ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

উচ্ছেদের পরদিনই ফুটপাতে দোকান !

শাহনেওয়াজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ৩০ অক্টোবর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উচ্ছেদের পরদিনই ফুটপাতে দোকান !

খান মোঃ শাহনেওয়াজ : গণমাধ্যমে খবরটি এসেছে এভাবে- রাজধানীর গুলিস্তানে উচ্ছেদ অভিযানের মাত্র ১৬ ঘণ্টা পর ফুটপাতে আবার দোকান বসেছে। এই দোকান বসানোয় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সহযোগিতা করতে দেখা গেছে। হকাররা জানিয়েছেন, ফুটপাতে বসার বিনিময়ে এই নেতাদের নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিতে হয়।

 

এই খবরটি নতুন নয়। মাঝে মাঝেই এ ধরণের খবর প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে। অনেক বছর আগে থেকেই এমন হয়ে আসছে। রাজধানীর ফুটপাত থেকে হকারদের উচ্ছেদ করা হয় কিন্তু পরে আবার আগের চিত্রই দেখা যায়। অর্থাৎ হকাররা বিক্রির জন্য মালপত্র নিয়ে বসে পড়েন ফুটপাতে। এটা রাজধানী ঢাকার বেশ পুরোনো চিত্র ।  

 

রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় বঙ্গবন্ধু স্কয়ার পাতাল মার্কেট, ঢাকা ট্রেড সেন্টার দক্ষিণ, ঢাকা ট্রেড সেন্টার উত্তর, গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্স, সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্স ও ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডের চারপাশে ২৭ অক্টোবর দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত উচ্ছেদ অভিযান চালায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। উচ্ছেদ করা হয় পাঁচ শতাধিক অবৈধ দোকান। ফুটপাতে এবং রাস্তার ওপর এসব দোকান চালাতেন হকাররা ।

 

গুলিস্তানে ফুটপাতে হকারদের দোকান নতুন নয়। ১৯৭৫ সালের শেষ দিকে শীতের শুরুতে গুলিস্তান সিনেমা হলকে কেন্দ্র করে ফুটপাতে বসতে শুরু করে হকারদের দোকান। তাদের পণ্য বলতে ছিলো বিদেশ থেকে আসা পুরনো গরম কাপড় বিশেষ করে সোয়েটার। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে হকারের সংখ্যা। বছর না ঘুরতেই হকারদের পণ্যে যোগ হয় পুরনো সার্ট,ট্রাউজার, টি শার্ট, জ্যাকেট, ব্লেজার এবং মেয়েদের কাপড়। পরবর্তী সময়ে এসব নিলামের কাপড় হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বাড়তে থাকে দোকানের সংখ্যা। ১৯৭৭ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ফুটপাতে আসতে থাকে দেশে তৈরি নতুন কাপড়, জুতা-স্যান্ডেল এমনকি কাঁচের বাসন পর্যন্ত। ঢাকায় ফুটপাত হয়ে যায় হাটের মত। পেয়ে যায় স্থায়ী বাণিজ্যিক চেহারা। ফুটপাতকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে বিশাল কারবার। এটি হয়ে ওঠে রাজনৈতিক নেতা, মাস্তান ও সন্ত্রাসীদের অর্থের উৎস এবং পুলিশের ‘ফাও কামাই’ করার দারুন ক্ষেত্র। মূলত: শুরু থেকেই ফুটপাত এই শ্রেণির লোকদেরকে বিনা পরিশ্রমে অর্থ দিয়ে যাচ্ছে। আর একারণে ধীরে ধীরে পুরো ঢাকা মহানগরীর ফুটপাত চলে গেছে হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দখলে।

 

কৌতুকের ব্যাপার হলো, ফুটপাতকে হকারমুক্ত করার জন্য বিভিন্ন সময়েই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। হকারদের উচ্ছেদ করা হয়েছে কিন্তু দুদিন পরই হকাররা মালপত্র নিয়ে দোকান সাজিয়েছেন ফুটপাতে। তাদের সহায়তা করেছেন ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, স্থানীয় মাস্তান ও সন্ত্রাসীরা এবং পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। ডিসিসির ম্যাজিস্ট্রেট একদিকে বুলডোজার ও লোকবল নিয়ে গিয়ে ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ করে চলে আসেন। অন্যদিকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী,মাস্তান ও সন্ত্রাসীরা হকারদেরকে ফের ফুটপাতে বসিয়ে দেন। এইভাবেই চলছে দিনের পর দিন।    

 

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ফুটপাত ও রাস্তায় হকারদের কাছ থেকে প্রতিদিনিই বড় অঙ্কের টাকা তোলেন। মূলত তাঁরাই ফুটপাতে হকার বসতে সহযোগিতা করেন। এক্ষেত্রে তারা আইন ও প্রশাসনের ধার ধারেন না। দিনচুক্তিতে হকারদের কাছ থেকে টাকা তোলেন এবং বাটোয়ারা করে যার যার মত নিয়ে নেন।   

 

বিনা পরিশ্রমে টাকা কামাই করার এমন সুন্দর ক্ষেত্র বাংলাদেশে আর নেই। তাই দিনে দিনে অত্যন্ত মূল্যবান হয়ে উঠেছে রাজধানীর প্রতিটি এলাকার ফুটপাত। হকাররাও চিন্তা করেন, মার্কেটে বা বাণিজ্যিক ভবনে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করার জন্য দোকান ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়েই বিশাল অংকের বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু ফুটপাতে সেই প্রাথমিক অর্থের প্রয়োজন পড়ে না। কেবল পণ্যের চালান বা নূন্যতম মূলধন হলেই চলে। তাই তারা ফুটপাতে বসার মতো ঝুঁকি নেন।

 

এর আগে সরকার ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদের ক্ষেত্রে পুনর্বাসনের উদ্যোগও নিয়েছিলো। সেই বিবেচনায় রাজধানীর সেগুন বাগিচায় এবং মানিক মিয়া এভিনিউয়ে হকারদের অস্থায়ী দোকান বসানোর ব্যবস্থা করেছিলো। কিন্তু দেখা গেলো, যেখান থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, হকাররা সেখানেও বসছেন এবং অস্থায়ী বাজারেও পসরা সাজিয়ে বসছেন। বছরখানেক চলার পর সেগুন বাগিচা ও মানিক মিয়া এভিনিউয়ে অস্থায়ী হকার মার্কেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। অবশ্য রাজধানীর অন্য কয়েকটি এলাকায় হকারদের জন্য অস্থায়ী ভিত্তিতে হলিডে মার্কেট চালু আছে। 

 

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন অর্থাৎ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) দুই মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদে দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করে চলেছেন। রাজধানীর ফুটপাত দখলমুক্ত করার জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশও রয়েছে। দুই সিটি  করপোরেশন ধারাবাহিকভাবে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনাও করছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই দেখা যাচ্ছে না। উচ্ছেদের একদিন দুদিন পর তা আবার হকারদের দখলে চলে যাচ্ছে। অথচ উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনায় যে ব্যয় হয় তা জনগণের দেওয়া করের অর্থ। বলতে গেলে উচ্ছেদের নামে এই অর্থ বুড়িগঙ্গার পানিতে ফেলা হচ্ছে।

 

বুলডোজার ও পুলিশ বাহিনী নিয়ে হকার উচ্ছেদ অভিযান আমরা অনেক দেখেছি। ওতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সরকারের উচিত এ ব্যাপার কঠোর হওয়া। রাজনৈতিক দলেগুলোর উচিত নিজেদের যারা হকারদের ফুটপাতে বসতে সহায়তা করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। পুলিশ বাহিনীর উচিত তাদের যে সব সদস্য দিনের পর দিন হকারদের কাছ থেকে ‘ফাও কামাই’ করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা-কর্মী আর পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য যদি আন্তরিক হন, তারা যদি বিনা পরিশ্রমে টাকা প্রাপ্তির লোভ সামলাতে পারেন তবেই রাজধানীর ফুটপাত হকার মুক্ত হবে, নয়তো নয়।

 

লেখক : সাংবাদিক।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ অক্টোবর ২০১৬/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়