ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ব্যাঙ্গালুরুতে দুই চমক এবং পনির তরকারী

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ২৩ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ব্যাঙ্গালুরুতে দুই চমক এবং পনির তরকারী

ফেরদৌস জামান : নতুন বাসা নিয়েছি, সম্পূর্ণ আবাসিক এলাকায়। ব্যাঙ্গালুরুতে বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ ঐতিহ্য রয়েছে- প্রতিটি বাড়ির ছাদে একটি ছোট্ট ফ্ল্যাট থাকবে। ছোট বলতে একটি ঘর সাথে গোসলখানা, পায়খানা এবং রান্না ঘর। আর সম্পূর্ণ খোলা ছাদটা তো অতিরিক্ত হিসেবে থাকছেই। সহজ করে বললে যাকে চিলেকোঠা বলা হয়। দেখা যায় এই সমস্ত ফ্ল্যাট ভাড়ার ব্যাপারে ব্যাচেলররা অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। রাজাজী নগর আবাসিক এলাকারয় তেমনই এক তিনতলা বাসার চিলেকোঠায় উঠে পড়লাম।

 

কলেজে ভর্তির খোঁজখবর নেওয়া তখনও শেষ হয়নি। একসাথে বেশ কয়েকটি কলেজের অফার লেটার নিয়ে কেবল ঘুরছি আর ঘুরছি। এক ঢিলে দুই পাখি মারার কাজটি ভালোভাবেই চলছে। এই যেমন, বাসা পরিবর্তনের পরের দিন যাব শহর ছেড়ে একেবারেই বাইরে ইন্দিরা নগরের ওদিকটায় গার্ডেন সিটি কলেজে। সাথে থাকবে পাম্পি দিদির স্বামী সুপ্রিয় দাদা। তিনি আগেই বলে রেখেছেন, কলেজে খোঁজ নেওয়া ছাড়াও নাকি আমার জন্য রয়েছে দুই দুইটি চমক। কিন্তু জানতে চাইলে বললেন, তা তো বলা যাবে না হে! এই দিনের বাহণ তার মোটর সাইকেল। ততো দিনে আমি মোটর সাইকেল কিনে উঠতে পারিনি। ব্যাঙ্গালুরুতে ছাত্র মাত্রই নিতম্বের নিচে ঐ বাহণটি থাকতে হবে। মাত্র দশ থেকে পনেরো হাজার রুপিতেই মিলে যায়। দুই-তিন ঘণ্টার খোঁজখবরে একটি মোটর সাইকেল কিনে ফেলা কোন বিষয় নয়।

 

এদিকে বাড়ির মালিক সুপ্রিয় দাদার পরিচিত হওয়ায় প্রথম দুই দিন খাবারের জন্য কোন চিন্তা করতে হয়নি। পরের দিন সকাল সাতটায় সুপ্রিয়দা এসে হাজির। আসার আগে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন। আসা মাত্রই বেড়িয়ে পড়ি। দরজা থেকে বাহিরে পা দিয়ে একইসাথে চমকিত এবং পুলকিত দুটোই হই। বাড়ির মূল দরজার সামনে অসাধারণ এক ফুলেল আয়োজন! না, আমাকে বরণ করতে বা শুভেচ্ছা জানাতে ফুলের তোরা হাতে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। দরজা থেকে নেমেই পিচ ঢালা কালো পথ, আর সেখানেই চক পাউডার জাতিয় কিছু দিয়ে সুনিপূণ হাতে অঙ্কিত হয়েছে চমৎকার নকশা। নকশার উপর দিয়ে কামিনী-শিউলী ফুলের মত ছোট ছোট সাদা ও লাল সুগন্ধি ফুল ছড়ানো। সকালের কাঁচা রোদ কেবল এসে প্রবেশ করেছে চওড়া গলির ভেতর, তাতেই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে নকশাদার ফুলেল কারুকাজটি।

 

পলক ফিরিয়ে ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখি প্রতিটি বাড়ির দরজার সামনেই একই কারুকাজ। সকাল সকাল এমন সুন্দর একটি দৃশ্য দেখার মধ্য দিয়ে দিনের সূত্রপাত হলো ভাবতেই ভালো লাগছিল। আমার অভিব্যক্তি দেখে সুপ্রিয়দা বোধহয় বিষয়টি ভেঙ্গে বলার প্রয়োজন বোধ করলেন। তিনি জানালেন, ধর্মীয় বিশ্বাসের স্থানীয় চর্চার অংশ, প্রতিদিন ভোরবেলা বাড়ির গৃহিণী বা সদস্যারা এই দায়িত্ব পালন করেন।

Copy

 

কলেজে ভর্তির কাজ সারতেই পেরিয়ে গেল কয়েক ঘণ্টা। দুপুরে খাবার সময় হয়ে গেছে। মোটর সাইকেলে এক লম্বা টান দিয়ে থামল রাস্তার পাশে নিরিবিলি জায়গায়। ফাঁকা জায়গার মাঝে ফুল গাছে সাজানো উঠানের মাঝে ইয়োরোপীয় ধাঁচের একটি রেস্তোরাঁ। প্রায় প্রতিটি টেবিলেই মানুষ। কেউ খাচ্ছে তো কেউ খাবারের অপেক্ষায়। মনোমুগ্ধকর পরিপাটি পরিবেশ এবং ইয়োরোপ, আমেরিকাসহ খুব উন্নত মানের উপমহাদেশীয় খাবার পাওয়া যায় সেখানে। যার কারণে রেস্তোরাঁটি বিশেষ এক ধরণের মানুষের নিকট বেশ প্রিয়। একটি টেবিলে আমরাও জাগা করে নিলাম। এবার বুঝতে বাকি রইল না যে, এই ছিল সুপ্রিয়দার দুই চমকের প্রথমটি। খাবার শেষে আবারও মোটর সাইকেল যাত্রা। দাদা শুধু বললেন, দৃষ্টি সুক্ষ্ম করে সামনের দিকে তাকাও। আকাশ নীল, স্বতেজ রোদ ঝরে পড়ছে, তারই মাঝে দূরে ভীষণ ফাঁকা জায়গাটায় যেন এক টুকরো কাঁচ মরীচিকার মত কাঁপছে। এগিয়ে যেতে যেতে ক্রমেই তা বড় হতে থাকল। নীল কাঁচের টুকরোটাই এশিয়ার বিখ্যাত টেক পার্ক, মূলত যার কারণে ব্যাঙ্গালুরু সিলিকন ভ্যালি অব ইন্ডিয়া বলে পরিচিত।

 

সুবৃহৎ চত্বরে মিহি করে ছেটে দেওয়া সবুজ ঘাসের পাড়, ঠিক তার মাঝ দিয়ে চলার পথ। পথের শেষে আমরা গিয়ে থামলাম বহুতল কাঁচের দালানটির সামনে, যা ছিল দ্বিতীয় চমক। কয়েকটি বিশাল আকারের দালানের সমন্বয়ে টেক পার্ক। তখনই জেনেছিলাম এখানে সারা পৃথিবীর আঠারোশ সফটওয়্যার কোম্পানি রয়েছে। বিশেষ যোগাযোগ বা পরিচিতি না থাকলে ভেতরে প্রবেশ সম্ভব নয়। দাদার সেই যোগাযোগ থাকায় আমাদের পক্ষে প্রবেশ করতে কোন সমস্যা হলো না। রেজিস্ট্রেশনের পর গলায় একটি করে পাস কার্ড ঝুলিয়ে প্রবেশ করলাম টেক পার্কের ভেতর। সুইডিশ এক কোম্পানিতে দাদার বাঙালি বান্ধবী কাজ করে। সেই সুবাদে পার্কের বিশেষ একটি অংশ ঘুরে দেখা সম্ভব হলো। পরিপাটি পরিবেশ, হাজার হাজার মানুষ কর্মরত অথচ পিন পতন নীরবতা। এ ছিল টেক পার্কের সে সময়ের বাস্তবতা। জানতে পারলাম বর্তমানে নাকি আরও বেশি উন্নয়ন করা হয়েছে। উল্লেখ করা দরকার, টেক পার্ক ছাড়াও ব্যাঙ্গালুরুতে রয়েছে বিশ্ব মানের শত শত আইটি রিলেটেড প্রতিষ্ঠান। এই সমস্ত দিক বিবেচনায় বিশাল ভূ-খণ্ডের ইন্ডিয়ায় সিলিকন ভ্যালি বলে পরিচিতি লাভ করেছে ব্যাঙ্গালুরু।

Copy

 

এই দিনের আর এক পর্ব গিয়ে শেষ হয় সুপ্রিয়দার বাসায়। পাম্পি দিদি বসে আছেন কখন আমরা পৌঁছব। ফোনে তাদের দুজনের মাঝে একাধিক বার যোগাযোগ হয়েছে কিন্তু আমি টের পাইনি। পরে জানতে পারি, তারা স্বামী-স্ত্রী পরিকল্পনা করেই এমনটি করেছে। মোটর সাইকেল যখন সম্পূর্ণ অপরিচিত এক পথে প্রবেশ করল, দাদার কাছে জানতে চাইলে বলল, চুপচাপ বসে থাকো, দেখবে দারুণ একটা জায়গায় যাব! মোটর সাইকেলের হর্ন বাজতেই উপর থেকে নেমে এলেন পাম্পি দিদি। সিঁথিতে সিদুর, চোখে অনেক পাওয়ারের কাঁচওযালা চশমা, পরনে লাল পাড়ে সাদা শাড়ি- একেবারে নিপাট বাঙালি। কে জানত দিদির সাথে দেখা হয়ে যাবে, তাও আবার তার বাসায়! ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা শেষে একই স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। অথচ, চলনে বলনে কি দারুণ বাঙালিয়ানা।

হাত মুখে পানি লাগিয়ে খানিক স্বতেজ হয়ে ফিরতেই দেখি নাস্তার সমাহার। প্রতিটি পদ দিদির নিজ হাতে বানানো। কাঁঠাল কোষ শুকানো চিপসের (এই সিরিজের গত একটি পর্বে চিপস বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ আছে) পিরিচ এগিয়ে দিয়ে ছুরে দেয়া হলো প্রশ্ন- বল দেখি এটা কী? ব্যাঙ্গালুরুতে গিয়ে অনেক কিছুর সাথেই আমার প্রথম পরিচয় হয়। যেমন-পনির তরকারী, মাংসের সাথে পনির যোগে তরকারী। আহ, জুরি নেই! এই তরকারীর গল্প যেদিন প্রথম শুনেছিলাম সেদিনই দিদি বলেছিল, আমার বাসায় এসো খাওয়াব। সে কথা বেমালুম ভুলে গেলেও দিদি ভোলেনি। গল্পে গল্পে পেরিয়ে গেল বেশ খানিকটা সময়। এবার রান্না ঘর থেকে দিদি জোরে একটা ডাক ছেড়ে বললো, চলে এসো কী খাবে তা রান্না করাটাও দেখে নাও। তাছাড়া, এখন থেকে তো নিজেরটা নিজেকেই রান্না করে খেতে হবে। যে কোনো ধরনের সবজি, মুরগি, গরু, খাসির মাংসে পনিরের সংযোজন স্থানীয়দের ভীষণ প্রিয়। সুপ্রিয়দার পরিকল্পনায় দুইটি চমকের উল্লেখ থাকলেও তা আসলে দিন শেষে আমার নিকট ছিল তিন তিনটি চমক।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ নভেম্বর ২০১৬/তারা    

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়