ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বিশ্বসাহিত্যে বিখ্যাত উক্তি (দুই)

অলাত এহসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০৮, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিশ্বসাহিত্যে বিখ্যাত উক্তি (দুই)

উপরে বাম থেকে রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ, শরৎচন্দ্র, নিচে হুমায়ূন আহমেদ ও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

অলাত এহসান

‘হীরক রাজার দেশে’ বিশ্বখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের শিশুতোষ চলচ্চিত্র। অবাক করা ব্যাপার হলো, দর্শকপ্রিয় এই চলচ্চিত্রটির প্রদর্শনী বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়। এমন কী ছিল এই শিশুতোষ চলচ্চিত্রে? এখন এ কথা সবাই জনেন যে, এই চলচ্চিত্রে আজকের দিনের তথাকথিত অশ্লীলতা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার মতো কোনো বিষয়, রাষ্ট্রদ্রোহের মতো অপরাধ- এসব কিছুই ছিল না। ছিল একটি শ্লোগান: ‘দড়ি ধরে মারো টান/রাজা হবে খান খান’।

এ সময়ের পাঠক হয়তো ভাবতে পারেন, এ আর এমন কী? এ তো নেহায়েত শিশুতোষ ছন্দ কথা। কিন্তু এটাই ছিল কারণ। সময়ের দিকে একটু ফিরে তাকালেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। আমাদের দেশে তখন স্বৈরশাসন চলছে। এরশাদ ক্ষমতায়। মানুষ প্রায় অতিষ্ঠ। এ দেশের দর্শক শিশুতোষ এই চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত উক্তিটিকে স্বৈরশাসকবিরোধী শ্লোগানে পরিণত করে। এ কারণেই নিষিদ্ধ করা হয় ‘হীরক রাজার দেশে’।

শুধু এ দেশে নয়, চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত আরেকটি উক্তির জন্য সত্যজিৎ রায় খোদ শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বিরাগ ভাজন হয়েছিলেন। উক্তিটি হলো: ‘নিয়ে যাও তারে/যন্তর-মন্তর ঘরে’। যন্তর-মন্তর হলো ভারতের প্রেসিডেন্ট প্যালেসের সামনের দীর্ঘ রাস্তা, যেখানে সব রকম রাজনৈতিক ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় ভারতেও ইন্দিরা গান্ধীর শাসন ব্যবস্থায় জনগণ অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল। তাই ‘যন্তর-মন্তর ঘর’ বলতে সাধারণ মানুষ প্রেসিডেন্ট প্যালেসের কথাই বুঝত।

মূল ব্যাপারটা ঘটেছিল চলচ্চিত্রের হীরক রাজার চরিত্রের মধ্যে। তিনি ছিলেন সে দেশের স্বৈরশাসক, যিনি তার দেশে শিশুদের কোলাহলটুকুও সহ্য করতে রাজি ছিলেন না। তাই রাজা যখন বলেন, ‘নিয়ে যাও তারে/যন্তর-মন্তর ঘরে’ কিংবা তাকে উদ্দেশ্য করে যখন বলা হয়, ‘দড়ি ধরে মারো টান/রাজা হবে খান খান’ তখন এই দুই উক্তির মধ্য দিয়েই স্বৈরাচারের স্বরূপ উন্মোচন হয়। আর এ জন্যই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের এত গা জ্বালা।

লেখার শুরুতে এই গৌরচন্দ্রিকার কারণ হলো, লেখার ভেতরের ছোট্ট বাক্য বা পাত্রপাত্রীর মুখ দিয়ে বলানো উক্তি কী পরিমাণ শক্তি বহন করে সে কথাটি বোঝানো। কিছুদিন আগেও শাহবাগের প্রজন্মচত্বরে ‘তুই রাজাকার, তুই রাজাকার’ শ্লোগানে তরুণেরা মুখরিত ছিল। মানুষের ভেতরে এর রেশ এখনো রয়ে গেছে। আমাদের অনেকেরই হয়তো জানা, এই জনপ্রিয় উক্তিটি সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ প্রথম তার ‘বহুব্রীহি’ নাটকে ব্যবহার করেছিলেন। পরে এই শিরোনামে উপন্যাসও প্রকাশিত হয়। আশির দশকের শেষের দিকে প্রচারিত ধারাবাহিকে একটা টিয়া পাখির ঠোঁট দিয়ে তিনি এ কথা বলিয়েছিলেন। সেদিন টিয়া পাখির বলা এই উক্তি আজ এ দেশের অনেক মানুষের ঘৃণার উচ্চারণে পরিণত হয়েছে।

বাংলা সাহিত্যে এমন অনেক উক্তি পাওয়া যায়, যা শুধু লেখনিতে নয়, মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সেগুলো ভীষণভাবে ব্যবহার হয়। অর্থাৎ বইয়ের পাতা থেকে সেগুলো উঠে আসে মানুষের কণ্ঠে। আমরা অনেকেই চলতি কথায় হয়তো সেগুলো বলি, কিন্তু জানি না কথাটির উৎস কোথায়। আবার প্রবন্ধসাহিত্যের কোনো কোনো উক্তি দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজকে নাড়া দেয়। কমিউনিস্ট মতাদর্শের দার্শনিক কার্ল মার্ক্স, ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের অনেক কথাই পৃথীবির রাজনৈতিক ভূগোল বদলে দিয়েছে। একইভাবে মার্ক্সবাদী মতাদর্শের সাহিত্যিকদের উক্তির কথাও বলা যায়।

গৌরচন্দ্রিকা অনেক হলো, অতএব থাক সে কথা। মোদ্দা কথা হলো, নিপাট সাহিত্যের চিন্তা ও দর্শন প্রবাহে উক্তি দারুণ শক্তিশালী মাধ্যম। বিশ্বসাহিত্যে তো বটেই, বাংলা সাহিত্যেও তার শক্তিমত্তা কম দেখা যায় না। গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ-উপন্যাস-স্মৃতিকথা সবখানে এর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। অনুসন্ধান করলে এ-ও দেখা যাবে, পুরো গল্পে গোটাকয় বাক্যের মাধ্যমেই লেখক লেখার ও দেখার প্রখরতা প্রকাশ করেছেন। এখানে বলে নেয়া ভালো, যে দেশে রবীন্দ্র-নজরুল-মানিক (তিন বন্দোপাধ্যায়)এবং জীবনানন্দের মতো কবি-সাহিত্যিক বিদ্যমান সেখানে কূলকিনারা করা মোটেই সহজ কাজ নয়। আবার সাহিত্যের সবগুলো শাখা থেকেও যদি জনপ্রিয় উক্তিগুলো উদ্ধৃত করতে চাই, তাহলে আরব্য রজনীর মতো হাজার রাতও ফুরিয়ে যাবে, গল্পের শেষ হবে না। ফলে এ যাত্রা শুধু গদ্যসাহিত্য থেকেই উদ্ধৃতি সীমাবদ্ধ রাখি। পাঠক, চলুন উক্তি নিয়েই বরং গদ্য করা যাক।

আমার কথার রাশ টেনে দিতে চাইলাম এ জন্য যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ভারতবর্ষ ও স্বদেশ’ গ্রন্থে বলেছেন: ‘অত্যুক্তি অলস বুদ্ধির বাহ্য প্রকাশ’। সুতরাং সেই অপবাদের দিকে যাচ্ছি না। তাই বলে বলার অধিকারও ছাড়ছি না। কারণ রবীন্দ্রনাথই ‘হৈমন্তী’ গল্পে বলে দিয়েছেন: ‘অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার ধরিবার মতো বিড়ম্বনা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নাই।’ সুতরাং বুঝতেই পারছেন! ওদিকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসে বলেছেন: ‘একটা সত্যকার অপরাধ অনেক মিথ্যা অপরাধের বোঝা বয়ে আনে।’ এই উপন্যাসের নাম করতে গিয়েই মনে পড়লো, শরৎ বাবু সবচেয়ে বেশি গৃহের কথাই লিখেছেন। যে কারণে তিনি বাংলার গৃহিণীদের মন ছুঁতে পেরেছিলেন।

‘দেবদাস’ উপন্যাসের কথাই ধরা যাক। ত্রিশের দশকের উঠতি যুবক-যুবতী তো ছাড়, নিশ্চিন্ত গৃহী, বহু সন্তানের জনকও দেবদাস পড়তে পড়তে বুক হাতড়ে বলেছেন, হায়! এমন কেন আমার হলো না। এই পাঠকপ্রিয়তার কারণেই তো, অভিধানে ‘দেবদাস’ শব্দটিই ঢুকে গেল বিশেষ দ্যোতনা নিয়ে। ভালোবাসা প্রত্যাখ্যাত, গৃহ বিবাগী, উসখুস চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আত্মভোলা কিসিমের কাউকে দেখলেই সবাই বলে ওঠে, ‘কিরে দেবদাস হলি নাকি?’

আপাত দৃশ্যে মনে হবে, এই দেবদাসদের কথা মনে করেই বুঝি রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে বলেছেন: ‘মনটাকে নিজের কাছে রাখিস নে, ভিতরে যে ঠাকুরটি আছেন তাঁরই পায়ের কাছে রেখে আয়, সেখানে অপমান পৌঁছাবে না।’ তা কি আর কেউ করে। এই ন্যাড়া যে বারবার বেল তলায় যাবেই। তাহলে তাকে আর বাঁচাবে কে? সংসারের কথা যেহেতু উঠেছেই, তাই শরৎ বাবুর আরেকটি কথা মনে পড়লো, ‘সংসারে আশ্চর্য আছে বলেই ত মানুষের বাঁচা অসম্ভব হয়ে ওঠে না’। সংসার নিয়ে এমন আশ্চর্য কথা তিনি বলে ফেললেন ‘পথের দাবি’ উপন্যাসে। সংসার বলতে গেলেই আসে বাড়ির কথা। আর বাড়ির কথা মনে হলে মনে পড়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘যাও পাখি’ উপন্যাসের একটি উক্তির কথা। ‘বাড়ি তো কেবল ইট-কাঠ নয়। মনের শান্তি, দেহের বিশ্রাম- এসব নিয়ে বাড়ি।’

বলছিলাম অপরাধের কথা। তাই বলে সব অপরাধই কিন্তু অপরাধ নয়। যেমন ‘যে অপরাধের শাস্তি দেবার কেউ নেই, সেটা পাপ হতে পারে কিন্তু অপরাধ নয়।’ এই কথাটাও বলেছেন রবি ঠাকুর তাঁর ‘রক্তকরবী’ নাটকে। ধুর ছাই, বারবারই কেবল রবি ঠাকুর এসে পড়ে। প্রিয় পাঠক, এই আশংকা কিন্তু প্রথমেই করেছিলাম। সুতরাং তার আরেকটি উক্তি দিয়েই না হয় এ যাত্রা মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। ‘সে’ গল্পে তিনি বলেছেন: ‘গল্প ফুরায় না, গল্প বলিয়ের দিন ফুরায়।’

আমার লেখাটিও আজকের মতো এখানেই না হয় ফুরালো।



লেখক : গল্পকার



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ সেপ্টেম্বর ২০১৫/তাপস রায়  

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়