ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

ভালো উপদেশ রুবির চেয়েও দুষ্প্রাপ্য || সালমান রুশদি

মিলন আশরাফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৬, ২৪ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভালো উপদেশ রুবির চেয়েও দুষ্প্রাপ্য || সালমান রুশদি

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

অনুবাদ :  মিলন আশরাফ

মাসের শেষ মঙ্গলবার। ভোরবেলা। জ্বলজ্বল করছে বাসের হেডলাইটগুলো। ব্রিটিশ দূতাবাসের উদ্দেশে রওনা হয়েছে মিস রেহানা। আকাশের মেঘগুলো তার দিকে ধেয়ে আসছে। অচেনা কারও চোখে মেয়েটির সৌন্দর্য মেঘ কেটে না যাওয়া পর্যন্ত পড়বে না। রাস্তায় দাঁড়ানো বাসটা আরবি নকশা অনুযায়ী বহুবর্ণে চিত্রশোভিত। সামনে লেখা ছিল ‘সরে যাও প্রিয়তমা’। সেটা ছিল সবুজ ও স্বর্ণ অক্ষরে। পেছনের দিকটাতে লেখা ছিল ‘টা টা’ এবং ‘ওকে গুড লাইফ’।
মিস রেহানা ড্রাইভারকে বলল, `এটা খুব সুন্দর বাস!’
সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার লাফ দিয়ে বাসের দরজাটা খুলে দিল। সে না ওঠা পর্যন্ত নাটকীয় ভঙ্গিতে মাথাটা নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে রাখল।

মিস রেহানার চোখ দু’টি বেশ বড় বড় ও কালো বর্ণের। যথেষ্ট উজ্জ্বলও। কোনো সাহায্যের প্রয়োজন ছিল না তার। উপদেশ বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ আলী তাকে দেখেই নিজেকে তরুণ ভাবতে লাগল। রেহানার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। দূতাবাসের দরজার সামনে গাড়ির শক্তিশালী আলো জ্বালিয়ে শ্মশ্রুধারী লোকটাকে (যে কিনা পরে ছিল খাকি পোশাক এবং তার মাথায় ছিল ফুলের তৈরি পাগড়ি)  রেহানা জিজ্ঞেস করল, ‘কখন খোলা হবে গেট?’
তারা সাধারণত মঙ্গলবারে আসা মহিলাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে কিন্তু মিস রেহানাকে ভদ্রভাবে বলল, ‘এই ধরুন আধা ঘণ্টা লাগবে, আবার দু’ঘণ্টাও লাগতে পারে। কে জানে কতক্ষণ লাগে আজ? সাহেবরা সব নাস্তা করছেন এখনো।’

ইতিমধ্যে বাস স্টপেজ ও দূতাবাসের মাঝখানে ধূলিমিশ্রিত প্রাঙ্গণে মঙ্গলবারে আসা মহিলাদের গাদাগাদিতে পূর্ণ হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে কিছু মহিলা বোরখা পরিহিতা। বাকিরা নির্লজ্জ পোশাকে। মিস রেহানাও বাকিদের মধ্যে। সবাইকে ভীতসন্ত্রস্ত লাগছিল। এবং তারা তাদের ভাই অথবা চাচাদের বাহুর মধ্য থেকে আত্মবিশ্বাসী চোখে তাকানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু রেহানা এসেছিল একা এবং তাকে তেমন অধীর মনে হচ্ছিল না। মুহাম্মদ আলী (যে কিনা উপদেশ বিশেষজ্ঞ) তাকে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছিল। সাপ্তাহিক অনুনয়কারীর মতো সে বড় বড় চোখে এই অদ্ভুত স্বাধীনচেতা তরুণীর দিকে তাকিয়ে ছিল।

‘মিস, আমার মনে হয় তুমি লন্ডনে পারমিটের জন্য এসেছ।’ উপযাচক হয়েই বলল মুহাম্মদ আলী।
রেহানা দাঁড়িয়ে ছিল শহরের ছোট্ট একটা কুঁড়েঘরের মতো জলখাবারের দোকানের সামনে। মুখের ভেতর চিলি-পাকোরা চাবিয়েও শান্তি পাচ্ছিল না সে। রেহানা ঘুরে তাকাল মুহাম্মদ আলীর দিকে। ভাবল, লোকটার তাকানো পরিপাকনালীর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
সে উত্তর দিল, ‘জি। এবার আপনি দয়া করে যদি কিছু ভালো উপদেশ দিতেন  অল্প খরচে।’পরক্ষণেই সে হাসিমুখে বলল, ‘ভালো উপদেশ রুবির চেয়েও দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু হায়! আমি আপনাকে তেমন কিছুই দিতে পারব না। কারণ আমি একজন এতিম বালিকা। আপনার অন্যান্য ধনী মহিলার মতো নয়। আমার এই ধূসর চুলের কসম।’

মুহাম্মদ আলী সম্মতি জানালো- সে বুঝতে পেরেছে। তারপর বলল, ‘আমার পরামর্শগুলো আমারই অভিজ্ঞতার ফসল। তুমি অবশ্যই এটা থেকে লাভবান হবে।’
রেহানা মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিল, ‘আমি আপনাকে আগেই বলেছি, আমি একজন সস্তা শ্রেণির মানুষ। এখানে আপনি অনেক মহিলা পাবেন পুরো পরিবারসহ। তাদের রোজগারও বেশ ভালো। তাদের কাছে যান। ভালো উপদেশের বিনিময়ে ভালো অর্থ পাওয়া উচিত।’

‘ভাগ্যই আমাকে তোমার কাছে নিয়ে এসেছে। কী আর করার আছে? আমাদের সাক্ষাত পূর্বেই লিখিত ছিল। ভয় পেও না। আমিও গরিব সুতরাং তোমার জন্য আমার উপদেশ সম্পূর্ণ ফ্রি।’
রেহানা পুনরায় হাসতে হাসতে বলল, ‘তাহলে তো অবশ্যই শুনতে হয়। আমার ভাগ্য যেখানে এটা উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে। আমার জন্য এটা সৌভাগ্যও বটে।’
মুহাম্মদ আলী তাকে শহরের এক কোণে কুঁড়েঘরের এক নিচু কাঠের তৈরি ডেস্কের কাছে নিয়ে গেল। রেহানাও খবরের কাগজের প্যাকেটে রাখা পাকোরা খেতে খেতে তার পিছু নিল। মুহাম্মদ আলীকে খাওয়ার জন্য একবারও বলল না সে।

মুহাম্মদ আলী ধূলিমিশ্রিত মেঝেতে একটা কুশন পেতে বসতে দিল তাকে। মেয়েটা কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করেই বসে পড়ল। মুহাম্মদ আলী পায়ের উপর পা আড়াআড়ি রেখে টেবিলে বসল তার সামনেই। দুই থেকে তিন ডজন মানুষ তাকে দেখে খুব ঈর্ষান্বিত হচ্ছিল। কুঁড়েঘরের বাকি সদস্যরা নতুন আসা এই সুন্দরীর ধূসর চুলের ফাঁদে পড়ে কটাক্ষ করতে লাগল। মুহাম্মদ আলী নিজেকে সামলে নিয়ে গভীরভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
‘দয়া করে নামটা এবার বলো।’  
‘মিস রেহানা’ বলল মেয়েটা। এবং সে আরো জানালো ব্রাডফোর্ড লন্ডনের বাসিন্দা মুস্তাফার দারের বাগদত্তা সে।
‘ব্রাডফোর্ড, ইংল্যান্ড’ শান্তভাবে সে বিষয়টা সংশোধন করে দিল- ‘লন্ডন শুধুমাত্র একটি শহর, ঠিক মুলতান কিংবা ভাওয়ালপুরের মতো। কিন্তু ইংল্যান্ড হলো মহান জাতি ও পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশ।’
‘ধন্যবাদ। আমি বুঝতে পেরেছি।’ খুব গুরুত্ব সহকারে রেহানা জবাব দিল।
‘তোমার দরখাস্ত পূরণ করে তারপর দয়া করে আমাকে দেখাও।’মুহাম্মদ আলী বলল।
রেহানা বাদামি কাগজে মোড়া একটা খামে ভাঁজ করা কিছু কাগজ দেখিয়ে বলল, ‘এটা কি ঠিক আছে?’
এই প্রথম তার কণ্ঠে উদ্বেগ ঝরে পড়ল।
‘হুম, একটু অপেক্ষা করো। আমি অবশ্যই এটা পরীক্ষা করে দেখব।’ আলী বলল।

আলী কাগজপত্রগুলো পরীক্ষা করে দেখার আগেই পাকোরা খেয়ে শেষ করে ফেলল রেহানা। মুহাম্মদ আলী বলল, ‘চুপচাপ থাকো, আমি পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত।’
‘আপনার উপদেশের জন্য ধন্যবাদ।’বলল রেহানা, ‘আপনি এটা ম্যানেজ করুন। আমি এখন যাবো এবং গেটের বাইরে অপেক্ষায় থাকবো।’

‘তুমি কী ভাবছ?’ চিৎকার করে কপালে আঘাত করতে করতে জিজ্ঞাসা করলো মুহাম্মদ আলী। ‘তুমি কি এটা সহজ ব্যবসা হিসেবে বিবেচনা করো? শুধু ফর্মটা তাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ঢং করে একটু হাসলেই হবে। তারা সঙ্গে সঙ্গে পারমিট দিয়ে দেবে। মিস রেহানা, আমি তোমাকে বলছি, তুমি যে কোনো থানার চেয়ে খারাপ জায়গায় এসেছ।’
‘সত্যি?’ রেহানা কথাটা বলল বটে কিন্তু বিশ্বাস করল বলে মনে হলো না। তার কথাবার্তা হাস্যকর মনে হচ্ছে।

মুহাম্মদ আলী ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার মুখস্ত কথাগুলো বলা শুরু করল, ‘শোনো, সাহেব ভাবেন, যে মহিলারা মঙ্গলবার আসে তারা লুটনের বাস ড্রাইভার অথবা ম্যানচেস্টারের চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের মতো অসৎ ও মিথ্যাবাদী।’
রেহানা প্রতিবাদ করল, ‘কিন্তু আমি তাদের বলবো আমি ওই দলের নই।’
মুহাম্মদ আলী বলল, ‘তুমি তাদের কাছে চড়ুইয়ের মতো, শকুনের দৃষ্টিতে তারা তোমার দিকে তাকাবে। শুধু তাই নয়, তারা একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে অনেক কিছুই জানতে চাইবে। প্রশ্নগুলো এতোটাই ব্যক্তিগত, যে কোনো মেয়ে শুনে লজ্জা পাবে। তারা জিজ্ঞেস করবে, তুমি কুমারী কিনা? এবং যদি না হও তাহলে কার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক রয়েছে। গোপন মিলনের সময় তোমরা একে অন্যকে কী নামে ডাকো? এমন প্রশ্নও করতে পারে তারা! বুঝেছ?’

মুহাম্মদ আলী খুব নির্দয়ভাবে কথাগুলো এ জন্য বলছিল যে, যাতে সে আঘাত পায়। কারণ আসল ঘটনা এর চেয়েও ভয়ংকর!
রেহানা শান্ত দৃষ্টিতে কথাগুলো শুনছিল। কিন্তু মুহাম্মদ আলীর হাত ডেস্কের একপ্রান্তে বেশ ছটফট করছিল। সে আবারও বলতে শুরু করল, ‘তারা তোমাকে আরো জিজ্ঞেস করবে, বাড়িতে কয়টা রুম আছে, দেয়ালগুলো কী রঙের? আর হ্যাঁ, তোমার ব্রাডফোর্ডের  মুস্তাফা দারের কথাও জিজ্ঞেস করবে। যদি তুমি কোনো রকম একটু ভুল করো তাহলে একেবারে শেষ।’
‘হ্যাঁ, আমি বুঝতে পেরেছি’ রেহানা বলল। তার কণ্ঠে অনুগতের সুর শুনতে পেল আলী। রেহানা এবার একটু নড়ে বসল। এবার বলুন, ‘আপনার কী পরামর্শ?

মুহাম্মদ আলী এটাই মনে মনে চাইছিল। সে দ্রুত ফিসফিস করে কথাগুলো বলতে শুরু করল। সে রেহানাকে জানাল, সে এমন একজন লোককে চিনতো যে খুব ভালো মানুষ। দূতাবাসে কাজ করতো। তার মাধ্যমেই একটা নির্দিষ্ট ফি দিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে সঠিক ছিলছাপ্পর মেরে আনা হতো। ব্যবসাটা ছিল খুব ভালো। মহিলারা খুশি হয়ে তাকে প্রায়ই পাঁচশ রুপি অথবা কখনও কখনও তার কষ্টের কথা বিবেচনা করে তাকে সোনার ব্রেসলেটও উপহার দিয়ে তাকে খুশি করতো। তারা শত শত মাইল দূর থেকে তার কাছে আসতো। তাদেরকে ছলচাতুরি সম্পর্কে কাজ শুরুর আগেই নিশ্চয়তা দিত সে। আসলে যাই হোক না কেন জীবন খুব শক্ত এবং একজন বৃদ্ধ মানুষের বুদ্ধির দ্বারাই চলা উচিৎ।

এবার মুহাম্মদ আলী আসল কথাটা ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলো, ‘তোমাকে দেখেই মনে হয়েছে, তুমি বিরল, খাঁটি রত্ন। আমি তোমার জন্য তাই করবো যা সম্ভবত আমি আমার মেয়ের জন্যও করতাম না। আমার কাছে একটা ডকুমেন্ট আছে যেটা তোমার সব দুঃশ্চিন্তা দূর করবে।’
‘কী সেই জাদুকরী কাগজ?’ জিজ্ঞাসা করলো রেহানা। তার চোখে এখন প্রশ্নহীন হাসি।
কণ্ঠে মলিনতা এনে আলী বলল, ‘মিস রেহানা, এটা ব্রিটিশ পাসপোর্ট। আসল এবং ভালো মাল। আমার একজন ভালো বন্ধু আছে যে তোমার নাম এবং ছবি এখানে বসিয়ে দেবে। এরপর তুমি চলে যেতে পারবে সোজা ইংল্যান্ড; মানে যেখানে যেতে চাও, চলে যেতে পারবে।’

‘আপনি আমাকে অন্যায় প্রস্তাব দিচ্ছেন।’ প্রায় চমকে উঠল রেহানা।
‘না, ঠিক অন্যায় নয়।’ বাধা দিয়ে বলল মুহাম্মদ আলী।
‘হুম, আপনি চান আমি অবৈধভাবে এভাবে লন্ডনের ব্রাডফোর্ডে যাই। কিন্তু এটা মোটেই ভালো উপদেশ নয়।’
‘ব্রাডফোর্ড লন্ডন নয় ইংল্যান্ডে।’ শোকার্তভাবে এটা সংশোধন করে দিলো আলী। তারপর বলল, ‘আমার উপহার এভাবে গ্রহণ করা তোমার ঠিক নয়।’
‘কীভাবে?’
‘দেখুন, আমি একজন গরিব সহকারী। এবং আমি তোমাকে সুযোগটা দিচ্ছি কারণ তুমি খুব সুন্দরী! আমার এই মহত্বটার ওপর থুতু ছিটাবে না। বিষয়টা ভাবো। আর না হলে সোজা বাড়ি চলে যাও।অযথা এই বিল্ডিংয়ে ঢুকে মর্যাদা খোয়াবে না।’

রেহানা উঠে গটগট করে হেঁটে গেটের দিকে চলে গেল। সেখানে মহিলারা সব জড়ো হচ্ছিল এবং তাদের যাতে নেওয়া হয় এ বিষয়ে শপথ করে বলতে বলতে তারা প্রায় অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিল।
‘বোকামি করো না।’ চিৎকার করে উঠল মুহাম্মদ আলী।
কিন্তু রেহানা ফিরল না। মোহাম্মদ আলী চিৎকার করে বলল, ‘এটা আমাদের জন্য অভিশাপ। আমরা গরিব। অশিক্ষিত। আমরা কোনো কিছুই  পুরোপুরি শিখতে প্রত্যাখান করি।’

সেদিন মুহাম্মদ আলী আর কিছুই করল না। সে দূতাবাসের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বলছিল বারবার- এখান থেকে যাও। বৃদ্ধ বোকা। মেয়েরা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায় না। দূরে দূরে থাকো। কিন্তু যখন রেহানা ফিরে এলো তখন নতুন করে তার মনে আশা জাগল।
‘সালাম, উপদেশওয়ালা।’ রেহানা অফিসারের রুম থেকে বের হয়ে তাকে অভিবাদন জানাল। রেহানাকে বেশ শান্ত দেখাচ্ছিল। আলী মনে মনে ভাবল, ইয়া আল্লাহ সে যেন সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়। নিশ্চয়ই সাহেব তাকে ইংল্যান্ডে যাবার ছাড়পত্র দিয়েছেন। এই ভেবে আলী রেহানাকে দেখে আশান্বিত হয়ে হেসে উঠল। রেহানাও দ্বিধাহীনভাবে হাসি ফেরত দিল।
‘অভিনন্দন, নিশ্চয় ওখানে তোমার সমস্যা হয়নি।’ ঝোকের বশে আলী তার হাতটা রেহানার হাতে রাখল।

‘আসুন। আমাকে কিছু পাকোরা কিনে দেবেন এবং ধন্যবাদ আপনার সুন্দর উপদেশের জন্য। আর হ্যাঁ, আমার খারাপ ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।’ বলেই রেহানা তাকে নিয়ে ধূলিমিশ্রিত বিকেলের বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াল। বাসগুলো তখন স্টেশন ছেড়ে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছাদের উপর বিছানা পাতার চেষ্টা করছে কুলিরা। যাত্রী দেখে চিৎকার করে ‘লাভ স্টোরি’র বই এবং সবুজ ওষুধ বিক্রি করার চেষ্টা করছে হকার। সবকিছু মিলে অসুখী ভাবটা কেটে যাচ্ছিল। রেহেনা এবং মুহাম্মদ আলী বাসের বাম্পারে হেলান দিয়ে পাকোরা খাচ্ছিল। অভিজ্ঞ উপদেশওয়ালা মুহাম্মদ আলী এ সময় পুরনো এক সিনেমা থেকে একটা গান গাইছিল গুনগুন করে। দিনের সূর্য ততক্ষণে ঢলে পড়তে শুরু করেছে।

‘এটা ছিল অ্যারেঞ্জ এনগেজমেন্ট’ এই বলে শুরু করলো রেহানা। ‘আমার বয়স যখন নয় বছর, তখন মা-বাবা বিয়েটা ঠিক করে রেখেছিলেন। মুস্তাফা দার এখন ত্রিশ। কিন্তু আমার বাবা চেয়েছিলেন, এমন একজন যে সত্যিই আমাকে যত্নে রাখবে, টেক কেয়ার করবে। মানে আমার বাবা যেরকম ছিল আর কি। মুস্তাফা দার আমার দাদিজির মতে সেরকমই একজন। এরপর আমার মা-বাবা দুজনই মারা গেলেন। মুস্তাফা চলে গেল ইংল্যান্ড। এখন সে আমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে সেখানে। অনেক বছর আগে তার ছবি দেখেছি আমি। খুব অদ্ভুত লেগেছে আমার কাছে। এমনকি তার কণ্ঠও আমি ফোনে চিনতে পারি না।’

রেহানার এই স্বীকারোক্তিতে মুহাম্মদ আলী খুব অবাক হলো। কিন্তু সে মাথা নাড়াল জ্ঞানী ব্যক্তির মতো। তারপর বলল, ‘শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক মা-বাবা নিজেদের পছন্দ মতো পাত্রই নির্বাচন করেন। তোমার জন্যেও তারা একজন সৎ ও আদর্শবান পাত্র দেখে রেখেছেন। তাদের কথা রাখার জন্যে তোমাকে তার কাছে যেতে হবে। এখন তুমি জীবনভর তাকে জানতে পারবে এবং ভালোবাসবে।’

‘কিন্তু ওল্ড ম্যান, কেন আপনি এরপরেও আমাকে বস্তাবন্দি করে ইংল্যান্ডে পোস্ট করে দিতে চাইছেন?’ জিজ্ঞেস করল রেহানা।
এবার মর্মাহত হলো মুহাম্মদ আলী। সে বলল, ‘তোমাকে সুখী দেখতে।’ বলেই মুহূর্তের জন্য থামল আলী। তারপর রেহানার দিকে ফিরে বলল, ‘দাঁড়াও দাঁড়াও, মনে হচ্ছে তারা তোমাকে নিরাশ করেছে। কিন্তু কেন?’
‘‘আমি তাদের সব প্রশ্নের উত্তর ভুল দিয়েছি। সবকিছুই উল্টো করে বলেছি আমি। একেবারে যাকে বলে ‘বাথরুম সজ্জা’- সবকিছুই এলোমেলো।’’
‘কিন্তু এখন কী করা যায়? কীভাবে তুমি যাবে?’
‘আমি এখন সোজা লাহোরে ফিরে যাব এবং আমার কাজে যোগ দেব। আমি ওখানে এক সুন্দর বাসায় কাজ করি। সেখানে তিনটা ভালো ছেলে আছে। আসার সময় তাদের খুব মন খারাপ দেখে এসেছি।’

‘কিন্তু এটা একটা ট্রাজেডি!’ দুঃখের সঙ্গে বলল মুহাম্মদ আলী। ‘ওহ্ আমি তোমাকে কতবার বললাম, আমার প্রস্তাবটা ভেবে দেখ। কিন্তু এখন তো আর এটা সম্ভব না। আমি তোমাকে আগেই অবহিত করেছিলাম। তারা এখন তোমার ফর্মটা ফাইলে রেখে দিয়েছে। ক্রস চেক তৈরি হয়ে গেছে। এখন আর পাসপোর্টও কাজে লাগবে না। শেষ, সব শেষ! এটা কত না সহজই হতো যদি ঠিক সময়ে তুমি আমার উপদেশ গ্রহণ করতে।’
‘আমি সেটা মনে করি না। কারণ আমি সত্যিই চাইনি আপনি কষ্ট পান।’ শেষ হাসি হাসল রেহানা। এই হাসিটাই কম্পাউন্ড থেকে শুরুতেই দেখেছিল মুহাম্মদ আলী। একটা বাস এসে ধুলো উড়িয়ে সেটাকে গোপন করে ফেলার আগ পর্যন্ত রেহানার মুখের দিকেই তাকিয়ে রইল সে। তার দীর্ঘ কর্কশ, কঠোর, ভালোবাসাহীন জীবনের এটাই ছিল সেরা সুখী মুহূর্ত।


লেখক পরিচিতি : সালমান রুশদি’র জন্ম ভারতের মুম্বাই, দেশবিভাগের ঠিক দু’মাস আগে।তিনি ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ ১৯৮১ সালে বুকার প্রাইজ অর্জন করে। বুকার পেয়ে নিজের সামর্থের পরিচয় দিলেও গোল বাধে ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ লেখার পর। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগে ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন। এই ফতোয়া মাথায় নিয়েই তিনি আত্মগোপন করে ছিলেন দীর্ঘদিন। অনুবাদকৃত ছোটগল্পটি তার গল্পগ্রন্থ ‘ইস্ট-ওয়েস্ট’ (১৯৯৪) থেকে নেওয়া।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ আগস্ট ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়