ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ভাসছে মানুষ, ডুবছে মানবতা

রফিক মুয়াজ্জিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২২, ২৩ মে ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভাসছে মানুষ, ডুবছে মানবতা

ফাইল ফটো

রফিক মুয়াজ্জিন : অথই সাগর। চারদিকে পানি আর পানি। কূল নেই, কিনার নেই। এর মধ্যে ছোট, বড়, মাঝারি নৌকায় ভাসছে মানুষ। ছোট মানুষ, বড় মানুষ। চিন্তাগ্রস্ত আর কান্নারত মানুষ।

 

সম্প্রতি বঙ্গোপসাগর, মালাক্কা ও আন্দামান সাগরে এমন দৃশ্য চোখে পড়ছে। ভয়ংকর বাস্তব এসব দৃশ্য। ভাসছে মানুষ, ডুবছে মানবতা।

 

একটু ভালোভাবে বাঁচার জন্য সাগর পাড়ি দিচ্ছেন শত শত নারী-পুরুষ। কেউ কেউ পাচারের শিকার হয়ে সাগরে ভাসছেন। কাউকে কাউকে প্রলোভন দেখিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এদের মধ্যে কিছু মিয়ানমারের আর কিছু বাংলাদেশের নাগরিক। অধিকাংশের গন্তব্য মালয়েশিয়া কিংবা এরকম কোনো দেশ। কারো কারো কোনো গন্তব্য নেই, তাদের বিক্রির জন্য পাচার করা হচ্ছে। কেউ কেউ অপহরণের শিকার। পণ দিলে মিলবে মুক্তি।

 

এতগুলো মানুষ সাগরে ভাসার কারণ যা-ই হোক, তারা ভালো নেই। তাদের ভালো থাকার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তারা ভালো থাকতে চান।

 

নৌকায় খাবার নেই, পানি নেই। অনেক সময় নৌকার ইঞ্জিনে জ্বালানিও থাকে না। খাবারের জন্য ঝগড়া হয়, মারামারি হয়। নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে মারা যান অনেকে। এদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে।

 

যারা ভাসতে ভাসতে কোনো একটা দেশের স্থলভাগে গিয়ে আশ্রয় নেন, তাদের দুর্গতিও শেষ হয় না। পুলিশি হয়রানি, আশ্রয়ের অভাব, খাবারের সংকট পিছু ছাড়ে না। মুক্তিপণ দিতে না পারায় কারো কারো তো প্রাণহানিই ঘটে। ঠাঁই হয় গভীর জঙ্গলের গণকবরে। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে এ রকম গণকবর থেকে অর্ধশতাধিক ভাগ্যহত বাংলাদেশির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে সম্প্রতি। মুক্তিপণ না দেওয়ায় প্রাণ দিতে হয় তাদের।  গত ২২ মে থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী মালয়েশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য পের্লিসের দুটি স্থানে অন্তত ৩০টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে পুলিশের বরাত দিয়ে জানিয়েছে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম।  এসব গণকবরে শতাধিক লাশ পাওয়া গেছে। এদের অধিকাংশই বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা। 

পের্লিসের পাডাং বেসারে মানবপাচার চক্রের অন্তত ১৭টি বন্দিশিবির রয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।মালয়েশীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ জাহিদ হামিদি সাংবাদিকদের বলেন, খুব সম্ভবত পাঁচ বছর ধরে এই ক্যাম্পগুলো সচল ছিল। তিনি বলেন, ‘একেকটা কবরে তিন অথবা চারটি করে দেহ রয়েছে। কিন্তু আমরা জানি না তাদের মোট সংখ্যা কত। এমন দেহ অথবা দেহাবশেষ আরো পাওয়ার আশঙ্কা করছি আমরা।’

 

এদিকে নাগরিকদের কল্যাণের নামে রাষ্ট্র নামের যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, সেসব প্রতিষ্ঠান আছে চোখ বুজে। কেউ দায় নিচ্ছে না, নিতে চাচ্ছে না। দায় চাপাচ্ছে অন্যের ওপর। যেসব দেশের উদ্দেশে সাগর পাড়ি দিচ্ছে অসহায় মানুষগুলো, সেসব দেশও উটকো ঝামেলা ভেবে আশ্রয় দিতে নারাজ। এমনকি কোনো কোনো দেশ তাদের জেলেদের এমন নির্দেশনাও দিয়েছেন যে, তারা যেন ভাসমান রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের উদ্ধার না করে।

 

কিছু মানবিক মানুষ আর মানবাধিকার সংগঠন এসব জলে-ভাসা লোকের পক্ষে কথা বললেও তাতে কান দিতে চান না সাগরপাড়ের দেশগুলো। অবশ্য জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অব্যাহত চাপ দেওয়ায় ফিলিপাইনের মতো কিছু দেশ সাময়িক আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছে। মালয়েশিয়াও সুর নরম করেছে।

 

কিন্তু এসব পদক্ষেপ সাময়িক সমাধান হলেও দীর্ঘমেয়াদি সুফল বয়ে আনবে না। বুঝতে হবে- কেন মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছোট নৌকায় সাগর পাড়ি দিচ্ছেন। সমূহ বিপদের কথা জেনেও কেন পরিবার-স্বজন ফেলে বিদেশে যাওয়া চেষ্টা করছেন। যারা স্বেচ্ছায় মালয়েশিয়া বা এরকম কোনো দেশে যেতে চাচ্ছেন, তাদের মূল উদ্দেশ্য চাকরি করা। চাকরি মানে শ্রমিক হিসেবে কাজের সুযোগ। দেশে কর্মসংস্থানের অভাব থাকায় তারা এ পথ বেছে নিচ্ছেন। তাই দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এটা যে শুধু সরকারি বা বেসরকারি চাকরিই হবে তা নয়, ব্যবসা করার পুঁজি ও প্রশিক্ষণ দিয়েও ব্যাপক কর্মসংস্থান করা সম্ভব। যারা একান্তই বিদেশে যেতে চান, তাদের রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় পাঠাতে হবে। কিংবা অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্র আরো বাড়াতে হবে।

 

শুধু সীমান্তে টহল দিয়ে মানবপাচার ঠেকানো সম্ভব নয়। পাচার ঠেকাতে জনসচেতনা বাড়াতে হবে। মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত দেশি ও বিদেশি সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোতে গত কয়েক দিনের খবর অনুযায়ী প্রায় ৮ হাজার মানুষ এখনো সাগরে ভাসছেন। অস্ট্রেলিয়ার একটি সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, চলতি মে মাসের প্রথম দিকে থাইল্যান্ডে মানবপাচার চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পর থেকে সাড়ে তিন হাজার অভিবাসী তীরে পৌঁছেছে অথবা মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের উপকূলরক্ষা বাহিনী তাদের উদ্ধার করেছে।  অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলি বিশপ এসব তথ্য জানিয়েছেন।  দেশটির প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবোট অভিবাসীদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করার পরই বিশপ এ তথ্য জানান।

 

জুলি বিশপ আরো জানান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাগরে ভাসা ৭ হাজার অভিবাসীর অধিকাংশই কাজের জন্য বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ শ্রমিক, তারা রোহিঙ্গা শরণার্থী নন। সাগরে ভাসমানদের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ ভাগ রোহিঙ্গা। বাকিরা বাংলাদেশি। তারা অবৈধ শ্রমিক বা আশ্রয়প্রার্থী, শরণার্থী নয়। তারা মালয়েশিয়াতে চাকরির খোঁজে যেতে বা প্রলোভনে পড়ে ইন্দোনেশিয়ায় গেছেন।

 

ইন্দোনেশিয়ার কর্মকর্তা হাসান ক্লেইব জানান, সম্প্রতি একটি নৌকা থেকে ৬০০ যাত্রীকে উদ্ধার করেছেন তারা। এদের মধ্যে ৪০০ জন বাংলাদেশি।

 

মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তিং মুয়াং সোয়েৎ বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানান, ২১ মে (বৃহস্পতিবার) নৌবাহিনীর জাহাজ সাগরে পরিদর্শনের সময় দুটি নৌযান দেখতে পায়। এর একটিতে প্রায় ২০০ জন বাংলাদেশি ছিল।

 

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও স্বীকার করেছেন যে সাগরে ভাসতে থাকা এসব মানুষের অনেকেই বাংলাদেশি। তিনি বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের দেশের ইয়ং ছেলেপেলেরা কাজের জন্য ভাগ্যান্বেষণে যেতে পারে। কিন্তু এই যে মহিলা ও বাচ্চা-বৃদ্ধরা গিয়েছে, তাদের বেশভূষা দেখবেন, তা দেখলে স্পষ্ট হয় বেশিরভাগ রোহিঙ্গা।’

 

বাংলাদেশি হলে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার কথা জানান তিনি। মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার হয়ে ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে তাদের অনেকে বিদেশে গিয়ে থাকে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানানো হয়েছে।

 

তবে একটা স্বস্তির খবরও মিলেছে- গাম্বিয়া সরকার সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গা মুসলমানদের উষ্ণ সহায়তা এবং সে দেশে তাদের বসতি স্থাপন করতে দিতে প্রস্তত। বিভিন্ন দেশ মিয়ানমারের এসব লোককে নাগরিকত্ব দিতে অব্যাহতভাবে অস্বীকৃতি জানানোর প্রেক্ষাপটে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া এই ঘোষণা দেয়।

 

গাম্বিয়া সরকার গত বুধবার এক প্রজ্ঞাপনে জানায়, মানুষ হিসেবে অসহায় অন্য মানুষদের সহায়তা করা পবিত্র কর্তব্য। সাগরে ভাসমান অভিবাসীদের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডকে সহায়তা প্রদান এবং অভিবাসীদের গাম্বিয়ার উদ্বাস্তু শিবিরে পাঠানোর জন্যও দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। অভিবাসীদের তাঁবু, বিছানা, কম্বল, ওষুধ ও খাবার সরবরাহে সব দেশের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠারও আহ্বান জানিয়েছে গাম্বিয়া। বুধবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তাদের সহায়তা করার কথা ঘোষণা করেছে। আর ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া ৭ হাজার অভিবাসীকে এক বছর পর্যন্ত তাদের দেশে ঠাঁই দিতে সম্মত হয়েছে।

 

লেখক : সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ মে ২০১৫/রাসেল পারভেজ/কমল কর্মকার

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়