোগ দিয়েছিলাম তখন বুঝতে পেরেছিলাম, প্রাথমিক পর্যায়ে শত্রুকে এড়িয়ে দেশের ভেতরে অধিকৃত সীমারেখা ছাড়া স্বাধীন বাংলা বেতার প্রচার করা সম্ভবই ছিল না। চট্টগ্রামের কালুরঘাট ট্রান্সমিশন ভবনটিতে ছিল ছোট একটি স্টুডিও। কেউ কেউ পরামর্শ দিলেন ওখান থেকে অনুষ্ঠান প্রচারের। নাম ঠিক করা হলো : ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র।’ সম্ভবত দু’দিন অধিবেশনের পর মেজর জিয়ার কথা বলে লেফটেন্যান্ট শমশের মবিন চৌধুরী ‘বিপ্লবী’ শব্দটি বাদ দিতে বললেন। তাই হলো।

একটি স্মরণীয় ঘটনা- সেটা হলো : ২৬ মার্চ দুপুর বেলা বেতার প্রকৌশলীদের জোর করে ধরে এনে চট্টগ্রামের আ’লীগ নেতা এমএ হান্নান তার নিজের বক্তৃতা মাত্র ৫ মিনিটের জন্য প্রচার করেছিলেন। এর কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না বা পরে এমন প্রয়াস অব্যাহত রাখারও কোনো চিন্তা ছিল না কারো। ফলে ওইদিন ওখানেই শেষ। নানা পর্যায়ে আলোচনা শেষে ঠিক সাতটা পঁয়তাল্লিশে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ অন এয়ার গেল। প্রথম কণ্ঠস্বর ইথারে ভেসে উঠল প্রগতিশীল রাজনীতির একজন কর্মী এককালের ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আবুল কাসেম সন্দ্বীপের। চট্টগ্রাম বেতারের স্ক্রিপ্ট রাইটার এবং ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধকালে বেতারে প্রচারমূলক ‘পুঁথি পাঠক’ বেলাল মোহাম্মদ মৌল পরিকল্পনা ও সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করলেন, সহায়তা করলেন ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ক্রান্তি’ শিল্পীগোষ্ঠীর অন্যতম গায়ক ও তখন চট্টগ্রাম বেতারে অনুষ্ঠান প্রযোজক হিসেবে নিয়োজিত আব্দুল্লাহ আল ফারুক। প্রকৌশলী কর্মী এমএ শাকুর দায়িত্ব নিলেন টেকনিক্যাল বিভাগের। এই অধিবেশনে আ’লীগ নেতা হান্নান সাহেবও (স্বাধীনতার পর রহস্যাবৃত সড়ক দুর্ঘনায় নিহত) তার নাম না দিয়েই নিজের বক্তৃতা প্রচার করেছিলেন। অধিবেশন আধঘণ্টা স্থায়ী হয়েছিল আর এতে প্রচারিত হয়েছিল খবর এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠান হওয়ার পর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ও দেশের প্রথম দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান- এর সম্পাদক ও কবি সাংবাদিক আব্দুস সালামের একটি লিখিত ভাষণ।

এ রাতেই ১০টার পর আকস্মিকভাবে আরেকটি অধিবেশন বসেছিল স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের। মাত্র ১০ মিনিট স্থায়ী হয়েছিল। এই অধিবেশনে মাহমুদ হোসেন নামে দীর্ঘকায় এক তরুণ ব্যবসায়ী ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় বিদেশের কাছে সাহায্যের আবেদন প্রচার করেছিলেন তার নিজেরই গলায়। সঙ্গে ছিলেন ফারুক চৌধুরী, রঙ্গলাল দেব চৌধুরী। এই মাহমুদ হোসেনকে অবশ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের পথে তার দু’জন সহযোগীসহ গুলি করে হত্যা করা হয়। কিন্তু কারা তাকে হত্যা করেছে এবং তার হত্যাকারীদের সনাক্ত করা সম্ভব না হলেও অনেকের ধারণা, তিনি সংকীর্ণ রাজনীতির শিকার হয়েছিলেন।

স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার পরিচালনার কাজে ইতিমধ্যেই এসে যুক্ত হলেন প্রখ্যাত নাট্যকার অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ, শিল্পী ইয়ার মোহাম্মদ, কাজী হাবিব উদ্দিন, সেকেন্দার হায়াত খান, হারুনুর রশিদ খান প্রমুখ। এইদিন সন্ধ্যায় ট্রান্সমিশনে মেজর জিয়া নিজের হাতে লেখা ঐতিহাসিক ঘোষণাটি পাঠ করেন। প্রথমে তিনি স্ক্রিপ্টটি ইংরেজিতে লিখলেন, তার অনুবাদ করলেন বেলাল মোহাম্মদ ও অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন। জিয়ার অত্যন্ত বিশ্বস্ত সহচর ক্যাপ্টেন ওয়ালীও তার সঙ্গেই ছিলেন। মেজর জিয়ার যে ভাষণ সেদিন শুনেছিলাম, গোটা জাতিকে শিহরিত করেছিল, তাতে তার বক্তব্য ছিল : ‘আমি মেজর জিয়া আমাদের সর্বোচ্চ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। দেশের সর্বত্র দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছে। এখন আমাদের অস্ত্রের বিশেষ প্রয়োজন...।’

দেশ-বিদেশের কাছে তিনি সাহায্যেরও আবেদন জানিয়েছেন। ২৮ মার্চ দুপুরের ট্রান্সমিশন থেকে এর নাম হলো ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।’ টেকনিক্যাল সাইটের রাশেদুল হাসান, আমিনুর রহমান, শরফুজ্জামান এরা সবাই এসে কালুরঘাটে হাজির হলেন। ২৯ মার্চ বেতার কেন্দ্রে এসে যোগ দিলেন সৈয়দ আবদুস শাকের, মোস্তফা আনোয়ার এবং রেজাউল করিম। এরা সবাই চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের চাকুরে। ৩০ মার্চ দুপুর বেলা অনুষ্ঠান প্রচারের কাজ চলছিল। এমন সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বোমারু বিমানের আওয়াজ সবাইকে সচকিত করে তুলল। ২টা ১০ মিনিটে প্রচণ্ড আওয়াজে বোমাবর্ষণ শুরু হলো তাদের লক্ষ্যবস্তু নির্দিষ্ট করে। ১০ মিনিটের নারকীয় হামলায় কালুরঘাটের ১০ কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন ট্রান্সমিটারের চ্যানেলগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তখন অনন্যোপায় হয়েই কালুরঘাটে রাখা এক কিলোওয়াটের একটি ট্রান্সমিটার ওখান থেকে উঠিয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হলো। পরিকল্পনা অনুযায়ী ওটাকে ডিসম্যানটল করে পটিয়া নিয়ে গেলেন তারাই। কিন্তু এক কিলোওয়াটের অনুষ্ঠান ক্ষেপণ-সীমা খুবই সীমিত এবং একে শত্রুরা খুব সহজেই খুঁজে বের করতে পারবে বলে রামগড় এলাকার দিকে ওটাকে নিয়ে সবাই রওয়ানা হলেন ৩ এপ্রিল। সেদিন রাত ১০টায় তারা প্রচার করলেন এক ঘণ্টা স্থায়ী অনুষ্ঠান এই শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটারে। মাঝে চারদিন বন্ধ ছিল এই বেতার। কিন্তু অধিকৃত এলাকার মধ্যে এ বেতার অনুষ্ঠান শুনতে না পেয়ে মানুষ কতখানি বিপন্ন হয়ে পড়েছিলেন মানসিক দিক থেকে তা আজো আমার স্পষ্ট মনে পড়ে।

৩ এপ্রিল থেকে ২৫ মে পর্যন্ত একটানা স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছে একটি জঙ্গলাকীর্ণ মুক্ত এলাকা থেকে। এখানে আসার প্রয়াসে আ’লীগ নেতা এমআর সিদ্দিকী, পার্বত্য চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার এইচটি ইমাম এবং মেজর জিয়ার লোকজন আন্তরিকভাবে সাহায্য করেছেন। ... জঙ্গলে বসে বাঁশের মাচানের উপর কাগজের টুকরো জোগাড় করে সংবাদ লিপিবদ্ধ করা, বন্য পশুদের সঙ্গে মিতালী পাতিয়ে বসবাস করা ছিল শব্দ সৈনিকদের লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা। কিন্তু বিদ্রোহী বেতারের এই তো যথার্থ পরিবেশ। একজন মুক্তিযোদ্ধা শব্দ সৈনিকের কালজয়ী প্রচেষ্টার এই তো বলিষ্ঠ দুঃসাহসিক ইতিহাস।


লেখক : সাংবাদিক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগঠক

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ ডিসেম্বর ২০১৫/শাহনেওয়াজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়