ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বৃষ্টির দিনে লাউয়াছড়ায়

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৪২, ১৯ মে ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বৃষ্টির দিনে লাউয়াছড়ায়

বনের পাশে লেবু বাগান

ফেরদৌস জামান : ভ্রমণ নেশার মতো। কিন্তু আমার এবারের ভ্রমণটা ছিল অন্যরকম। প্রথমবার সহপাঠীর অসুস্থ হয়ে যাওয়া, দ্বিতীয়বার ভ্রমণ তালিকার শেষে থাকা, আর তালিকার শেষে থাকলে যা হয়। সবশেষ বৃষ্টির কবলে পড়া।

 

তিন তিনবার ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয়েছে বহুল পরিচিত জাতীয় উদ্যান লাউয়াছড়া দেখতে গিয়ে। প্রতিবারের পরিকল্পনাতেই ইচ্ছা ছিল ঘুরে ঘুরে দেখব জীববৈচিত্রে ভরপুর জাতীয় উদ্যানটি।

 

গত মার্চের ২৮ তারিখ বিশেষ কাজে ঢাকায় আসে প্রকৃতি ও সংস্কৃতি সচেতন বন্ধু রোকনুজ্জামান সোহাগ। সন্ধ্যায় মিলিত হই রাজধানীর আগারগাঁও আইডিবি ভবনে। দেড় বছরেরও বেশি সময় পর দেখা। সুতরাং, মাত্র দুই ঘণ্টার আড্ডায় যেন মন ভরল না। পরিকল্পনা হলো পরের দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলবে এক নিরবিচ্ছিন্ন আড্ডা। এই প্রত্যাশায় সে চললো তার অস্থায়ী নিবাস মিরপুর দুই নম্বরে।

 

আমি যথারীতি আমার ঠিকানায়। রাত সাড়ে বারটায় সে ফোন করে জানায়, সকাল সাতটার বাসে হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য ভ্রমণে যাবে। অতএব, ঠিক সময়ে মহাখালী বাস টার্মিনালে উপস্থিত থাকা চাই। কর্মহীন বেকার হওয়ার কারণে এমন করে কতজনের দাবি যে আজ পর্যন্ত মেটালাম তার ঠিক নেই। এনা পরিবহনের বাসটাও মিলে গেল। চলতি পথ দেখতে দেখতে যাব বলে চালকের ঠিক পেছনের আসন দুটি বুকিং দিয়ে উঠে পড়লাম।

 

মুখপোড়া হুনুমান

 

কিলবিলিয়ে জোঁক বেরিয়ে আসবে। বনের নির্দিষ্ট তিন ঘণ্টার ট্রেইল ধরে এগোনোর দশ মিনিট পরই সামনে পড়ে বেশ কয়েকটি মুখ পোড়া হনুমান। আলো স্বল্পতা ও হনুমানের অশান্ত স্বভাবের কারণে মনের মাধুরি মিশিয়ে ছবি তোলা সম্ভব হলো না। বসন্তে ঝরে পরা শুকনো পাতায় ঢেকে গেছে পথ। মড় মড় শব্দে পা চালিয়ে যাচ্ছি মাত্র দুজন মানুষ। গা-ছমছমে পরিবেশে হঠাৎ নড়ে ওঠে বাম পাশের বেতবন। এমন পরিস্থিতিতে থেমে অপেক্ষা করলে চমক হিসেবে কোনো বন্য প্রাণীর সাক্ষাৎ মিলে যায়।

 

সত্যি তাই, কিছুক্ষণ পরই একলাফে পথ টপকে গভীর জঙ্গলের দিকে প্রবেশ করে খয়েরি রংয়ের একটি মায়া হরিণ। অমনি শুরু হল টিপ টিপ বৃষ্টি। ডান-বামে চলে গেছে একাধিক সাইড ট্রেইল। বুঝতে পারছি না সঠিক ট্রেইলে আছি কি না। বৃষ্টি ফোটা বাড়তে থাকায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। ট্রেইল নিয়ে গেল বনের এক প্রান্তে। ছোট্ট ঘরটায় বসে রয়েছে মাত্র দুইজন মানুষ। বাইরে স্তুপ করে রাখা লেবুর হিসেব মেলানোয় ব্যস্ত।

 

আমাদেরকে দেখে বসার জন্য পাটিতে জায়গা করে দিলেন। দশ-পনের মিনিট অতিবাহিত হয়ে গেলেও বৃষ্টি ছাড়ার কোনো লক্ষণ নেই। গল্পে গল্পে সময় বেশ ভালোই কাটছিল। মো. ইউনুস এবার তার বাগান রক্ষককে ইশারা করার কয়েক মিনিট বাদেই পরিরেবশিত হল এক গ্লাস করে লবণ মেশানো ঠাণ্ডা লেবুর শরবত। তারপর কয়েকটা গাছপাকা ডাসা কলা। দুইঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে যায় বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই।

 

বৃষ্টি থেমে গেলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতী গোষ্ঠী খাসি (খাসিয়া) পল্লীর দিকে। বনের মধ্যে এই পল্লী ভ্রমণ অন্যতম আকর্ষণের বিষয়। লাউয়াছড়া ভ্রমণে হেন পর্যটক নেই যারা চমৎকার করে সাজানো পল্লীটিতে বেড়াতে যায় না। বনের মাঝদিয়ে বয়ে যাওয়া সরু খালটা পেরিয়ে অল্প খানিকটা গেলেই সাজানো গোছানো খাসি পল্লী। মোটা বাঁশের ফালি দিয়ে আটকানো একেকটি সিড়ি কেটে ওপরে উঠলেই ছবির মত সাজানো প্রতিটি বাড়ি।

 

খাসিয়া পান    

 

বসতির মাঝদিয়ে এমনভাবে পথ ও সিঁড়ি বানানো যে, একপাশ দিয়ে প্রবেশ করে অন্যপাশ দিয়ে বের হতে পারলে সমস্ত পাড়া ঘুরে দেখা হয়ে যায়। বসতির চারপাশের উঁচুনিচু টিলায় শাল বাগান জুড়ে পানক্ষেত। খাসি পানের প্রজাতীটাই ভিন্ন। আমাদের দেশে উৎপাদিত অন্যান্য জাতের থেকে স্বাদে আলাদা এবং চাষ পদ্ধতিও সাধারণ বরজ পন্থায় নয়। প্রতিটি শাল গাছের গোড়ায় লাগানো পানগাছ বৃক্ষের শরীর বেয়ে উঠে গেছে সর্বোচ্চ ডালটি পর্যন্ত। লকলকে সবুজ পান পাতা বৃষ্টি পানিকে ভিজে যেন ঝকঝক করছে। পান বাগানের সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে করতে চলে আসে ঝুম বৃষ্টি। আটকা পড়ি এক বাড়িতে। খাসিরা পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে ভিষণ সচেতন। অনেকগুলো হাড়িপাতিল মেজে ঝকঝকে করে এবার আমাদেরকে পিড়ি পেতে বসতে দিলেন। এরপর তার ভায়ের হাতে পাঠালেন বেশ কয়েকটি চিড়ার মুয়া, কিছুক্ষণ পর এলাচের নির্জাসে সুগন্ধি এক কাপ করে রং চা।

 

বৃষ্টিস্নাত বিকেল বেলার অমন পরিবেশে এক কাপ চা যে কতটাই লোভনীয় ছিল তা বলার নয়। চমকের শেষ এখানেই নয়, চা শেষে পরিবেশিত হল কাচা শুপারির সাথে বাগান থেকে সদ্য ছিড়ে আনা এক খিলি করে খাসিয়া পান। পান খাওয়ার অভ্যাস না থাকলেও খাসিয়া পানের স্বাদ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে মন সায় দিল না। ওদিকে রোকন তো এক খিলি মুখে ভরেই সাথে বেধে নিল আর এক খিলি পথে খাবে বলে।

 

আমার দেখা এই এক দন্ত চিকিৎসক, যে কিনা পান খাওয়ায় দারুণ অভ্যস্ত। ইচ্ছা ছিল কেবল তিন ঘণ্টার ট্রেইল নয় বনের অপর দুইটি ট্রেইলও ঘুরব। সারাটা দিন দুজনে সমস্তটা বন দেখব কিন্তু তা আর হলোনা। তবুও টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতাগুলোকে এক জায়গায় জড়ো করলে মনেই করতে পারছি না যে, একেবারেই ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলাম। 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ মে ২০১৬/সাইফ       

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়