ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ভারতীয় গরু না থাকায় কেনা-বেচায় মন্দা

তানজিমুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ২৬ এপ্রিল ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভারতীয় গরু না থাকায় কেনা-বেচায় মন্দা

সিটি হাটে গরু কেনা-বেচা হচ্ছে

তানজিমুল হক, রাজশাহী : উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ গরু ও মহিষের মোকাম রাজশাহী নগরীর উপকণ্ঠ সিটি হাটে কেনা-বেচায় মন্দা দেখা দিয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে গরু না আসায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। হাটে সরবরাহ কম থাকায় গরুর দাম মাত্রাতিরিক্তভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

ফলে মাংসের দাম মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে কয়েক দফা বেড়েছে। গরু সরবরাহ স্বাভাবিক না হলে অচিরেই মাংসের দাম আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি হাটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক হাজার ব্যক্তির জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। এ ছাড়া গরু ব্যবসায় জড়িত প্রায় ২৫ হাজার মানুষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন। 

 

সপ্তায় বুধ ও রোববার সিটি হাট বসে। গত বুধবার সরেজমিনে হাটে দেখা গেছে, গরুর চেয়ে মানুষের সংখ্যা বেশি। এর কারণ হিসেবে হাট কমিটির সদস্যরা বলছেন, গত ১০ বছরে সিটি হাটে ভারতীয় গরুর আমদানি ছিলো বেশি। এ হাটে শতকরা ৬০ ভাগ ভারতীয় গরু বেচা-কেনা হয়। কিন্তু গত ছয় মাস থেকে হাটে ভারতীয় গরুর সরবরাহ নেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী সীমান্ত দিয়ে দেশে গরু ঢুকছে না। দেশি গরুই এখন একমাত্র ভরসা।

 

ভারতীয় গরুর আমদানি না থাকায় গরুর স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। বেড়েছে দাম। ফলে বেচা-কেনা কমে গেছে। গরু কেনার জন্য ঢাকা, মানিকগঞ্জ, নরসিংদি, বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, চট্রগ্রাম, ফেনি, কুমিল্লা ও নেয়ায়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যাপারীরা আসছেন, কিন্তু অতিরিক্ত দামের কারণে তারা কিনতে পারছেন না।

 

নগরীর উপকণ্ঠ হাজরাপুকুর এলাকার ক্ষুদ্র গরু ব্যবসায়ী হালিমা খাতুন। তিনি প্রায় আট বছর থেকে গরুর ব্যবসা করেন। সিটি হাট থেকে প্রতিহাটে দুই থেকে তিনটি ছোট আকারের গরু কেনেন তিনি। এরপর বাড়ি থেকে কিছু লাভে বিক্রি করে দেন। এভাবে তিনি বেশ লাভবান হয়েছেন।

 

কিন্তু বর্তমানে চিত্র ভিন্ন। তিনি জানান, এখন হাটে গরু আমদানি কম। আগে যেভাবে হাটে গরুর সরবরাহ ছিলো, এখন তা নেই। গরু সরবরাহ কম থাকায়, দাম বেড়ে গেছে। ফলে তিনি গরুর কিনতে পারছেন না। ফলে তার ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে।

 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর হাট এলাকার গরুর ব্যাপারী মাইনুল ইসলাম জিলানী। তিনি গ্রাম এলাকার খামারি বা গৃহস্থদের কাছ থেকে গরু কেনেন। এরপর ট্রাকযোগে সিটি হাটে নিয়ে আসেন। বুধবারের হাটে তিনি গরু নিয়ে এসেছেন ১৪টি। কিন্তু দুপুর ৩টা পর্যন্ত একটিও বিক্রি করতে পারেননি।

 

এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, হাটে ভারতীয় গরুর আমদানি নেই, যা আছে সবগুলোই দেশি গরু। এর ফলে গরুর চাহিদা থাকলেও, দাম বেশি হওয়ার কারণে বাইরের ব্যাপারীরা গরু কিনছেন না। ফলে হাটে যারা আমার মতো গরু বিক্রি করতে এসেছেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তিনি মনে করেন, হাটে যদি আগের মতো ভারতীয় গরুর সরবরাহ থাকতো, তাহলে দাম কম হতো। কেউই ক্ষতিগ্রস্ত হতেন না।

 

মেহেরপুরের গাংনি উপজেলার হাড়িভাঙ্গা এলাকার গরু ব্যাপারী হাসান আলী। তিনি গরু কিনতে এসেছেন সিটি হাটে।

 

তিনি বলেন, হাটে শুধুই দেশি গরু, ভারতীয় গরু নেই। ফলে গরুর আমদানি অনেক কম। আমদানি কম থাকায় দাম বেশি। এর ফলে বেশি দাম দিয়ে গরু কিনলে এলাকায় গিয়ে বিক্রি করা কঠিন হবে। এ কারণে গরু না কিনেই ফিরতে হবে। এর ফলে আমার কয়েক হাজার টাকার ক্ষতি হবে।

 

পাবনার সুজানগর এলাকার গরুর ব্যাপারী আবদুল লতিফ বলেন, ‘আমি ২৫ বছর থেকে গরুর ব্যবসা করছি। ১০ বছর থেকে সিটি হাট থেকে গরু কিনে ঢাকা ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করি। হাটে দেশি গরুর সরবরাহ থাকলেও, ভারতীয় গরু নেই। ফলে দাম বেশি। ভারত থেকে গরু আমদানি না হলে গরুর দাম আরো বাড়বে।’

 

তিনি বলেন, মাত্র ৬ মাস আগে যে গরু ২৫ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছি, এখন তা ৩৩ হাজার। গরুর দাম বেশি হওয়ার কারণে আমার মতো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অনেক ব্যাপারীই গরু না কিনে ফিরে যাচ্ছেন।

 

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ি এলাকার খামারি আবুল হোসেন। তিনি জানান, হাটে গরুর দাম বেশি হলে খামারিদের লাভ। কিন্তু বিক্রি না হলে কিছু করার নেই।

 

তিনি বলেন, এ অঞ্চলে যেহেতু ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ রয়েছে; তাই সরকারের উচিত খামারিদের পৃষ্ঠপোষকতা করা। খামারিরা সরকারের সহযোগীতা পেলে গরুর যে সঙ্কট দেখা দিয়েছে, তা কিছুটা হলেও কমবে।

 

অপরদিকে গরুর দাম বেশি হওয়ার কারণে মাংসের দাম মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়েছে। তিন মাস আগে কেজিপ্রতি মাংস বিক্রি হয়েছে আড়াইশ টাকায়। বর্তমানে দাম তিনশ ২০ থেকে সাড়ে তিনশ টাকা। ফলে কেজিপ্রতি বেড়েছে একশ টাকা করে।

 

এ ব্যাপারে নগরীর হড়গ্রাম এলাকার মাংস ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, গরুর দাম বেশি হওয়ার কারণে মাংসের দাম বেড়েছে। গরুর দাম যে হারে বাড়ছে, তাতে আগামি ৬ মাস পর কেজিতে আরো একশ টাকা বাড়তে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি।

 

সিটি হাট পরিচালনা কমিটির সদস্য ফারুক হোসেন ডাবলু বলেন, সিটি হাটের সঙ্গে প্রায় এক হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকা সম্পৃক্ত। গত এক বছর থেকে হাটে গরু বেচা-কেনা কম হবার কারণে এসব ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা অতিকষ্টে জীবনযাপন করছেন।

 

সিটি হাটের ইজারাদার আতিকুর রহমান কালু অবিলম্বে ভারতীয় গরু আমদানি স্বাভাবিক করার দাবি জানিয়ে বলেন, সরকারকে রাজস্ব দিয়ে আমরা হাট পরিচালনা করি। কিন্তু বর্তমানে হাটের যে অবস্থা, তাতে ইজারার টাকা উঠবে কী না- তাতে সন্দেহ রয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তম পশু হাটটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এর ফলে সরকারও প্রতিবছর কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব হারাবে। পাশাপাশি এ অঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকার পথ রুদ্ধ হবে। তাই এ ব্যাপারে আশু পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকরারের নীতিনির্ধারণী মহলকে আমরা অনুরোধ জানচ্ছি, যেন হাটটি তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে পারে।

 

 

রাইজিংবিডি/রাজশাহী/২৭ এপ্রিল ২০১৫/তানজিমুল হক/রণজিৎ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়