ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ ও চ্যালেঞ্জ

এম এ রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ ও চ্যালেঞ্জ

এম এ রহমান : স্বাধীনতার ৫০তম বছর ২০২১ সালকে বাংলাদেশ সরকার উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উদযাপন করতে চায়।

 

বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে ঘোষণা করে। কিন্তু মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে বিশ্বব্যাঙ্ক দুটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে। একটি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ ও অন্যটি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ।

 

মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে শুরু করে ৪ হাজার ১২৫ ডলার পর্যন্ত দেশগুলো হলো নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ এবং ৪ হাজার ১২৬ ডলার থেকে শুরু করে ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার পর্য্ন্ত আয়ের দেশগুলো হলো বিশ্বব্যাংকের হিসেবে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ।

 

আবার মাথাপিছু জাতীয় আয় এর চেয়ে বেশি হলে সেই দেশগুলোকে উচ্চ আয়ের দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৩১৪ ডলার, বিশ্বব্যাংকের হিসেবে যা নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ।

 

বিশ্বব্যাংক ‘এটলাস মেথড’নামের বিশেষ এক পদ্ধতিতে মাথাপিছু জাতীয় আয় পরিমাপ করে থাকে। একটি দেশের স্থানীয় মুদ্রায় মোট জাতীয় আয়কে (জিএনআই) মার্কিন ডলারে রূপান্তরিত করা হয়। এ ক্ষেত্রে তিন বছরের গড় বিনিময় হারকে সমন্বয় করা হয়।

 

নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা দিয়েছে যে, ২০২১ সালে বাংলাদেশ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে প্রবেশ করবে। যদিও এ লক্ষ্য অর্জন মোটেই সহজ নয়। এজন্য বহু পথ পারি দিতে হবে।

 

নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওযার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে ঘোষনা দিয়েছেন, বাংলাদেশ কখনো ‘নিম্নতে’ থাকতে চায় না, সব সময় ‘উচ্চতে’ থাকতে চায়। ২০২১ সালের লক্ষ্যমাত্রার আগেই বাংলাদেশকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে যা যা দরকার, তার সবই করবে সরকার।

 

নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে রুপান্তর করতে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করার পাশাপাশি রপ্তানি আয়, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, সামাজিক উন্নয়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ বেশি কিছু সূচকে আরো অগ্রগতি অর্জন করতে হবে বলে  মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। যদিও সরকারের ভিশন ২০২১ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আশাতীত অগ্রগতিও হয়েছে। খাতওয়ারি বিশ্লেষন করে দেখা যায়-

 

রপ্তানি আয় : ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ৩৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ১০ দশমিক ১৪ শতাংশ বেশি। মোট রপ্তানির ৮২ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। কিন্তু রপ্তানিত আয় বাড়াতে হলে রফতানিযোগ্য পণ্যের সংখ্যা এবং পরিমাণ বৃদ্ধি করা দরকার।

 

এক্ষেত্রে পাট, জাহাজ নির্মাণ শিল্প, পশুর চামড়া, মৎস্য, চা, ওষুধ, টিনজাত পণ্য, সিমেন্ট, গরুর মাংস, দুধ, মুরগির মাংস, চাল, শাক-সবজি ইত্যাদি রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার সুযোগ রযেছে। সবচেয়ে আশার কথা বাংলাদেশের অপ্রচলিত পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে। 

 

প্রবৃদ্ধি হিসেবে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে পেট্রোলিয়াম উপজাত দ্রব্যে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কৃষি পণ্য রপ্তানি আয় ১ দশমিক ৭১ শতাংশ; কেমিক্যাল পণ্য রপ্তানি আয় ১০ দশমিক ৪৮ শতাংশ, পেট্রোলিয়াম বায়ো প্রোডাক্ট রপ্তানি আয় ২৮২ দশমিক ৯৯ শতাংশ; চামড়া ও চামড়াজাতীয় পণ্য রপ্তানি আয় ২ দশমিক ৬৯ শতাংশ; রাবার পণ্য রপ্তানি আয় ১৬.৬০ শতাংশ; ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য রপ্তানি আয় ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ; ফার্নিচার রপ্তানি আয় ১৮ দশমিক ৮০ শতাংশ এবং পাট ও পাটজাতীয় পণ্য রপ্তানি আয় ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ বেড়েছে, যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।

 

সুযোগ রয়েছে জাহাজ নির্মাণ শিল্প থেকেও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের। বর্তমানে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জাহাজ নির্মাণ থাতে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বাজার রয়েছে। এই খাতে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।

 

বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে অর্থনৈতিক অঞ্চল : এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি ও দেশকে উচ্চ মধ্যম আয়ের পর্যায়ে উন্নীত করার প্রচেষ্টায় মোট ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এখান থেকে রপ্তানি আয় করা যাবে অন্তত চার হাজার কোটি ডলার।

 

ইতিমধ্যে সরকারি ও বেসকারিভাবে অনুমোদিত মোট ৩৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে। এছাড়া অনুমোদনের অপেক্ষায় অন্তত আরো ৩১টি অর্থনৈতিক অঞ্চল। পর্যায়ক্রমে আগামী ১৫ বছরে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে সরকার। অনুমোদিত অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো হলো: সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বাগেরহাট অর্থনৈতিক অঞ্চল, চট্টগ্রামের মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল, আনোয়ারা (গহিরা) অর্থনৈতিক অঞ্চল চট্টগ্রাম, শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল মৌলভীবাজার, গাজীপুরের শ্রীপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল (জাপানিজ ইকোনমিক জোন), সাবরাং ট্যুরিজম বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বরিশালের আগৈলঝাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চল, আনোয়ারা অর্থনৈতিক অঞ্চল-২, কেরাণীগঞ্জে ঢাকা আইটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল, নারায়ণগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল, নারায়ণগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল-২।

 

ভোলা অর্থনৈতিক অঞ্চল, আশুগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল, কুষ্টিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল, পঞ্চগড় অর্থনৈতিক অঞ্চল, নীলফামারী অর্থনৈতিক অঞ্চল, নরসিংদী অর্থনৈতিক অঞ্চল, মানিকগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল, ঢাকার দোহারের অর্থনৈতিক অঞ্চল, হবিগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল, শরীয়তপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল, জালিয়ারদ্বীপ অর্থনৈতিক অঞ্চল টেকনাফ, নাটোর অর্থনৈতিক অঞ্চল, কক্সবাজারে মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চল, মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চল-২ ও ৩, কক্সবাজার ফ্রি ট্রেড জোন (মহেশখালী) এবং শরীয়তপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল-২।

 

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়ন : একটি শ্লোগান রয়েছে যে দেশ যতো বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, সে দেশ ততো উন্নত। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর গত সাত বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ও বিতরণে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছে।

 

বিদ্যুৎ ও জ্বালানী বিভাগ সূত্রানুসারে, বিদ্যুতে গ্যাসের বর্তমান নির্ভরতা ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪২ শতাংশ করা, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ২ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার মাধ্যমে ৬ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা, উচ্চমূল্যের আমদানিনির্ভর তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩০ থেকে কমিয়ে ১৩ শতাংশ করার পরিকল্পনা করছে সরকার। অন্যদিকে ২০২০ সালের মধ্যে পারমাণবিক জ্বালানি থেকে ১ হাজার মেগাওয়াট ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ২ হাজার মেগওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এছাড়া দারিদ্রের হার ১৪ শতাংশে কমিয়ে আনতে চায় সরকার।

 

মানবসম্পদ ও সামাজিক খাতে অগ্রগতি : দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদে রুপান্তর করতে সরকার সামাজিক উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

 

আগামী দশ বছরে ১৫ লাখ দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ তৈরি করতে চাচ্ছে সরকার। বাজেটে মানব সম্পদ উন্নয়নের প্রধান তিন খাত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষায় ৮৬ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট বাজেটের প্রায় ২৬ শতাংশ। শিক্ষায় ৪৯ হাজার ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

 

২০২১ সালের লক্ষ্য অর্জনের বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিশন ২০২১ পূরণে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন কর অবকাশ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছি। দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো বিশেষ সুবিধা অব্যাহত রেখেছি। আমাদের করের নানা সুবিধা দেওয়ার কারণেই বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। আমরা সুবিধা না দিলে ভারত আমাদের ছাড়িয়ে যেতো। কর সুবিধা ও বিনিয়োগের উন্নতি ভিশন ২০২১ অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’

 

তবে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডির প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এটা অসম্ভব বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ‘২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে বিশ্ব ব্যাংকের হিসেবে মাথাপিছু আয় চার গুণ বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে হবে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। যা একেবারে অসম্ভব।’

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এম এ রহমান/তৈয়বুর রহমান

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়