ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বেত বাগান পেরিয়ে চা-বাগানে

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫৯, ২২ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বেত বাগান পেরিয়ে চা-বাগানে

ফেরদৌস জামান : মার্চ, ২০১৬ এর শেষে রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যে গিয়ে যে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছিল তা এক পর্বে লিখে শেষ করে উঠতে পারিনি। তাই পাঠকদের সাথে ভাগাভাগি করতে আবারও কলম ধরা। বিদ্যু ব্যবস্থা বিকল থাকায় প্রথম রাত বন বিভাগের রেস্ট হাউজের পরিবর্তে থাকতে হয়েছিল অন্যত্র। বিট কর্মকর্তা রতন সাহেবের বিশেষ তৎপরতায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা (সোলার প্যানেল) সচল হলে পরের রাতে সেখানে থাকার সুযোগ হয়। পূর্বের কথামতো খুব সকালে উঠে গাইড নোমানকে নিয়ে বের হলাম বেত বাগান দেখতে। চশমা বা মুখপোড়া হনুমান নয়, মনে সাধ মায়া হরিণ দেখব। বনের এই বিশেষ অংশে বেশ কিছু মায়া হরিণ রয়েছে। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে গভীর বেত বাগান থেকে এরা প্রায়ই পথে বা ফাঁকা মাঠে বেরিয়ে আসে।

 

রেস্ট হাউজ থেকে এক কি.মি. ভেতরে প্রবেশ করলেই বেত বাগান এলাকা শুরু। নীরব বেত বাগানের মাঝ দিয়ে রয়েছে সরু পথ। আগাম বর্ষায় বেতের লকলকে ডগায় ছেয়ে গেছে পথের উভয় পাশ। শুনশান নীরবতা, মাঝে মাঝে কানে ভেসে আসে কেবল দু’একটা নাম না-জানা পাখির ডাক। শিক্ষানবীশকে যেমন শেখানো হয় ঠিক তেমন করে নোমান আমাদের অনেক পাখির আওয়াজ চিনিয়ে দিল। মোরগের ঢাক চেনা নতুন কিছু নয় তবুও বন্য মোরগ বলে কথা। এই অংশে মোরগ রয়েছে প্রচুর। প্রতিটি দলে ৭-৮টা করে ঘুরে বেড়ায় স্বাধীন মনে। তীক্ষ্ম আওয়াজ তুলে ক্ষণে ক্ষণেই মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায় ঝাকে ঝাকে টিয়া পাখি। কোনো বৃক্ষের ছড়ানো উঁচু মগডালে বসে খানিক বাদে আবার ফুরুৎ করে উড়াল দেয়। চিল রয়েছে একাধিক প্রজাতীর। অনুচ্চ ডালে ঘুপটি মেরে বসে থাকে। যেন চোখ দুটো উপড়ে দিতে এখুনই এদিকে উড়ে আসবে।

 

 

বনের আর একটি ব্যতিক্রম পাখি র‌্যাকেট ফিঙ্গার, বা দুই লেজ বিশিষ্ট ভিমরাজ। কালো কুচকুচে ভিমরাজের লেজ গোড়া থেকেই দু’ভাগ হয়ে গেছে। সহজে নিচু ডালে বসে না। সুতরাং ছবি তোলায় একেবারেই সুবিধা করা যায়নি। একসাথে অনেকটা সময় আছি তাই নোমানের সাথে খাতির জমে উঠেছে বেশ আগেই। নিজ থেকেই সাথে নিয়েছিল গাছপাকা কলার কাদি এবং ঘরে বানানো চালের গুড়ার ঝাল বড়া। সে শুধু গাইডই নয় একজন অভিনেতাও। স্বচেতনতামূলক নাটকে সে অভিনয় করে। মাত্র কিছু দিন আগে মঞ্চস্থ হয়েছে তার একটি নাটক। মোবাইল ফোনে ধারণ করা দু’একটা ভিডিও ক্লিপ ও ছবি দেখিয়ে সে যেন একটু লজ্জাই পেল। নোমানের গল্প ও অভিজ্ঞতার কথা শুনতে শুনতে কখন যে প্রবেশ করেছি বেত বাগানের এক অচেনা প্রান্তে টেরই পেলাম না। সে নিজেও যেন দিশা খুঁজে পাচ্ছে না। রোকন পারে তো আনন্দে তখনই চিৎকার শুরু করে দেয়, কারণ পথ হারানো, অনিশ্চয়তা এসব তার প্রিয়। তার কথায় বেড়াতে এসে এটাই হলো অ্যাডভেঞ্চারের মজা।

 

রোকন হুররে বলে চেঁচিয়ে উঠতে যাবে তখনই নোমান তর্জনি ঠোঁটে চেপে উস স স শব্দ করে ডান দিকে তাকানোর ইশারা করল। বলল, হরিণের আওয়াজ! শুনতে পাচ্ছেন? হ্যাঁ, সত্যিই তো কি যেন এক প্রকারে ডেকে যাচ্ছে। হরিণ সুন্দর প্রাণী হলে কি হবে আওয়াজ ভীষণ বাজে। হরিণ দেখার সাধ ঐ আওয়াজ শুনেই মেটাতে হলো। তাকে আর চোখে দেখা গেল না।

 

 

এবার বিদায় নেবার পালা। নোমানকে বিদায় দেবার আগে জেনে নিলাম ফিনলে টি-এস্টেট যাওয়ার পথ। এই দিনের লক্ষই ছিল বেত বাগান হয়ে চা বাগানের দিকে চলে যাওয়া। মজার ব্যপার আমাদের ঢাকা শহরের কোনো গলির ভেতর দিনের বেলাতেই ভয় লাগে। কখন দু’পেয়ে সভ্যরা এসে কোমরে কিছু একটা ঠেকিয়ে সুরসুরি দিতে দিতে বলবে, যা কিছু আছে দিয়ে দে। অথচ এখানে চারপাশে কেউ নেই। কত জীবজন্তু। কিন্তু ভয় নামক জিনিসটা ভুল করে একবারও অনুভূত হলো না। নোমানকে বিদায় দেয়ার পর বন থেকে বাইরে বের হতে সময় লাগল প্রায় দুই ঘণ্টা। পথে একটি মানুষেরও দেখা পেলাম না। বনের পর খাল পেরিয়েই ফিনলে টি-এস্টেট এলাকা শুরু। সেইসঙ্গে হবিগঞ্জ ছেড়ে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায় প্রবেশ। বিস্তর চা-বাগান, এই সমতল তো এই টিলাময়। গাছে গাছে থোকা থোকা নতুন পাতা। দিগন্তজোড়া সবুজ মখমলের পড়তে ঢেকে রয়েছে। দূরে পাতা ছাড়াতে ব্যস্ত শ্রমিকের দল যেন সেই মখমল পড়তের ওপর রঙিন সুতায় তোলা একেকটি নিখুঁত নকশা। বাগানের মাঝ দিয়ে বন্ধুর পথ, তবে চলা খুব কঠিন নয়। চা-বাগানের পরিপাটি সৌন্দর্য ক্রমেই আমাদের গ্রাস করে ফেললো তার পেটের ভেতর। চোখ যতদূর যায় উঁচু-নিচু টিলাগুলোয় কেবল সবুজের ঢেউ খেলে যায়। মনে পড়ে সমরেশ মজুমদারের বিখ্যাত উপন্যাস ‘সাতকাহন’র কথা। উপন্যাসের এক জায়গায় অজগর সাপ দেখে মূর্ছা যাওয়ার ঘটনা রয়েছে। দার্জিলিং-এর বিস্তর এলাকাজুড়ে চা-বাগান। অনবরত মেঘের দুরন্তপনা যেমন সেখানকার পরিবেশের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, তেমনি বহু পুরনো জঙ্গল হওয়ায় ভয়ও রয়েছে। জঙ্গল থেকে অজগর ও নানা প্রজাতীর বিষধর সাপ প্রায়ই বের হয়।  আমাদের দেশের বাগানগুলোয় সে আশঙ্কা নেই বললেই চলে।

 

 

এই টি-এস্টেটের অধীনে রয়েছে ৭-৮টি শ্রমিকপল্লী। পল্লীর আগেই আলাপ হয় শ্রমিক রঞ্জন কুমার বড়াকের সাথে। জীবনের শুরুই হয়েছে তার চা-বাগানে। এত কষ্ট, বঞ্চনা তবুও স্বপ্ন দেখেন ঐ চায়ের রাজ্যেই যেন মরণ হয়। আমরা জানি দেশে সবচেয়ে কম পারিশ্রমিকে কাজ করে এই চা-শ্রমিকরা। কথায় কথায় উঠে আসে তাদের বঞ্চনার কথা। মৌসুমে একজন শ্রমিক প্রতি ২৫ কেজি চা-পাতা সংগ্রহের বিনিময়ে পেয়ে থাকে ৮৫ টাকা। এরপর থেকে অতিরিক্ত প্রতি ১ কেজির জন্য মেলে আড়াই থেকে তিন টাকা। মৌসুম ছাড়া অন্য সময়গুলোতে একই পরিমাণ পারিশ্রমিক মেলে ১৮ কেজিতে। সে সময় গাছে পাতা কম থাকায় অতিরিক্ত সংগ্রহের উপায় থাকে না। মনে মনে যা প্রত্যাশা করছিলাম তা পেয়ে যারপর নাই ধন্য হলাম। রঞ্জন বাবু দূপুরে তার ঘরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানালেন। ভাতের সাথে চা-পাতা ভর্তা! কত দিন যে এই জিনিসটির অপেক্ষা করেছি তার ঠিক নেই। ছোট্ট ঘরগুলো পরিপাটি করে বসবাস করা তাদের সংস্কৃতি। খাবার প্রস্তুত হতে থাকল এদিকে চৈত্রের তীব্র রোদে আমাদের চেহারাও চা-শ্রমিকদের মতো পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। পরিস্থিতি দেখে রঞ্জন বাবু বললেন, চাইলে আমরা গোসল সেরে নিতে পারি। গোসলের কথা বলার আগে পাইপ দিয়ে বেরুনো টলটলে ঠান্ডা পানি দেখে এমনটাই ভাবছিলাম। উল্লেখ্য, অত্র এলাকায় চাপ দিয়ে বা মোটর বসিয়ে পানি উত্তোলন করার প্রয়োজন পড়ে না। বিশেষ ভূমি বৈশিষ্ট্যের কারণে পাইপ দিয়ে এমনিতেই সর্বক্ষণ পানি নির্গত হয়।

 

 

রোদের তীব্রতা কমার অপেক্ষায় থাকলে সময়ের এদিক-সেদিক হয়ে যেতে পারে। সুতরাং অপেক্ষা না করে বাগানের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া লিকলিকে পথ ধরে হাঁটা শুরু করলাম। সামনে রয়েছে হুগলিয়া গাজীপুর নামক অটোরিকশা স্ট্যান্ড। পৌঁছতে লেগে যাবে আরও দেড় ঘণ্টা। সেখান থেকে চল্লিশ মিনিট শ্রীমঙ্গল সদর। এই মেঠো পথ তো এই ইট বিছানো। চা-বাগানের সবুজ স্নিগ্ধ পরশ নিতে নিতে এগিয়ে চললাম দুইজন। পেছনে পড়ে থাকল চির বঞ্চনা নিয়ে থাকা শ্রমিক পল্লীর নীরবতা, সারল্য, আন্তরিকতা, আতিথেয়তা এবং অনেক কিছু।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ জুন ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়