ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

রেডিওর প্রকৃত আবিষ্কারক মার্কোনি নয়

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ২৩ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রেডিওর প্রকৃত আবিষ্কারক মার্কোনি নয়

শাহ মতিন টিপু : আমরা যে এফএম বা রেডিওতে গানের মূর্ছনায় হারিয়ে যাই তার আবিষ্কারক হিসেবে কিছুদিন আগেও পুরো বিশ্ববাসী ইটালির বিজ্ঞানী মার্কোনিকেই জানত। কিন্তু ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত ওঊঊঊ IEEE (Institute of Electrical and Electronics Engineers)এর প্রসিডিংয়ে আমাদের জগদীশ বসুকে রেডিওর প্রকৃত আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

কারণ,মার্কোনি তার আবিষ্কারে অনেক সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছিলেন যার মধ্যে একটি হচ্ছে কোহেরার (২টি ধাতব পাতের মাঝে খানিকটা পারদ), যা ছিল রেডিও বা তারহীন সংকেত পাঠানোর প্রক্রিয়ার মূল বিষয়। মজার ব্যপার হচ্ছে, এই কোহেরার এর প্রকৃত আবিষ্কারক স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, যা মার্কোনি বা তার সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা কেউ স্বীকার করেনি। মার্কোনি বসুর তৈরি কোহেরারটি সামান্য পরিবর্তন করেছিলেন। বসুর কোহেরারটি ছিল ট আকৃতির মত আর মার্কোনিরটি ছিল সোজা।

আমাদের গর্ব যে, তিনি আমাদের বাংলাদেশেরই লোক। ২৩ নভেম্বর এই মহান বাঙালি বিজ্ঞানীর ৭৯তম মহাপ্রয়াণ দিবস। ১৯৩৭ সালের এইদিনে ভারতের স্বাস্থকর স্থান  গিরিডিতে মৃত্যু হয় বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর। তার জন্ম ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের ময়মনসিংহ শহরে।

মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রাম ছিল তার পরিবারের প্রকৃত বাসস্থান । তার বাবা ভগবান চন্দ্র বসু তখন ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। এর আগে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন ভগবান বসু। পরবর্তিতে তিনি বর্ধমান ও অন্যান্য কিছু অঞ্চলের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেছেন। জগদীশ চন্দ্রের প্রথম স্কুল ছিল ময়মনসিংহ জিলা স্কুল। এখানেই শৈশব কাটে তার। তার মায়ের নাম বামা সুন্দরী দেবী।

জগদীশ কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএ পাশ করার পর বাবার ইচ্ছা ও আগ্রহে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞান পাঠের উদ্দেশ্যেই লন্ডনে যান। বিদেশে অধ্যয়ন শেষে দেশে ফিরে এসে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের অস্থায়ী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। তার গবেষণার সূত্রপাতও এখান থেকেই। তার মহান বৈজ্ঞানিক গবেষণাসমূহের সূতিকাগার হিসেবে এই কলেজকে আখ্যায়িত করা যায়। আমরা যে জগদীশ চন্দ্রের সাথে পরিচিত, তার জন্ম এখান থেকেই।

উদ্ভিদেরও যে প্রাণ আছে, এর সন্ধান তিনিই দিয়েছিলেন। তার আবিস্কারের আগে উদ্ভিদের প্রাণ সম্পর্কে জানতো না মানুষ। হ্যাঁ তিনি আমাদের স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু। বাঙালি বিজ্ঞানী। সর্বপ্রথম মানুষ সাদৃশ উদ্ভিদের প্রাণ থাকার ঘোষণায় বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন এই বাঙালি বিজ্ঞানী।

আজ গাছের জীবন সম্পর্কে কারো মনে বিন্দুমাত্র সংশয়ও নেই। গাছের প্রাণ আছে, এ নিয়ে আজ কাউকে বোঝাবার দরকার হয় না। অথচ এ সত্যটি প্রমাণে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুকে অনেক সাধনা করতে হয়েছিল। তিনি তারই আবিষ্কৃত ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রের সাহায্যে প্রমাণ করেন উদ্ভিদের প্রাণের অস্তিত্ব।

প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার প্রথম আঠারো মাসে জগদীশ যে সকল গবেষণা কাজ সম্পন্ন করেছিলেন তা লন্ডনের রয়েল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়। এই গবেষণা পত্রগুলোর সূত্র ধরেই লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৯৬ সালের মে মাসে তাকে ডিএসসি ডিগ্রী প্রদান করে।

এক প্রতিকুল অবস্থার মধ্য দিয়েই গবেষণা চালিয়ে যান তিনি। প্রতিদিন নিয়মিত ৪ ঘণ্টা শিক্ষকতার পর যেটুকু সময় পেতেন তখন তিনি এই গবেষণার কাজ করতেন। তার উপর প্রেসিডেন্সি কলেজে কোন উন্নতমানের গবেষণাগার ছিলনা, অর্থ সংকটও ছিল প্রকট। সীমিত ব্যয়ে স্থানীয় মিস্ত্রীদেরকে শিখিয়ে পড়িয়ে তিনি পরীক্ষণের জন্য উপকরণ প্রস্তুত করতেন। তিনি মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে বিদ্যুতের মতো অত্যন্ত দুরূহ বিভাগের ছয়টি উল্লেখযোগ্য গবেষণা শেষ করেছেন।

তার এই গবেষণা কর্মগুলোর গুরুত্ব বিবেচনা করেই ইংল্যান্ডের লিভারপুলে বক্তৃতা দেয়ার জন্য ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এই বক্তৃতার সাফল্যের পর তিনি বহু স্থান থেকে বক্তৃতার নিমন্ত্রণ পান। এর মধ্যে ছিল রয়েল ইন্সটিটিউশন, ফ্রান্স এবং জার্মানি।

স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর গবেষণার প্রধান দিক ছিল উদ্ভিদ ও তড়িৎ চৌম্বক। তার আবিষ্কারের মধ্যে উদ্ভিদের বৃদ্ধিমাপক যন্ত্র ক্রেস্কোগ্রাফ ও উদ্ভিদের দেহের উত্তেজনার বেগ নিরুপক সমতল তরুলিপি যন্ত্র রিজোনাষ্ট রেকর্ডার অন্যতম। গাছের প্রাণ সম্পর্কে অনেক প্রাচীনকাল থেকেই বিজ্ঞানীরা সম্পূর্ণ ধারণা দিতে পারেননি। জগদীশ চন্দ্র প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন, উদ্ভিদ এ প্রাণী জীবনের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে; এক কথায় উদ্ভিদজীবন প্রাণীজীবনের ছায়া মাত্র।

জগদীশ চন্দ্র কাজ করেছিলেন অতিক্ষুদ্র তথা মাওক্রো বেতার তরঙ্গ নিয়ে। যার প্রয়োগ ঘটেছে আধুনিক টেলিভিশন এবং রাডার যোগাযোগের ক্ষেত্রে। আর মার্কনি আধুনিক ছোট বা শর্ট তরঙ্গ মাপের বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে দূরে বেতার সংকেত পাঠাতে সফল হয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতি হল রেডিও। জগদীশ চন্দ্র বসুর আশ্চর্য আবিষ্কার দেখে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেন, ‘জগদীশ চন্দ্র বসুর প্রত্যেকটি আবিষ্কার বিজ্ঞান জগতে একটি বিজয়স্তম্ভ।’

ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে তার বক্তৃতার বিষয় ছিল "অন ইলেকট্রিক ওয়েভ্স"। মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে করা পরীক্ষণগুলোর উপর ভিত্তি করেই তিনি বক্তৃতা করেন যা ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের চমৎকৃত ও আশ্চর্যান্বিত করে। অশীতিপর বৃদ্ধ বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন বক্তৃতা শোনার পর লাঠিতে ভর দিয়ে এসে জগদীশের স্ত্রী অবলা বসুকে তার স্বামীর সফলতার জন্য অভিবাদন জানান। জগদীশ এবং অবলা দু’জনকেই তিনি তার বাসায় নিমন্ত্রণ করেছিলেন। এই বিষয়ের উপর বিখ্যাত সাময়িকী ‘টাইম্স’-এ একটি রিপোর্ট ছাপা হয় যাতে বলা হয়, ‘এ বছর ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের সম্মিলনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বিদ্যুৎ-তরঙ্গ সম্পর্কে অধ্যাপক বসুর বক্তৃতা।’

লিভারপুলে বক্তৃতার পর তার আরও সাফল্য আসে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল রয়্যাল ইন্সটিটিউশনে সান্ধ্য বক্তৃতা দেয়ার নিমন্ত্রণ। এই বক্তৃতাটি আনুষ্ঠানিকভাবে "ফ্রাইডে ইভনিং ডিসকোর্স" নামে সুপরিচিত ছিল। এই ডিসকোর্সগুলোতে আমন্ত্রিত হতেন একেবারে প্রথম সারির কোন আবিষ্কারক। সে হিসেবে এটি জগদীশচন্দ্রের জন্য একটি দুর্লভ সম্মাননা ছিল।

১৮৯৮ সালের জানুয়ারি ১৯ তারিখে প্রদত্ত তার এই বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘অন দ্য পোলারাইজেশন অফ ইলেকট্রিক রেইস’ তথা বিদ্যুৎরশ্মির সমাবর্তন। এই বক্তৃতার সফলতা ছিল সবচেয়ে বেশি। বায়ুতে উপস্থিত বেশ কিছু বিরল গ্যাসের আবিষ্কারক হিসেবে খ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড র‌্যালে তার বক্তৃতা শুনে এবং পরীক্ষাগুলো দেখে এতোটাই বিস্মিত হয়েছিলেন যে, তার কাছে সবকিছু অলৌকিক মনে হয়েছিল। তিনি এ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এমন নির্ভুল পরীক্ষা এর আগে কখনও দেখিনি- এ যেন মায়াজাল’।

 

এই বক্তৃতার পর ফ্রান্স এবং জার্মানি থেকে আমন্ত্রণ আসে এবং তিনি সেখানে কয়েকটি বক্তৃতা দেন। সবখানেই বিশেষ প্রশংসিত হন। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক কর্ন তার বন্ধু হয়ে যায় এবং তিনি ফ্রান্সের বিখ্যাত বিজ্ঞান সমিতি Societe de Physeque-এর সদস্য মনোনীত হন।

বাঙালিরাও বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে নিউটন-আইনস্টাইনের চেয়ে কম যায়না তিনি তা প্রমাণ করেন। জগদীশ চন্দ্র যে গ্যালিলিও-নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী তার স্বীকৃতি দিয়েছিল লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকা, ১৯২৭ সালে।

জগদীশ চন্দ্র বসু একজন সাহিত্যিকও ছিলেন। তার লেখা ‘অব্যক্ত’ বাংলা ভাষায় একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এ ছাড়াও আমরা যে সায়েন্স ফিকশানগুলো পড়ে বিজ্ঞানকে নিয়ে প্রতিনিয়ত নতুনভাবে চিন্তা করি, তার জনক হলেন জগদীশ চন্দ্র বসু। ১৮৯৬ সালে তার লেখা প্রথম সায়েন্স ফিকশানটির নাম ছিল ‘নিরুদ্দেশের কাহিনী’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন জগদীশ চন্দ্র।

১৯১৬ সালে তিনি অধ্যাপনার কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তারপর দু’বছরের মধ্যে (১৯১৭ সালের ৩০ নভেম্বর) তিনি ‘জগদীশচন্দ্র বসু বিজ্ঞানমন্দির’ প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি সেই বিজ্ঞানমন্দিরে গবেষণা পরিচালনা করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ভারতের জাতীয় বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি। এ ছাড়াও তিনি ঘুম, বাতাস, খাদ্য ও ওষুধ প্রভৃতির প্রভাব প্রদর্শনের জন্য যন্ত্রপাতিও উদ্ভাবন করেছিলেন।

 

 


রাইজিংবিডি/ ঢাকা/২৩ নভেম্বর ২০১৬/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়