ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

দোটানায় সরকার

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৬, ৭ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দোটানায় সরকার

কেএমএ হাসনাত : বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুর রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে দোটানায় পড়েছে সরকার।

 

গোয়েন্দা সংস্থা বলছে তিনি জাতীয় পার্টি করেন, আর জাতীয় পার্টির দাবি তিনি আওয়ামী লীগ করেন।

 

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এএইচএম এরশাদের হাত ধরে বাচ্চুর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় বলে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তবে জাতীয় পার্টির দাবি তিনি আর এখন জাতীয় পার্টিতে নেই, এখন তিনি আওয়ামী লীগ করেন।

 

জাতীয় পার্টির টিকিটে বাগেরহাট-১ আসন থেকে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন বাচ্চু। বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আসিন হওয়ার পর সরকারের প্রভাবশালীর আত্মীয়ের পরিচয় দিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে কয়েক শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

 

বাচ্চুর রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে নানা প্রশ্নের সূত্র ধরেই বিষয়টি জাতীয় সংসদেও আলোচনায় ঠাঁই পায়। তার দুর্নীতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকেও নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। এক পর্যায়ে বাচ্চুর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও ঘোষনা দেন তিনি।

 

দুর্নীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলায় ওই ব্যাংকের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারির নাম আসলেও প্রতিবারই বাচ্চুর নাম রহস্যজনক ভাবে বাদ দেওয়া হয় আর সেই সঙ্গে তার খুঁটির জোর নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়।

 

এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে বাচ্চুর রাজনৈতিক পরিচয় উদ্ধার করার দায়িত্ব দেওয়া হয় একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে। সম্প্রতি সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

 

এতে বলা হয়েছে, শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুর পিতার নাম মৃত শেখ আব্দুল হামিদ, স্থায়ী ঠিকানা- গ্রাম ও ডাকঘর: আড়–য়াডিহি, থানা- মোল্লার হাট, জেলা-বাগেরহাট। বর্তমান ঠিকানা: বাড়ি নং-২/২-এ, রোড নং-৪, ডিওএইচএস (পুরাতন) বনানী, ঢাকা।

 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুর স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে। এক ছেলে ও মেয়ে। ছেলেটি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। তার প্রয়াত পিতা শেখ আব্দুল হামিদ পুলিশের উপ-পরিদর্শক ছিলেন। তার তিন ভাই ও তিন বোন রয়েছে। ভাইয়েরা হলেন লাভলু শেখ, বাবলু শেখ ও পান্না শেখ। বাবলু শেখ সপরিবারে অস্ট্রেলিয়া ও অপর দুই ভাই ঢাকায় বসবাস করেন। বোনেরা বিবাহিত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের প্রাক্তন এই চেয়ারম্যানের পেশা সম্পর্কে বলা হয়েছে, তার আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা রয়েছে। বিশেষ করে লিফট ও গাড়ির যন্ত্রাংশের ব্যবসা রয়েছে তার। এছাড়াও তিনি ২০১০ সাল থেকে ফিসারিজ বোটেরও ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তার প্রায় শতাধিক ফিসারিজ বোট রয়েছে।

 

রাজনৈতিক পরিচয় প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্রজীবনে শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুর কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া যায়নি। তিনি আশির দশকে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৮৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রাথী হয়ে বাগেরহাট-১ (চিতলমারি,মোল্লারহাট ও ফকিরহাট) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

 

সংসদ সদস্য থাকাকালীন তিনি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ১৯৮৮ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাগেরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি বাগেরহাট জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।

 

শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ার আগে ২০০৯ সালে জাতীয় পার্টির সক্রিয় প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা রেখে চলতেন বলে জানা যায়। বর্তমানে তিনি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন।

 

তবে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-দপ্তর সম্পাদক আবুল হাসান আহমেদ জুয়েল বুধবার রাইজিংবিডিকে বলেন, শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু আগে জাতীয় পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন আর তার  জাতীয় পার্টির সঙ্গে কোন সম্পর্ক নাই। তিনি এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

 

বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতি প্রকাশের পর থেকেই অদৃশ্য কারনে ব্যাংকের সাবেক এই চেয়ারম্যানের সম্পৃক্ততা নিয়ে লুকোচুরি খেলা চলছে। আর এ থেকেই তার রাজনৈতিক পরিচয় জানার আগ্রহ বাড়তে থাকে। বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন মোট ৫৬টি মামলা করেছে।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় সেপ্টেম্বরের ২১, ২২ ও ২৩ তারিখে মোট ১৫৬ জনের বিরুদ্ধে ৫৬টি  মামলা হলেও এর কোনটিতে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের ওই সময়কার চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুসহ কোন পরিচালককে আসামি করা হয়নি। 

 

এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার দুদকের সাপ্তাহিক সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের মহাপরিচালক ড. মো. শামসুল আরেফিন বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে যে অনুসন্ধান করেছি তাতে বাচ্চুর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। এখন মামলাগুলোর তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। তদন্ত পর্যায়ে তার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে আসামি করা হবে।’

 

কিন্তু অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ উচ্চ পর্যায়ে থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন দুদকের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেখানে বাচ্চুর সম্পৃক্ততা মিলেছে- সংবাদিকদের এমন প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারেনি দুদক কর্মকর্তারা।

 

২০১০ সালে বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে কমিশন। পাঁচ বছরে পাঁচবার অনুসন্ধানকারী টিম পুনর্গঠন করা হয়। সর্বশেষ দুদকের উপপরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন একটি টিম এসব অভিযোগ অনুসন্ধান কাজ শেষ করেন।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দেয়া বেসিক ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, চলতি বছরের প্রথন তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) ৪১৩ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ব্যাংকটি। মার্চ শেষে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৮০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আর মূলধন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৬৩৪ কোটি টাকায়।

 

এ ছাড়া চলতি বছর ১৪ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বিতরণ বেড়েছে ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ব্যাংকের ৬৮ শাখার মধ্যে লোকসানি শাখার সংখ্যা ৩৭টি।

 

এর আগে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বেসিক ব্যাংকের বিভিন্ন অনিয়মের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। গত বছর আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রধান কার্যালয়ের ঋণ যাচাই কমিটি বিরোধিতা সত্ত্বেও বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সেই ঋণ অনুমোদন করেছে। ৪০টি দেশীয় তফসিলি ব্যাংকের কোনোটির ক্ষেত্রেই পর্ষদ কর্তৃক এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ পরিলক্ষিত হয় না।

 

পর্ষদের ১১টি সভায় ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে তিন হাজার ৪৯৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। যার বেশির ভাগ ঋণই গুরুতর অনিয়মের মাধ্যমে করা হয়েছে। এই ঋণ পরিশোধ বা আদায় হওয়ার সম্ভাবনা কম বলেও মতামত দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে দুর্নীতির কারণে ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

 

শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক ২০০৯ সাল পর্যন্ত একটি লাভজনক ব্যাংক ছিল। কিন্তু এরপর যখন রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে নিয়োগ দেওয়া হয় তখন থেকেই ব্যাংকটির আর্থিক অনিয়মের সূত্রপাত ঘটে বলে।

 

অভিযোগ ওঠে যে, চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের প্রত্যক্ষ মদদে বেসিক ব্যাংকে একে একে ঘটে যায় অনেক আর্থিক কেলেঙ্কারি। পরে সরকারের শীর্ষ মহলের নির্দেশে বাচ্চুকে ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

 


 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ অক্টোবর ২০১৫/হাসনাত/নওশের

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ