ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বীরসিংহের সিংহপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

শাহাদৎ রুমন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৬, ২৮ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বীরসিংহের সিংহপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

শাহাদৎ রুমন : ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের পর ঊনবিংশ শতাব্দীতে বঙ্গীয় অঞ্চলে যে পরিবর্তন তথা নবযুগের সূচনা হয়েছিল তার অন্যতম উদ্যোক্তা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর, ১২২৭ বঙ্গাব্দের ১২ আশ্বিন বর্তমান মেদেনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ছাত্রজীবনে তিনি সব পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৮৩৯ সালের ২২ এপ্রিল তিনি  হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন। এ পরীক্ষাতেও যথারীতি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এ কারণে ল কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি পান, তাতেই প্রথম তার নামের সঙ্গে `বিদ্যাসাগর` উপাধি ব্যবহৃত হয়।

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা ভগবতী দেবী। ঈশ্বরচন্দ্র ছেলেবেলায় পিতামহ রামজয় তর্কভূষণের উৎসাহে প্রচলিত বাংলা শিক্ষায় শিক্ষাগ্রহণ করেন। পরে তারই উৎসাহে কলকাতায় উচ্চশিক্ষার জন্য চলে আসেন। কলকাতায় তিনি সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণ বিষয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে তিনি বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে মাসিক বৃত্তির জন্য মনোনীত হন এবং ‘বহিস্থ শিক্ষার্থী’ হিসেবে বইসহ আর্থিক সম্মানী লাভ করেন। সংস্কৃত কলেজে তিনি একাধারে প্রায় তেরো বছর অধ্যায়নকালে ব্যাকরণ, অলংকার, বেদান্ত, ন্যায়শাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিন্দু আইন, সংস্কৃত এবং ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষালাভ করেন।

 

বীরসিংহের সিংহপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাঙালি জাতির ইতিহাসে বাংলা গদ্যরীতি, সামাজিক কুসংস্কার প্রভৃতি বিষয়ের সংস্কারক হিসেবে সুপরিচিত। সে সময় ভারত তথা বঙ্গীয় অঞ্চলে সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীদের উপর আঁকড়ে বসা সামাজিক কুসংস্কারসমূহ দূরীকরণে দৃঢ়চেতা মনোভাবই তাকে ‘সিংহপুরুষ’ হিসেবে চিহ্নিত করে। তিনি তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় হিন্দু নারীদের জন্য বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তন, বহু বিবাহ প্রথা রদকরণে দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন। সমকালীন বাঙালি পণ্ডিতবর্গের সমালোচনা সত্ত্বেও স্বীয় অভিমত এবং চেতনা থেকে পিছপা হননি। এক কথায় নারী মুক্তির আন্দোলনে তথা নারীর প্রতি সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে ঊনবিংশ শতাব্দীতে সোচ্চার ছিলেন বিদ্যাসাগর। তার সঙ্গে সে সময়ে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত আরও কয়েকজন বাঙালি মনীষীর একান্ত প্রয়াসে সমাজ ব্যবস্থায় হিন্দু নারীর প্রতি বেশ কিছু সামাজিক কুসংস্কার লুপ্ত হয়েছিল।

 

তিনি কুসংস্কার রোধে শুধু জনসচেতনতা তৈরি করেননি, উদাহরণও তৈরি করেছেন। বিধবা নারীর সঙ্গে তিনি ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন। একইসঙ্গে তিনি বাল্যবিবাহের বিপক্ষেও প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন। নারী মুক্তির লক্ষ্যে তিনি নারীদের শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় স্থাপন করেছিলেন বালিকা বিদ্যালয়। কেননা তিনি উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছিলেন, প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত নারী মুক্তি সম্ভব নয়। এ ধরনের কাজ সে সময় সহজ ছিল না। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বিভিন্ন সময় তাকে এ কারণে তীব্রভাবে ব্যঙ্গ ও সমালোচনা করলেও তিনি স্বীয় পথ থেকে সরে আসেননি। বরং সব সময়ই তিনি নারীর পক্ষে মানবিকবোধ নিয়ে দাঁড়িয়েছেন।

 

নারীর প্রতি সামাজিক অবিচার তথা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তার চিন্তা-ভাবনার স্বরূপ উপলব্ধি করা যায়, ‘বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিৎ কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৫) ও ‘বহু বিবাহ রহিত হওয়া উচিৎ কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৭১) নামক দুই খণ্ডে প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ থেকে। বলা যায়, বিধবা বিবাহ বৈধকরণে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের আইন প্রচলন এবং দ্বি-বিবাহ কিংবা বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ রহিতকরণসহ খ্রিস্টাব্দের ‘সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট’-প্রনয়ণে বিদ্যাসাগরের অবদান অনস্বীকার্য। এ কারণে তাকে বাংলা ও বাঙালির নবজাগরণের সিংহপুরুষ রূপে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সনাতন বিশ্বাসের সমাজ ব্যবস্থায় প্রচলিত বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধেও অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। সংস্কৃত কলেজে তিনি শূদ্র শ্রেণির ছাত্রদের শিক্ষার ব্যবস্থা যেমন করেছিলেন, তেমনি পাশ্চাত্যের সঙ্গে মিল রেখে রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন নির্ধারণ করেছিলেন। একইসঙ্গে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে পাশ্চাত্যধর্মী ও ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক  করেছিলেন তিনি। কারণ, সে সময়ের বাঙালি জাতির অগ্রগতির জন্য পাশ্চাত্যের শিক্ষা পদ্ধতি, ও ইংরেজি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা অপরিহার্য ছিল বলে তিনি অনুভব করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

 

বাংলা সাহিত্যেও বিদ্যাসাগর অসামান্য অবদান রেখেছেন। তিনিই প্রথম বাংলা লিপির সংস্কার করে অর্থবহ ও যুক্তিসঙ্গত করে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন। একইসঙ্গে তিনি কৃত্রিম ছন্দরীতি, রাজা রামমোহন ও তার অনুসারীদের ব্যাকরণগত কাঠামো পরিহার করে নবরীতির প্রবর্তন করেছিলেন; যা আধুনিক বাংলা গদ্যরীতির ভিত্তি হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। তার প্রবর্তিত নবরীতির যথার্থতা সাপেক্ষে যৌক্তিকভাবে তাকে বলা হয় ‘আধুনিক বাংলা গদ্যের জনক’। এ ছাড়াও তিনি সংস্কৃত ও ইংরেজি শিক্ষায় অগাধ পাণ্ডিত্য অজর্নের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময়ে ধ্রুপদী সংস্কৃত ও ইংরেজি সাহিত্যের বাঙলায়ন করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন।

 

তার রচিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব, ব্রজবিলাস, প্রভাবতী সম্ভাষণ, শব্দমঞ্জরী, নিষ্কৃতি লাভের প্রয়াস (মৌলিক গ্রন্থ); বেতাল পঞ্চবিংশতি, শকুন্তলা, সীতার বনবাস, শিশুপালবধ, রামায়ণ, বাঙ্গালার ইতিহাস, জীবনচরিত, নীতিবোধ, বোধোদয়, ভ্রান্তিবিলাস (অনুবাদগ্রন্থ); পোয়েটিক্যাল সিলেকশনস্, সিলেকশনস্ ফ্রম গোল্ডস্মিথ (ইংরেজি গ্রন্থ), অন্নদামঙ্গল, কুমারসম্ভব, রঘুবংশ, অভিজ্ঞান শকুন্তলম, হর্ষচরিত (সম্পাদিত গ্রন্থ); বর্ণপরিচয়, ঋজুপাঠ, ব্যাকরণ কৌমুদী, সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা (ব্যাকরণ বিষয়ক) প্রভৃতি গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন। উক্ত গ্রন্থসমূহে বাংলা ব্যাকরণ, বাংলা গদ্য ও বাঙালির সমাজ-সংস্কার বিষয়ক বিভিন্ন বিষয়াদির পরিচয় লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। সেই সাথে বাংলা সাহিত্যেও উল্লিখিত গ্রন্থসমূহ অনন্যরূপে স্বীকৃত।

 

প্রচলিত আছে যে, জীবদ্দশায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রাপ্ত বেতন ও বিভিন্ন কর্মের জন্য প্রাপ্ত সম্মানীর অর্ধাংশ দুঃখ-দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের সহযোগিতায় প্রদান করতেন। এক কথায় মানবপ্রেমিক বিদ্যাসাগর সর্বদা মানুষের কল্যাণে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। মানবপ্রেমিক এই মহান বাঙালি পুরুষ ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই পরলোক গমন করেন। তার মৃত্যুতে তৎকালীন বাঙালি সমাজ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শোকাতুর হয়ে পড়েছিল। বাঙালি জাতি সেদিন হারিয়েছিল নবজাগরণের এক অবিসংবাদিত পুরুষকে। বীরসিংহের সিংহপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ১২৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই পরম শ্রদ্ধা। একই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের আরেক প্রবাদ পুরুষ মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভাষায় বলি- ‘The man to whom I have appeal has the generosity and the wisdom of an ancient sage, the energy of one englishman and the heart of a bengali mother.’





রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জুলাই ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়