বুড়িগঙ্গার নির্মল বাতাস কি আদৌ পাওয়া যাবে?
আবু তাহের || রাইজিংবিডি.কম
আবু তাহের : রাজধানী ঢাকা এখন মেগাসিটি। ১৯৭৪ সালে আদমশুমারি অনুযায়ী ঢাকার জনসংখ্যা ১৬ লাখ ৭ হাজার। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ঢাকার জনসংখ্যা ৬৮ লাখ ৪৪ হাজার এবং ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ১ কোটি ৭ লাখ। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম তার ‘উন্নয়নে নগরায়ণ’ বইতে লিখেছেন ১৯৭৪ সালে যখন স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়, তখন ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৬ লাখের মতো। ’৮১-তে এসে ঢাকার জনসংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫ লাখে, ’৯১-তে ৭০ লাখে। তখন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ঢাকা মহানগরকে ‘মেগাসিটি’ নামে আখ্যায়িত করে। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনেও ঢাকাকে ’৮৬ সালেই মেগাসিটি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
এবার মেগাসিটি কী জেনে নেওয়া যাক। মেগাসিটি অর্থ কড শহর। মেগাসিটি বলতে সেসকল মেট্রোপলিটন এলাকাকে বোঝানো হয়, যেখানকার জনসংখ্যা ১ কোটি বা ১০ মিলিয়নের অধিক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জনসংখ্যার ঘনত্ব (প্রতি বর্গ কিলোমিটারে নূন্যতম ২০০০ জন) বিবেচনা করা হয়ে থাকে। জাতিসংঘের হিসাব বাদ দিয়ে যদি আমরা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব ধরি তবে ৯১-তে আমরা মেগাসিটি হয়েছি।
মেগাসিটির দিক দিয়ে ঢাকা চীনের সাংহাই বা বেইজিং-এর কাছাকাছি। এর চেয়েও কাছে কলকাতা কিংবা পাকিস্তানের করাচী। চীনের উদাহরণ এ কারণে টানা হলো, ঢাকার সাথে চীনের পার্থক্যগুলো হয়ত খুব সহজেই ধরা পড়বে। সেদিকে দিয়ে বিবেচনা করলে কলকাতা বা করাচীর সাথে পার্থক্য করা মুশকিল। মুম্বাইও ঢাকার কাছাকাছি। এই শহরগুলোর সাথে ঢাকার সুযোগ-সুবিধা থেকে সবকিছু বিবেচনা করলে বিস্তর ফারাক চোখে পড়বে। বেইজিংয়ের বর্তমান জনসংখ্যা ২ কোটি ১৭ লাখ। জাতিসংঘের ওয়াল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্ট-এর রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা এক কোটি ৭০ লাখ। জনসংখ্যার দিক দিয়ে এগিয়ে থেকেও বেইজিং ঢাকা থেকে অনেক উন্নত।
রাজধানীর ঢাকার পরিধি দিন দিন বিস্তৃত হয়েছে। বেড়েছে কাজের পরিধি। তৈরি হয়েছে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র। ব্যবসা, বাণিজ্যে প্রসার হয়েছে অনেক দূর পর্যন্ত। কোথাও এক ইঞ্চি জায়গা ছাড় পাওয়া এখন মুশকিল। ফুটপাত থেকে শুরু করে রাজধানীর অলিগলি বেয়ে নদীপথ কোথাও যেন ফাঁকা নেই। রাজধানী কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা। ঐতিহ্যবাহী এক নদী। মূলত ঢাকার গোড়াপত্তনেই এই নদী। ঢাকার একসময় নাম ছিল জাহাঙ্গীরনগর। বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টিয় ৭ম শতক থেকে ঢাকায় লোক বসবাস শুরু করে। নবম শতকে সেন শাসন শুরু হওয়ার আগে ঢাকা বৌদ্ধ রাজ্য কামরূপ-এর অধীনে ছিল। সেন পরবর্তী যুগে ঢাকা তুর্কি ও আফগান শাসনাধীন হয়। এসময় ঢাকা দিল্লী সালতানাত নির্ধারিত শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়। ১৬০৮ সালে ঢাকায় প্রথম মুঘলদের পা পড়ে। ১৬১০ সালে ঢাকার নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীর নগর। আজও বুড়িগঙ্গার কোল ঘেঁষে এগিয়ে গেলে দেখতে পাওয়া যায় পুরোনো দিনের হাজারো ঐতিহ্য।
বুড়িগঙ্গাকে ঢাকার প্রাণ বললে ভুল হবে না। সেই শত বছর পূর্ব থেকেই ব্যবসা বাণিজ্য, যাতায়াত থেকে শুরু করে নির্মল বাতাস সবকিছুর যোগান দিত এই নদী। কালের আবর্তে সেই চাহিদা হাজার গুণ বৃদ্ধি পেলেও আজ সেই নদীর রুগ্নদশা। আমাদের নষ্ট মানসিকতা, মেগাসিটি ঢাকার বর্জ্য, অশুভ শক্তির কালো হাতের ছোঁয়া বুড়িগঙ্গাকে কতটুকু সুস্থ্য রেখেছে?
সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত বুড়িগঙ্গার ঐতিহ্য ফেরাতে নদীর দুই পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ঢাকা জেলা প্রশাসন, বিআইডব্লিউটিএ এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের যৌথ উদ্যোগে আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেলে অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। এ অভিযানের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গার আদি বৈচিত্র ফিরে আসবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। কিন্তু বাস্তবে কতটুকু ফলপ্রসু হবে এই কার্যক্রম।
বুড়িগঙ্গা আদি চ্যানেলের নদীর গর্ভে বিস্তৃত এলাকা অবৈধ দখল করে দোকানপাট ও অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে আছে দখলদাররা। এছাড়া এসব দোকান ও স্থাপনা থেকে বর্জ্য ফেলে ভরাট করে নদী দূষণ করা হচ্ছে। হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পের বর্জ্যের কারণেও নদীটি দূষিত হচ্ছে ব্যাপক হারে। বুড়িগঙ্গার এই দৈন্যদশা অনেক দিন ধরে। অনেকবারই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ২০০৯ সালের ২৫ আগস্ট ওয়াটার সেক্টর ও ড্রেজিংবিষয়ক কমিটির প্রথম সভায় ঢাকা মহানগরীর চারপাশের নদীপথ ড্রেজিং করার নির্দেশ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পের ডিপিপি প্রণয়ন করা হয়। প্রকল্পটি ২০১০ সালের ৬ এপ্রিল একনেক বৈঠকে অনুমোদিত হয়। ওই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল, নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ নদী খননের মাধ্যমে যমুনা নদী থেকে পানি এনে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকা মহানগরীর চারপাশের নদীগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে হবে। সেইসঙ্গে পানির গুণগতমান ও নাব্যতা বৃদ্ধি করা, বুড়িগঙ্গা নদীসহ নদীগুলোতে বছরব্যাপী নৌযান চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় গভীরতা নিশ্চিত করা, সেচ ও মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে অবদান রাখা এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়ন সাধন করাও ছিল প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু সময় গড়ালেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
পুরো বিষয়টি তেমন কঠিন কিছুই নয়। দরকার শুধু সদিচ্ছা। লন্ডনের টেমস নদীর পানি একসময় খুব দূষিত ও দুর্গন্ধযুক্ত ছিল। টেমস নদী পরিষ্কার করার জন্য আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। আজ তা ঝকঝকে স্বচ্ছ। আমাদের দেশের নদীর উভয় তীরের সীমানা নির্ধারণের জন্য সীমানা পিলার স্থাপন করা হলেও অনেক স্থানে যথাযথভাবে তা স্থাপন করা হয়নি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার লাভের পর আমন্ত্রিত হয়ে ঢাকায় আসার পর বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌযানে রাত্রিযাপন করেন। অথচ কালের আবর্তে এখন বুড়িগঙ্গার পানি ময়লা আবর্জনায় চরমভাবে দূষিত ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে পড়েছে।
অভিযানে ঢাকা জেলা প্রশাসন, বিআইডব্লিউটিএ এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নদী দখল ও দূষণরোধে পর্যায়ক্রমে সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা করবে। বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্ক্যাভেটর ডিএসসিসি থেকে ৪টি বর্জ্যবাহী গাড়ি ও জনবল নিয়োজিত থাকবে। নদী থেকে উত্তোলনকৃত বর্জ্য দ্রুততার সঙ্গে কর্পোরেশনের জন্য মাতুয়াইলস্থ ল্যান্ডফিলে ফেলার ব্যবস্থা নেবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম-পরিচালক গুলজার হোসেন জানান, প্রাথমিকভাবে এ অভিযান তিনমাস চলবে। সম্পূর্ণ নিজস্ব জনবল এবং যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজটি শুরু করা হবে। পরবর্তীতে একটি প্রকল্পের আওতায় এ কাজ সম্পন্ন করা হবে।
পুরো বিষয়টি যেভাবে বলা হয়েছে সেভাবে হলে বুড়িগঙ্গার চেহারা হয়ত বদলাতে শুরু করবে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর রাজধানী ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে অবৈধ দখলদারদের থেকে উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়। নদী উদ্ধারে একাধিক অভিযানও শুরু করা হয়। প্রথমদিকে বেশ কিছু সাফল্যও দেখা গিয়েছিল। কিন্তু কিছু দূর যেতে না যেতেই তা আবার বন্ধ হয়ে যায়। নদী দখল করে নির্মিত বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার কিছুদিন পরই সেগুলো আবার বেদখল হয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন থেকে যায় নতুন এই কার্যক্রম নিয়ে।
উল্লেখযোগ্য সমস্যার ভেতর আরেকটি সমস্যা হলো হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থিত ট্যানারি। এইসব কারখানার বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য দ্বারা ক্রমাগত দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এসব তরল ও কঠিন বর্জ্যে নানান রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে বুড়িগঙ্গা নদী ও আশপাশ এলাকার মানুষ। ঢাকা ঘিরে থাকা শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ও বুড়িগঙ্গার ১১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এখন শুধুই দুর্বিষহ দূষণ। যেন পানির চেয়ে বর্জ্য বেশি। মাত্রাতিরিক্ত দূষণে হাজারীবাগের পানির রং হয়ে উঠছে কালো, ধূসর, গাঢ় নীল। নদীর স্থানে স্থানে বর্জ্য দূষণের বুদ্বুদ উঠতেও দেখা যায়। ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে যে কোনো মূল্যে রাজধানীর হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি কারখানা সাভার চামড়া শিল্পনগরিতে স্থানান্তরের জন্য চূড়ান্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। নির্ধারিত এ সময়সীমার মধ্যে যেসব ট্যানারি মালিক হাজারীবাগ থেকে কারখানা সাভারে স্থানান্তর করতে পারবে না, ২০১৭ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে কারখানায় গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ-সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হবে।
এতকিছুর পরেই পুরোপুরিভাবে ট্যানারি কারখানাগুলো এখনো স্থানান্তরিত হয়নি। কোনও কার্যক্রমই যেন সুষ্ঠুভাবে সমাধান হচ্ছে না। ফলে একটির পর একটি সমস্যা নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে। গত দুই দশকে নানা পরিকল্পনা ও প্রকল্প নেওয়া হয়েছে বুড়িগঙ্গাকে রক্ষা করতে। এতে ব্যয় হয়ে গেছে দেড় হাজার কোটি টাকা। তারপরও প্রাণ ফেরেনি বুড়িগঙ্গার। দূষণের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে, বুড়িগঙ্গা এখন বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত চারটি নদীর একটি। রাজধানীর প্রান্ত ঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদীটির পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন পৌঁছেছে শূন্যের কোটায়।
এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকা মহানগরীতে সৃষ্ট দৈনিক পয়ঃবর্জ্যর পরিমাণ ১৩ লাখ ঘনমিটার। এর মধ্যে পাগলা পয়ঃবর্জ্য পরিশোধনাগারে মাত্র ৫০ হাজার ঘনমিটার পরিশোধন করা হচ্ছে। বাকি সাড়ে ১২ লাখ ঘনমিটার অপরিশোধিত অবস্থায় সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এছাড়া হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো থেকে দৈনিক ২১ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। এর মধ্যে রয়েছে ক্রোমিয়াম, সিসা, সালফিউরিক এসিড, পশুর বর্জ্য প্রভৃতি। আর বুড়িগঙ্গার পাড়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন টেক্সটাইল কারখানার বর্জ্যসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানার ৯০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য প্রতিদিন নদীটিতে পড়ছে। ১৭৮টি নালামুখ দিয়ে এসব বর্জ্য বুড়িগঙ্গার পানিতে মিশছে।
এই বিষয়গুলোর অনেকবারই প্রতিকারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন নতুন প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনটারই সুষ্ঠু সমাধান হয়নি।
সরকার নতুন করে যে উদ্যোগ নিয়েছে তা ইতিবাচক। এতে করে বুড়িগঙ্গার আদিরূপে ফিরে আসার এক প্রচেষ্টা রয়েছে। আমরাও পথ চেয়ে আছি। টলটলে পানির বুকে নৌকার গুলইয়ে বসে বুক ভরে নির্মল বাতাস নিয়ে আর উপরে খোলা নীল আকাশ দেখে এক পড়ন্ত বিকেল কাটানোর প্রবল বাসনায় পথ চেয়ে আছি। মনে আশা রাখি কোনও বাধা, কোনও অপশক্তি যেন এই উদ্যোগ দমাতে না পারে।
লেখক : শিশু সাহিত্যিক
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ জানুয়ারি ২০১৭/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন